ধন্য, ধন্য বলি তারে!!!

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:১১ পিএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৮

রোকসানা ইয়াসমিন

বাপরে কী সাহস মেয়েটির!!! পুলিশ মুখে আলো ফেলতেই বলল ‘মুখে আলো ফেলবেন না’। তখন একজন বলল, আপনি কি বিশ্ব সুন্দরী যে আপনাকে দেখতে হবে? মেয়েটি বলল ‘বিশ্ব সুন্দরী কি আপনাকে চান্স দেবে?’ বাদানুবাদের এক পর্যায়ে পুলিশ বলল, হোটেল থেকে আসছে মনে হয়। মেয়েটি তেতে গিয়ে বলল, ‘হ্যা আসছি, আপনার সমস্যা?’ পুলিশ যখন বলে, কেউ অপেক্ষা করছে কি না, তখন মেয়েটি আরও ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘তোর বাপ অপেক্ষা করছে।’ ওরা যখন মেয়েটিকে বলল ব্যাগ খুলতে, মেয়েটি ব্যাগটা দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি ব্যাগ খুলেন, আমার ঠ্যাকা পড়ে নাই।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া মেয়েটার ভিডিওটা আমি বেশ কয়েকবার দেখলাম। আমি সত্যিই মুগ্ধ!! আমি এত সাহস দেখাতে পারতাম না ভেঙে পরতাম, ভয় পেতাম। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ‘বাঘে ছুঁলে এক ঘা পুলিশে ছুঁলে ১৮ ঘা!’

মেয়েটির ভাগ্য ভালো। পুলিশ নিজেই নিজের ফাঁদে পা দিয়েছে। হয়ত স্কলাস্টিকা স্কুলের ঘটনা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই ভিডিও ধারণ করেছিল। রাত-বিরাতে চলে এই রকম একটা মেয়েকে সামনে এনে উনারা বাহাবা কুড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু পুরা ব্যাপারটাই বুমেরাং হয়ে গেল, আহা বেচারারা!!! যে মেয়েটির চরিত্র হরণের জন্য তারা এত কিছু করল, সেই হিরো হয়ে গেল, আফসোস!

পুরো ঘটনাটি মনেযোগ দিয়ে দেখলে বুঝা যায় যে, পুলিশ খুব ঠান্ডা মাথায় কাজটি করেছে। তারা মেয়েটিকে উস্কে দেওয়ার জন্য একটু পর পর কথা বলছিল এবং একজনের পর একজন বলেছিল। আমাদের দেশের পুলিশ এত ঠান্ডা চরিত্রের? বাস্তবের সাথে মিল নেই যে। তারা নিজেদের ভালো আর মেয়েটিকে খারাপ প্রমাণ করার জন্য খুব পরিকল্পিতভাবে এই কাজটি করেছে বলে আমি মনে করি।

সিরিয়াসলি, মেয়েটি লাকি!! পুলিশ মেয়েটির ব্যাগে মাদক ঢুকিয়ে দিতে পারত, ছিনতাইকারী দলের সদস্য হিসেবে জেলে ভরতে পারত। এগুলোই বরং স্বাভাবিক ছিল। এ দেশে গভীর রাতে চললেই মেয়েরা হয়ে যায় পতিতা আর ছেলেরা হয় মাদক ব্যবসায়ী এবং জঙ্গি!

মেয়েটি আব্দুল কাদেরের মত পুলিশের আক্রোশের শিকার হতে পারত। আমরা নিশ্চয়ই আব্দুল কাদেরের কথা ভুলে যাইনি। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল কাদের ইস্কাটনস্থ তার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছিল। পথিমধ্যে পুলিশ তাকে গাড়িতে তুলে নেয় এবং পরে তার বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করেছিল। যদিওবা কাদের ন্যায় বিচার পেয়েছিল। কিন্তু মাঝখানে তার জীবন থেকে কয়েকটি বছর চলে গিয়েছিল জেল হাজতে আর কোট কাচারি দৌড়াতে দৌড়াতে।

১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ১৪ বছরের ইয়াসমিন একদল পুলিশ সদস্য দ্বারা ধর্ষণ আর হত্যার শিকার হয়েছিল। পুলিশ তাদের শাস্তিও পেয়েছিল কিন্তু ইয়াসমিনের পরিবার তো আর তাকে ফিরে পায়নি।

মেয়েটির সাথে যা হয়েছে তা আমাদের অনেকের সাথেই হয়। কিন্তু আমরা ঝামেলা এড়ানোর ভয়ে, লোকে যাতে খারাপ মেয়ে মনে না করে এ জন্য এড়িয়ে যাই। সব সময় ঘটনার নায়ক পুলিশ নাও হতে পারে।

ঘটনাটি ২০০৪ সালের হবে হয়ত। আমি আর আমার স্বামী নিউএজে কাজ করি। বাসায় ফেরার পথে আমরা প্রায়ই মগবাজারের ক্যাফে ডি তাজে খেয়ে ফিরতাম। তো একদিন ওই রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে বের হলাম। রাত তখন ৯টা হবে। আমার বর রিকশা ঠিক করতে অন্যদিকে গেছে। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। সেই সময় একটা লোক যার বয়স আনুমানিক ৪০-৪৫ হবে আমার খুব কাছে এসে বলল, কাছেই একটা ভালো হোটেল আছে! ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। এর মধ্যে আমার বর চলে আসতেই লোকটি সরে গেল।

১৯৯৯ সাল। মাস্টার্সে পড়ি। কক্সবাজার স্টাডি ট্যুর ছিল। আমার বাসা পুরান ঢাকায়। সায়েদাবাদে বাস থেকে নেমে সবাইকে বিদায় জানাই।একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম সকাল ৭টার দিকে। কয়েকগজ যেতেই পুলিশ রিকশা থামিয়ে ব্যাগ তল্লাশি করল। আমারও ভাগ্য ভালো ছিল যদি কিছু রেখে দিত ব্যাগের মধ্যে!!

আমি বুঝি নারী বলেই রাতে বাইরে চলাচলের জন্য পুলিশের অযাচিত কৌতূহল ও অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের শিকার হতে হয়েছিল। এখানে পুরুষ হলে বিষয়টি অন্য রকম হত। হয়ত পুরুষটিকে মাদক ব্যাবসায়ী কিংবা ছিনতাইকারী বলা হত কিংবা সাজানো হত। কিন্তু পুরুষ হলে চরিত্রের বিষয়টি আসত না। পুরুষ মানুষের আবার চরিত্র কিসের!! আমাদের বিক্রমপুরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘সোনার আংটি বাকাও ভালো।’ ছেলেরা হলো সেই সোনার আংটি।

এই দেশে মেয়েরা যখনই এগিয়ে যেতে চায় তখনই থামিয়ে দেওয়ার জন্য সবার আগে তার চরিত্র নিয়ে কথা হয়। একটা অফিসে যখন একটা মেয়ে সবচেয়ে ভালো কাজ করছে, তখন সবাই বলবে এর চরিত্র ভালো নয়। বসদের সাথে খাতির। তাদের সাথে উঠাবসা আরও অনেক কিছু।
বিস্তারিততে গেলাম না, বুঝে নেন।

সাংবাদিকতা করছি বলে রাতে চলাচলের বিষয়টি এড়ানোর উপায় নেই। যখন লেট নাইট থাকে বাসার গেটে নামি, যাতে পাড়া প্রতিবেশিরা দেখে আমি অফিসের গাড়ি থেকে নামছি। হায়রে চরিত্র!! জানি ড্রাইভার বিরক্ত হয়, কিন্তু আমার করার কিচ্ছু নাই। আমাকে যে ভালো থাকতেই হবে অন্যের চোখে। সম্ভব?

আমি মনে করি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জেন্ডার সচেতনতার বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। তাহলে এই মেয়েটির সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছে ওরা, তা ঘটার কথা ছিল না। কিন্তু পুলিশের অনেকে বলে থাকে তাদের যথাযথভাবে নারী, শিশু আর বয়স্কদের সাথে কী আচরণ করতে হয় সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আর প্রশিক্ষিত হওয়ার পরও যদি তাদের আচরণ এ রকম থাকে তাহলে বলব তাদের প্রশিক্ষণ যথাযথ নয়। যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও অনেক সময় ভিকটিমের বিপক্ষে তাদের কাজ করতে দেখা যায়।

এ দেশে এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে যারা পুলিশকে ভয় পায় না। এই ভয় পাওয়াটা অমূলক নয়। এই জন্য পুলিশের কার্যক্রমই দায়ী। খুব কমই লোক পাওয়া যাবে যারা পুলিশের সাথে আত্মীয়তা করতে চায়। আমি এই পর্যন্ত দেখিনি যে, কোনো মেয়ে বিপদে পড়েছে অথবা কেউ তাকে হেনস্থা করছে পুলিশ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। বরং তারা এমন আচরণ করে যেন এইটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা মেয়ে রাস্তায় বের হয়েছে অথচ কোনো হয়রানির শিকার হবে না, এটা কিভাবে সম্ভব! অনেক সময় দেখেছি পুলিশরাই মেয়েদের দেখে টিজ করছে, মেয়েদেরকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে মজা করছে। কারণটা কি? রাস্তা ঘাটে যে সমস্ত পুলিশ সদস্যরা থাকে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাই বা কী? আমি বলছি না যে, উচ্চশিক্ষিত হলেই মানুষ ভালো হবে, সুশীল হবে। কিন্তু শিক্ষা এক ধরনের মাপকাঠি।

শিক্ষা মানেই একাডেমিক তা নয়। স্বশিক্ষা হতে পারে। কিন্তু পুলিশে যারা কাজ করে তাদের সময়ই কোথায় তাদের স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার। আর একটা হতে পারে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের নারীর প্রতি আচরণের জ্ঞান প্রদান করা আর যথাযথ আইনের প্রয়োগ।

ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশে ওই নারীর সম্মানহানি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না, বরং এ ঘটনা ভাইরাল হওয়ায় ওই নারীর মর্যাদা বেড়েছে। ভোররাতে একাকী ওই নারী আইনের পোশাক পড়া অথচ বিকৃতমনা একদল পুরুষের সাথে যেভাবে বাদানুবাদ করেছে, তার প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছে, তাতে আমি একজন প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী, মর্যাদাশীল, সাহসী নারীকেই প্রত্যক্ষ করেছি। সে কারও কাছ সে কিছু প্রত্যাশা করেনি। নিজের লড়াইটা নিজেই লড়েছে। তার জন্য তথাকথিত নারীবাদী কিংবা কোনো সংগঠনের সাহায্যের দরকার হয় নেই।

এই ঘটনায় নিশ্চয়ই অনেক সাধারণ নারীকে সাহসী করে তুলবে। দিনের আলোয় যে নারীরা পথ চলতে ভয় পায় তারা এখান থেকে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে।

হে!! নারী তোমাকে অভিবাদন।

লেখক : সাংবাদিক

আরএস/এমএস

ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশে ওই নারীর সম্মানহানি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না, বরং এ ঘটনা ভাইরাল হওয়ায় ওই নারীর মর্যাদা বেড়েছে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।