আমার “চরিত্রের” সার্টিফিকেট দেয়ার মালিক একমাত্র আমি
কয়দিন ধরেই বাংলাদেশের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে “নারীর চরিত্র”। সামনেই নির্বাচন অথচ মাঠে নির্বাচনের আলোচনাকে ছাপিয়ে গরম হয়ে উঠেছে কে চরিত্রবান আর কে নয়। ঘটনা এর মধ্যেই আমরা সবাই কম বেশি জেনে গেছি। টেলিভিশনের একটি টক শোতে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের করা এক মন্তব্যকে নিয়েই এই তোলপাড় অবস্থা।
তিনি তার বিরুদ্ধে করা এক প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কারভাবে দিতে না পেরে মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর পরের ঘটনা সবাই জানেন তাই সে ঘটনা নিয়ে আমি আর আলোচনায় যাচ্ছি না। এর মাঝে যুক্ত হয়েছেন লেখক তসলিমা নাসরিন। তিনি অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কেন করছেন সেটাও নতুন করে বলার নেই। আমাদের দেশের আজকের নারীদের যে অগ্রযাত্রা এবং বলতে পারার যে ক্ষমতা অর্জন তার পিছনে একজন তসলিমার অবদান অনস্বীকার্য।
তিনি প্রথম শিখিয়েছেন মেয়েদের গলা উঁচু করেই নিজের অবস্থানকে জানান দিতে হবে- না হয় এমন করেই দিনের পর দিন নাজেহাল হতে হবে। তসলিমার অনেক সমালোচনাও আছে। তার সব কথা বা বক্তব্যের সাথে আমি একমত না হয়েও তার অবদানকে স্বীকৃতি দেই।
আমার প্রথম যৌবনের সাহস ছিলেন তিনি। একজন নারী হিসেবে যখন থেকে বুঝতে শিখেছি আমি কোথায় কোথায় কেমন করে বঞ্চনার শিকার হচ্ছি ঠিক তখনই তসলিমা নাসরিন আমাকে পথ দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই তিনিও মাঝে মাঝে নিজেকে “নারী” সত্তা থেকে বের করতে পারেন না। ব্যারিস্টার মইনুল যে অপরাধ করেছেন পাবলিকলি সেই একই কাজ করেছেন তসলিমা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে। বাস্তবে একজন মানুষ সে নারী হোক বা পুরুষ, তার চরিত্র ভালো কী মন্দ সেটা নির্বাচনের মাপকাঠি কার জানা আছে? না জানার উপায় আছে?
একজনের কাছে যা ভালো আরেকজনের কাছে সেটা অপরাধ হতেই পারে। প্রতিটা মানুষের বিশ্বাস, জীবনাচরণ সবকিছুই আলাদা হয়ে থাকে। কে কী করবে, কী পরবে, কী খাবে বা কেমন করে কার সাথে চলবে সেটা সম্পূর্ণই নির্ভর করে ব্যক্তির রুচি ও সিদ্ধান্তের উপর। তাই প্রতিটি ব্যক্তিই ইউনিক হয়ে থাকে। এখানে কাউকে ভালো বা মন্দ ট্যাগ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সমাজে একজন পুরুষ যেমন নিজের মত প্রকাশ করার, নিজের মতো করে চলার অধিকার রাখে ঠিক তেমনি একজন নারীও একই অধিকার রাখে। কারণ দুজনই একই সমাজের অধিবাসী। তাই এখানে কেউ কারও অধিকর্তা নয়। এই সাধারণ কথাটি বোঝার মতো ক্ষমতা এই আধুনিক যুগেও কেন আমাদের হয় না জানি না। যখন আমাদের দেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে তখন কেন আমাদের সমাজের উচ্চশিক্ষিত মইনুল বা তসলিমারা বুঝতে পারেন না আমার বোধে আসে না।
মাসুদা ভাট্টি ইস্যু নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত ঠিক তখনই দেখা গেলো আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক আরেক নারীকে চরিত্রের সার্টিফিকেট দেয়ার ঘটনা। অত্যন্ত আশ্চর্য ও লজ্জাজনক ঘটনা হচ্ছে রাত ২টায় রাস্তায় থাকা মানেই একজন নারী খারাপ চরিত্রের এমন ধারণা নিয়ে কেমন করে আমাদের পুলিশ ভাইরা আমাদের সুরক্ষায় কাজ করছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
একজন মানুষের প্রয়োজন কি কখনও ঘড়ি ধরে চলে? চলে না। তাছাড়া রাস্তায় একজন নাগরিকের আইনি নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব হচ্ছে পুলিশের। সে জায়গায় তারা একজন মানুষকে রাস্তায় আটকে রেখে তল্লাশির নামে যেসব ভাষায় হ্যারেস করলো ঘটনাটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও লজ্জাজনক।
তবে আমি আশাবাদী মেয়েটির সাহস দেখে। একা একজন নারী মধ্যরাতে যেভাবে চার-পাঁচজন পুরুষকে মোকাবেলা করেছে দৃশ্যটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও প্রশংসনীয়ই বটে। এই একটি ঘটনার যেমন নিন্দনীয় দিক আছে আবার আছে বেশ অনুকরণীয় দিকও।
একজনের ঘটনা দেখিয়ে দিলো কেমন করে বুক পিঠ শক্ত করে, শিড়দাঁড়া খাড়া করে রুখে দাঁড়াতে হয়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বুকে বল রেখে এগিয়ে যেতে হয়। একটা সময় নিপীড়নকারীরা পিছু হটবেই। বিপদের মুখে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন নারী বলে হার মেনে নয়, মানুষ বলে নিজের অধিকারকে স্মরণ করেই রুখতে হয় বিপদকে।
এই দুটি ঘটনায় আমার কাছে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক দিকটি হচ্ছে মানুষের প্রতিবাদের জায়গাটি। দুটি ঘটনার একটিও পানি পায়নি আমাদের কারও কাছেই। গুটিকয়েক অন্ধকারের মানুষ ছাড়া প্রতিটা মানুষ নিন্দা জানিয়েছে। তাদের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সময় এসেছে এখন। নারীরা কেবল পুরুষের দাস হবার জন্য জন্ম নেয়নি।
একজন পুরুষ কেবল পুরুষ হয়েছে বলেই আরেকজন নারীকে যখন তখন যা ইচ্ছা তা বলে পার পেয়ে যাবে সেদিন আর নেই। একজন নারী কেন, কোন মানুষকেই বিনা বিবেচনায় সার্টিফিকেট দেয়ার অভ্যাস থেকে সরে আসার কোন ব্যতিক্রম নেই।
নারীর অধিকারের লড়াই কেবল নারীর একার লড়াই নয়। সমাজে সুস্থ চর্চাকে বজায় রাখতে হলে এ লড়াইয়ে শামিল হতে হবে নারী-পুরুষ সবাইকে। কারণ এটি সমাজকে বাঁচানোর একটি লড়াই। সমাজে নারী পুরুষের সুস্থ স্বাভাবিক চলাচলকে নিশ্চিত করার লড়াই। এখানে এক পক্ষ পিছিয়ে থাকা মানে সবারই পিছিয়ে থাকা।
একজন নারী চলবে তার নিজের স্বাধীনতায়, নিজের শিক্ষায়, নিজের রুচিতে, নিজের পছন্দে। সমাজ থেকে যে শিক্ষা আমরা পাই সেটি নারী পুরুষ দুজনেই সমানভাবে পায়। কোনটা কে গ্রহণ করবে আর করবে না সেটি সম্পূর্ণই একজন ব্যক্তির নিজের সিদ্ধান্ত। সেখানে নারী বা পুরুষের জন্য কোনো আলাদা শিক্ষা থাকতে পারে না।
চরিত্র ভালো কী খারাপ সেটিও একটি আপেক্ষিক বিষয়। কোন স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম এখানে কেউ বেঁধে দিতে পারে না। এটা করলে খারাপ আর ওটা না করলে ভালো এমন সিদ্ধান্ত নেবার মালিক একমাত্র একজন ব্যক্তি নিজেই আর কেউ নয়। যে কাজ করলে পুরুষ হয়ে যায় শক্তিমান আর একই কাজ করলে নারী হয়ে যাবে কুলটা, এমন ধারণা থেকে বের না হতে পারলে সংঘর্ষ অনিবার্য।
একটি সুস্থ সমাজ মানেই নারী পুরুষের সমানভাবে চলতে পারার মত পরিবেশ নিশ্চিত করা। আমাদের সরকার নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার বিষয়ে গোটা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। এমডিজি অর্জন করে এসডিজি’র দিকে হাঁটছি। তবে সঠিক সময়ে সঠিক বিচারটি করতে না পারলে আর সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কাজটি ঠিকঠাক করতে না পারলে দিনশেষ কোন অর্জনই আর থাকবে না।
এই মুহূর্তে দরকার ব্যাপক ইতিবাচক প্রচারণা। সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে “জেন্ডার” ইস্যুতে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে হবে প্রয়োজনানুযায়ী। প্রয়োজনে প্রতিটা নিয়োগ পরীক্ষায় জেন্ডার সচেতনতা বিষয়টিকে যুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। নারীরা যেমন এগিয়ে আসছে ঠিক তেমনি যদি সহায়ক পরিবেশটি নিশ্চিত না করা যায় তবে এই অর্জনের ফলাফল হয়ে যেতে পারে শূন্য।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস