একটি স্বপ্নভঙ্গের পরের স্বপ্নগুলো

ফকির ইলিয়াস
ফকির ইলিয়াস ফকির ইলিয়াস , কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০২:২৩ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার ঠিক যথাসময়েই সাবেক চিফ জাস্টিস এস কে সিনহা'র আলোচিত বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে ওয়াশিংটন ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে। সেখানে মি. সিনহার পাশে চেয়ারপারসন হিসেবে বসা ছিলেন বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করে আসা মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। আমেরিকান প্রাজ্ঞ এই কূটনীতিক মি. মাইলাম- আগস্ট ১৯৯০ থেকে অক্টোবর ১৯৯৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

মি. উইলিয়াম ব্রায়ান্ট মাইলাম এখন ওয়াশিংটনে 'উড্র উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার' এর সাথে সিনিয়র পলিসি স্কলার হিসেবে যুক্ত আছেন। ৮২ বছর বয়স্ক এই সিনিয়র কূটনীতিক বাংলাদেশ বিষয়ে বেশ লেখালেখিও করেছেন। যা নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই মি. মাইলাম , এস কে সিনহার বইটি লেখার প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথা বলেন। এর পরেই মি. সিনহাকে কথা বলতে অনুরোধ করেন। মি. সিনহা কথা বলেছেন প্রায় একঘন্টা সময়। তার পুরো বক্তব্য জুড়েই ছিল বর্তমান সরকারের সমালোচনা। এমন কি তিনি 'বাকশাল' প্রসঙ্গও তুলে আনেন তার বক্তব্যে। সিনহা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'কে পিতার মতোই স্বৈরাচারী বলে উল্লেখ করেন।

মি. সিনহা বলেন ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন এমপি ভোট ছাড়াই সংসদে এসেছিলেন। তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, তা নতুন কিছু নয়। সব কথাই তিনি তার বইয়ে লিখেছেন। মজার কথা হচ্ছে মি. সিনহা তার ইংরেজিতে দেয়া বক্তৃতায় মাঝে মাঝেই বাংলা 'এবং' শব্দটি ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন! বলছিলেন- 'এবং..AND...' অনুষ্ঠানটিতে লোক সংখ্যা ছিলেন মাত্র কয়েকজন। ফেসবুক লাইভে তা প্রচার করেছেন কয়েকজন।

প্রায় একঘন্টা বিশ মিনিটেরও বেশি স্থায়ী এই লাইভ ভিডিও। যারা উপস্থিত ছিলেন, এদের সিংগভাগই বর্তমান সরকারের ঘোর বিরোধী বলে পরিচিতি রয়েছে। এস কে সিনহা উত্তর আমেরিকায়, বর্তমান সরকার বিরোধী এই যে জোর কার্যক্রম চালাচ্ছেন, এর নেপথ্যে কারা?

এই প্রশ্নটি তুলেছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে। তিনি তার জাতিসংঘের ভাষণ শেষে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের 'বঙ্গবন্ধু ভবনে' সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেছেন তার সফর বিষয়ক অভিজ্ঞতা। সেখানে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন- সিনহার বইয়ের অর্থ যোগানদাতা কে? সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার আত্মজীবনী প্রকাশের পেছনে কারা রয়েছে, তা খুঁজে বের করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি এ ব্যাপারে জানি, কিন্তু আপনাদের বলব না। বরং আমি আপনাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে জানতে চাই এবং আমি চাই এই বই প্রকাশের পেছনে কারা রয়েছে, তা আপনারা খুঁজে বের করবেন।’ শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি কতবার বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে আনা হয়, তা সাংবাদিকদের খুঁজে বের করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘এই বই প্রকাশনায় কারা অর্থ দিয়েছে, আপনাদের মতো কোনো সংবাদপত্রের সাংবাদিক এর সঙ্গে জড়িত কি না এবং কী পরিমাণ অর্থ দিয়েছে, তা অনুগ্রহ করে উন্মোচন করুন।’ বলা দরকার, ‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক এই বইয়ের কপিরাইট রয়েছে ললিতমোহন-ধনাবাতি মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের নামে।

এদিকে নিউ ইয়র্ক থেকে এনআরবি নিউজের বরাতে একটি সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা হচ্ছে। ‘এ ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি’ নামক আত্মজীবনী গ্রন্থে এমন কিছু তথ্য ও মতামত প্রকাশ করা হয়েছে যা আপত্তিজনক।

যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক নিজাম চৌধুরীর মার্কিন অ্যাটর্নি এই মামলার কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে ২৭ সেপ্টেম্বর জানা গেছে। নিউ ইয়র্ক সিটির বিখ্যাত একটি ল’ ফার্মের এক কর্মকর্তা মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ‘মামলার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শিগগিরই ফেডারেল কোর্টে আবেদন করা হবে।’মামলা দায়ের হয়নি বলে ফার্মের নাম নাম গোপন রাখছেন তারা।

আমরা দেখছি, মি. সিনহা একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন, জ্যুডিশিয়াল ক্যু এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার। তার টার্গেট ছিলেন ওই ১৫৩ জন এমপি। এদের ঘায়েল করেই সরকার পরিবর্তনে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। এটা সম্ভব হয়নি। এটাই তার 'ব্রোকেন ড্রিম'। কিন্তু তার ড্রিম এখনও শেষ হয়ে যায় নি। এখন তিনি চাইছেন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় কথা বলে কোনো ক্যু করা যায় কি না! তার সকল আয়োজন সেই লক্ষ্যেই।

একটা কথা না বললেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবছর (মিড টার্ম বিভিন্ন স্টেটে) যে ইলেকশন হয় তাতে প্রয়োজন মতো বিচারকদের নির্বাচনের অপশন থাকে। সেখানে 'ডেমোক্রেট" ও 'রিপাবলিকান' দলের জাজ'দের নাম থাকে দলীয় ব্যানারে। তারা গণভোটে পাশ করে আসেন। এর পরে মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেটের মুখোমুখি হয়ে তাদের মনোনোয়ন যায় প্রেসিডেন্টের দফতরে। প্রেসিডেন্ট অনুমোদন দিলেই তিনি এজলাসে বসেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকান বিচারকরা দলীয়ভাবেই মনোনীত।

এছাড়াও বর্তমান সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে বিচার বিভাগ নিয়ে, বিচারক নিয়ে অনেক কথাই আমরা মিডিয়ায় দেখছি। সেই আমেরিকায় এখন বিভিন্ন লবিস্ট ধরে লাইমলাইটে আসতে চাইছেন বাংলাদেশের সাবেক চিফ জাস্টিস! বিষয়টি আমাদের দেখতেই হচ্ছে বৈ কি ! আমরা পেছন ফিরে তাকালে দেখবো, নিউ ইয়র্কে ২৬ অক্টোবর ২০১৬ এক সংবর্ধনায় এস কে সিনহা বলেছিলেন, দেশের বিচার বিভাগ হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্বাধীন।

‘বাংলাদেশ ল’ সোসাইটি ইউএসএ ইনক’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার ও বিচার বিভাগের ভূমিকা’ শীর্ষক এক মুক্ত আলোচনায় বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, বাংলাদেশে আইনের শাসন বিদ্যমান। ক্রমান্বয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম ডিজিটাল করা হচ্ছে। আদালতগুলো থেকে ন্যায় বিচার পাওয়ায় বিচার বিভাগ যে শেষ আশ্রয়স্থল দেশের মানুষ তা উপলব্ধি করছে। তিনি বলেন, আগে সকলেই বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গ হিসেবে মনে করতেন। প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগ হচ্ছে রাষ্ট্রের অঙ্গ এবং দেশের বিচার বিভাগ হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্বাধীন।’

তিনি আরো বলেছিলেন, দেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন বলেই মার্শাল ল’ আর কখনোই বাংলাদেশের মানুষের ওপর চেপে বসার সুযোগ পাবে না।' এস কে সিনহা বলেছিলেন, ‘বিচারের জট খুলতে আমি শুরু থেকেই তৎপর। সে কারণে অনেকটা কমেছে। ক্রমান্বয়ে বিচার নিয়ে বিলম্ব ঘটার বিড়ম্বনা একেবারেই কমে যাবে। বিচার বিভাগ যথাযথভাবে পরিচালনার জন্যে সুনির্দিষ্ট ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে এখন।

সুতরাং পরবর্তীতে যারা কাজ করবেন, তাদের বড় ধরনের সমস্যা হবে না। এখন থেকে সবকিছু আইন অনুযায়ী চালাতেও কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।’ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এস কে সিনহা বলেছিলেন, ‘আমার বিচার বিভাগ এখন হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্বাধীন’। সরকারের কোন পর্যায় থেকেই কোন ধরনের হস্তক্ষেপের ঘটনা নেই।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধসহ স্পর্শ কাতর সকল মামলা পরিচালিত হচ্ছে আইন অনুযায়ী। রাজনৈতিক কারণে অনেকে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের অবতারণা করছেন। যদিও সেই রাজনীতিকরাও পুরো সুবিধা পাচ্ছেন নিজেদের মামলাতেও। এটি সর্বজনবিদিত। আর এভাবেই বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষায় বিচার বিভাগ তার ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করছে।’

সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এখন একযোগে কাজ করছে’। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর সহযোগিতার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘এখন কোন কিছুই চেপে রাখা সম্ভব নয়। মিডিয়া সোচ্চার থাকায় আমরাও সঠিকভাবে কাজে তৃপ্তি পাচ্ছি।’

যে বাংলাদেশে তার চোখে মিডিয়া, বিচারবিভাগ সবই স্বাধীন ছিল- আজ তা তার এতো বৈরি মনে হচ্ছে কেন? তিনি কি এমন কিছু করতে চেয়েছেন, যা রাষ্ট্র তাকে করতে দেয় নি! বাংলাদেশের মানুষ দুপক্ষের কথাই শুনতে চান। সিনহা'র কথাগুলো একপেশে হয়ে যাচ্ছে। সরকার কথা বললেই জানা যাবে বক্তব্যের অন্যপৃষ্ঠা। এই কাজটি যত দ্রুত করা যায়, এই নির্বাচনী সময়ে ততই মঙ্গল।

লেখক : নিউ ইয়ক প্রবাসী কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

‘যে বাংলাদেশে তার চোখে মিডিয়া, বিচারবিভাগ সবই স্বাধীন ছিল- আজ তা তার এতো বৈরি মনে হচ্ছে কেন? তিনি কি এমন কিছু করতে চেয়েছেন, যা রাষ্ট্র তাকে করতে দেয় নি! বাংলাদেশের মানুষ দুপক্ষের কথাই শুনতে চান। সিনহা'র কথাগুলো একপেশে হয়ে যাচ্ছে। সরকার কথা বললেই জানা যাবে বক্তব্যের অন্যপৃষ্ঠা। এই কাজটি যত দ্রুত করা যায়, এই নির্বাচনী সময়ে ততই মঙ্গল।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।