একি বললেন আমেরিকার বিদায়ী রাষ্ট্রদূত!
‘পূর্বপুরুষের স্বপ্নপূরণ অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র/প্রথম আলোতে মার্শা বার্নিকাট’- উল্লিখিত পত্রিকায় এই হেডিংয়ে নিউজ দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বলেন কি বিশ্বের এক নম্বর শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকার রাষ্ট্রদূত! এ তো দেখি ভূতের মুখে রামনাম! বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম আলো পত্রিকার নিমন্ত্রণে তিনি সেখানে যান।
মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ইতিহাসের ছাত্রী বলে নয়, বাংলাদেশে কাজ করতে এসে বুঝেছি, এ দেশের মানুষের ইতিহাসবোধ খুব প্রখর। পূর্বপুরুষের স্বপ্নপূরণের একটা তাগিদ আছে এ দেশের মানুষের। আর সেটাই মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতির প্রধান নিয়ামক।
এটুকু বলেই তিনি থেমে যাননি। তিনি আরো বলেন, উন্নতির জন্য শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে হয়। তার এ কৃতিত্ব শুধু নিজের পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেয়াতেই সীমিত নয়। তিনি তার বাবার স্বপ্নকে পূর্ণতা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তার এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
১৭ সেপ্টেম্বর ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারবিষয়ক কর্মসূচি ‘শান্তিতে বিজয়’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে যারা সহিংসতা করে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশ ও তার নাগরিকদের স্বার্থহানি চায়। বর্তমান সরকারের সপক্ষে সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার কথা এর চাইতে বেশি আর কি হতে পারে! বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার আগে এই বোধোদয় হওয়ায় মহামান্য এক্সট্রা অর্ডিনারি এন্ড প্লেনিপোটেনশিয়্যারি (রাষ্ট্রপতির পূর্ণক্ষমতাবিশিষ্ট রাষ্ট্রদূত) প্রতিনিধিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
আসন্ন নির্বাচন নিয়েও তিনি প্রথম আলোতে কথা বলেছেন। ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের’ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি সঠিকভাবেই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিভিন্ন মন্ত্রীসহ সবাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান। আর গণতন্ত্রে সবার দায়িত্ব পালন করতে হয়।
শেষ বাক্যটির মতো কথা ইতোপূর্বে মার্শা বার্নিকাটের মুখ থেকে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। প্রসঙ্গত নির্বাচন সামনে রেখে ‘জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের’ বক্তব্য নিয়ে বিগত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ‘বার্নিকাটের বয়ান : গোড়া কেটে আগায় পানি দেয়ার নামান্তর’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম। অনেক খুঁজে দেখলাম, ওই বক্তৃতায় তিনি ‘গণতন্ত্রে সবার দায়িত্ব সমান’ কথাটি বলেননি। এটা নিঃসন্দেহে অবস্থানের পরিবর্তন।
সংবাদটা পড়ে মনে হলো সরকারের অন্যতম প্রধান বিরূপ সমালোচক, মাইনাস টু তত্ত্বের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও বিগত নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের দিকে ঝুঁকে থাকা দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এসে বিদায়ী আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের এ কথা বলা বেশ আগ্রহ উদ্দীপক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
কেননা আমাদের দেশের জ্ঞানী-গুণী নিরপেক্ষ দাবিদার ১/১১ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলতে ভালোবাসেন, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার দায়িত্ব হচ্ছে সরকারি দল বা জোটের। কথাটা তারা বুঝে বলেন নাকি না বুঝে বলেন জানি না। তবে বুঝেই বলেন বলে মনে হয়।
কেননা ক্যান্টনমেন্টে বসে ক্ষমতার সোনার চামচ মুখে নিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দল বিএনপি যে ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হওয়া ছাড়া নির্বাচনে যেতে চায় না, এটা অভিজ্ঞতা থেকে জনগণের কাছে সুস্পষ্ট। তাই জ্ঞানী-গুণীজনদের কাছেও সে কথা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন বয়কট বিষয়টা আমাদের রাজনীতিতে আমদানি হয় স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে প্রো-চাইনিজ অতিবামপন্থি রাজনীতির ভেতর দিয়ে। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক দুই হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার উল্টোমুখী পটপরিবর্তনের পর চরম দমন-পীড়ন, অপপ্রচারের মধ্যেও আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করেনি।
তাই বলা যায়, যা ছিল বামপন্থার ‘শিশুরোগ’, তা এখন ডানপন্থার ‘চক্রান্ত রোগ’-এর ঘাড়ে চেপেছে। মজার বিষয় হলো, বিগত নির্বাচনে এই রোগে অতি বাম-ডান দুটোই দুদিক থেকে এসে চিরসত্য ‘চরম দুই প্রান্ত এক বিন্দুতে মিলিত হয়’ রোমান প্রবাদবাক্যটি প্রমাণ করে মামার বাড়িতে একত্র হয়েছিল।
ধারণা করি ২০১৪ সালে বাংলাদেশে আসা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে আসার পর থেকে বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করে উল্লিখিত উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন, যা এই কলামসহ আরো কলামে বারবার প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়ার আগে এই উপলব্ধির জন্যও তাই রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। জানি না এই উপলব্ধি কী বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের নিজস্ব নাকি আমেরিকার সরকারের। তবে মনে করার কারণ আছে যে, এটা সরকারের। যদি তা হয় তবে আমেরিকার এই অবস্থান আমাদের দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও প্রতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে শুভ।
কেননা প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটির ‘দায়িত্ব সমান’ বিষয়টা যদি মেনে নেয়া হয়, তবে বিদেশিদের কাছে গণসমর্থিত দলগুলোর ধরনা দেয়ার প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি বিদেশিদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষত নির্বাচনের সময় নাক গলানো ও দৌড়ঝাঁপ কমবে। বিগত নির্বাচনের আগে দৌড়ঝাঁপ করে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দিল্লি গিয়ে দিল্লি দুরস্ত হওয়ার মুখরোচক গল্প এখনো দেশবাসীর স্মরণে আছে।
দেশবাসী আশা করবে নির্বাচনের আগে নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রদূত রাবার্ট মিলার বাংলাদেশে এসে মার্শা বার্নিকাটের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি বিবেচনায় নিয়ে চলবেন। আমেরিকার কাছ থেকে এমন কূটনীতি আশা করার সুযোগ করে দিয়েছেন বিদায়ী রাষ্ট্রদূত। তাই খোলা মন নিয়ে বিদায়ের ক্ষণে বলতে চাই : বিদায় মার্শা বার্নিকাট! আপনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন!
এটাই তো কমবেশি সবারই জানা যে, ‘সকল মানুষ সমান’, ‘বহুর মধ্যে এক’ ও ‘মুক্ত গণতন্ত্রের দেশ’ প্রভৃতি ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার মর্মবাণী। আদিবাসী আমেরিকানদের জীবনধারা ধ্বংস করে ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ’ পাইয়ে দিতে গিয়ে চরম অত্যাচার আর নির্যাতনে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল নতুন দুনিয়ার ইউরোপীয় অভিবাসীরা। নিজেদের সমাজ গড়ে তুলতে কালোদের জোর করে এনে বানিয়েছিল দাস। কিন্তু ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে নিজেদের ব্যবহৃত শিকলেই নিজেরা পড়েছিল বাঁধা।
ওই শিকল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মানবাধিকার গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার সংগ্রামে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে সাদা-কালো, ইউরোপিয়ান-আফ্রিকান-এশিয়ান মিলে সম্মিলিত আমেরিকান জাতি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিশ্ববাসীর!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমেরিকা সুপার পাওয়ার হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য বিশ্ববাসীর গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মুক্তির সব পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করে আসছে আমেরিকা। তাই সংগ্রামের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাসী সাধারণভাবে আমেরিকাকে ভয় সন্দেহ অবিশ্বাস ও ঘৃণার চোখে দেখে।
আর অবস্থা পর্যবেক্ষণে এটাই সত্য যেখানে সমস্যা, সংকট, শোষণ, যুদ্ধ, মানবাধিকারহরণ সেখানেই আমেরিকার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উপস্থিতি থাকে। জাতি হিসেবে আমরাও এ থেকে রেহাই পাইনি এবং পাচ্ছিও না।
পাকিস্তানি আমলে আমেরিকা দাঁড়িয়েছিল আমাদের গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে। আইয়ুব-ইয়াহিয়া সেনাশাসকের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান-আমেরিকা-চীন অক্ষশক্তি সৃষ্টি করে পাঠিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর। মুক্তিযুদ্ধ ও বন্যা বিধ্বস্ত দেশে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে প্রতিশ্রুত খাদ্য না পাঠিয়ে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যায়িত করেছিল।
পঁচাত্তরে ইতিহাসের বর্বরতম ও নৃশংস দুই হত্যার পর দাঁড়িয়েছিল হত্যাকারীদের পক্ষে। দুই সেনাশাসককে উস্কানি দিতে জন্মলগ্নের মর্মবাণী জাতীয় চার নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, বাংলাদেশকে বলেছিল ‘মধ্যপন্থার মুসলিম দেশ।’ এই অভিধা সত্য প্রমাণ করতে বিগত নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের পক্ষে দাঁড়াতেও কুণ্ঠিত হয়নি।
১/১১-এর পক্ষের সুশীলদের নিয়ে কিংস পার্টিকে ক্ষমতায় বসাতে পূর্বাপর মিটিং-সিটিং করে যাচ্ছিল। সবশেষে করেছিল পদ্মা সেতুকে টার্গেট। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বার্নিকাটের এসব না জানার কথা নয়। তখন কোথায় ছিল রাষ্ট্রদূত থাকার সময়ে সুন্দর উক্তি: ‘পূর্বপুরুষদের স্বপ্নপূরণ অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র!’
বলাই বাহুল্য বিশ্ব প্রেক্ষাপটে জন্মলগ্নের মর্মবাণী থেকে যেমন বহু যোজন দূরে গণতন্ত্র আইনের শাসন ও মানবাধিকার বিষয়ে আমেরিকার অবস্থান, ঠিক তেমনি আমাদের জন্মলগ্নের মর্মবাণী থেকেও দূরে সরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় রয়েছে এতদিন আমেরিকা।
এই অবস্থায় পারবে কি আমেরিকা আমাদের পূর্বপুরুষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ যাদের মর্মর ও অবিনশ্বর মূর্তি রয়েছে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের উৎসমুখে, তাদের স্বপ্ন আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার পক্ষে দাঁড়াতে? অপ্রত্যাশিত অভিনব আকস্মিক ঘটনা মানব জাতির অগ্রগতির ইতিহাসে বিভিন্ন কালপর্বে হয়ে থাকে।
এমনটা কি ঘটবে আমেরিকার দিক থেকে আমাদের জাতীয় জীবনে, যা আমেরিকাকে বিশ্বাস করার সহায়ক হবে? জানি না। তবে এটাই মানবতার রেওয়াজ যে, গণহত্যার পক্ষে দাঁড়ালে কিংবা অন্যায় অন্যায্য হত্যার মতো কিছু করলে ক্ষমা চাইতে কিংবা অন্তত দুঃখ প্রকাশ বা ভুল স্বীকার করতে হয়। পারবে কি মার্শা বার্নিকাটের দেশ আমেরিকা আমাদের জাতির কাছে তা চাইতে? যদি তা না পারে তবে আদৌ পূর্বপুরুষদের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যাভিমুখী জাতির অভিযাত্রায় আমেরিকা সর্বতোভাবে আমাদের প্রকৃত সাথী হতে পারবে না। অনাগত ভবিষ্যৎ এই প্রশ্নের জবাব দিবে।
লেখক : রাজনীতিক।
এইচআর/এমএস