শুভ জন্মদিন, শেখ হাসিনা

ডা. বিএম আতিকুজ্জামান
ডা. বিএম আতিকুজ্জামান ডা. বিএম আতিকুজ্জামান
প্রকাশিত: ১০:৪১ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আজ দিনটি খুব চমৎকার। রোদটা তেমন প্রখর নয়। এ সময় অরলান্ডোর আবহাওয়া খানিকটা বাংলাদেশের হেমন্তের মতন। আমি আমাদের দীঘির পাড়ে বসে আছি। এখানে বসলেই আমার সব স্মৃতিগুলো ধারপাশে ঘোরাফেরা করে। আমি তাদের হাত ধরে চুপ করে বসে থাকি।

এ রকম একটি রোদেলা দিন ছিল জানুয়ারি ২৪, ১৯৮৮। আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়ছি। পড়াশুনার পাশাপাশি সকাল বিকেল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান মিছিলে মুখরিত আমাদের ক্যাম্পাস। সেদিন আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা লাল দীঘির ময়দানে আসছেন। বিশাল গণজমায়েত হবে। আমরা মেডিকেল কলেজ থেকে দুপুরের পর পর রওনা হলাম বেশ বড়সড় একটি মিছিল নিয়ে।

সারা চট্টগ্রামের নানা প্রান্ত থেকে মিছিল এগুচ্ছে লালদীঘির দিকে। কোতোয়ালিতে পৌঁছানোর ঠিক আগেই গুলির আওয়াজ কানে এলো। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক ছুটে গেলাম। কানে এলো শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। আমরা ছুটে গেলাম ওদিকে। পথে দুজন পথচারীকে গুলিবদ্ধ অবস্থাতে দেখে থেমে গেলাম। তাদেরকে একটি ট্যাক্সিতে তুলে আমরা ফিরে এলাম হাসপাতালে। দুজনকেই সঙ্কটজনক অবস্থাতে সার্জারি ওয়ার্ডে এনে যা দেখলাম তা কোনদিন ভুলবো না। সার্জারি বিভাগের উঠোনে ঢাকা রয়েছে লাইন ধরে রক্তাক্ত প্রাণহীন শরীর।

পুরো শহর তখন ভেঙে পড়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। মিছিল আর মিছিল। হাসপাতালের গেট বন্ধ। পুলিশ আর আর্মির গাড়ি গেটের বাইরে। তারা টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে। মেডিক্যাল কলেজের ভেতর থেকে পেট্রোল বোমা যাচ্ছে ওদের দিকে। ওরা এসেছে লাশগুলো নিয়ে যেতে।

গুজব রটে গেল আমাদের নেত্রী আর নেই। কিন্তু তাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে তিনি হাজির হলেন আমাদের ক্যাম্পাসে। আমাদের ক্যাম্পাসের গোল চত্বরে তিনি দাঁড়িয়ে নির্ভীক কণ্ঠে বললেন, “ওরা আমাকে বার বার মেরে ফেলার চেষ্টা চালাবে। আমার তো আজ এখানে থাকবার কথা ছিল না। আমার তো অনেক আগেই আপনাদের ছেড়ে চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। স্বৈরাচার নিপাত না হওয়া পর্যন্ত আমরা পথ ছাড়বো না। আমদের লাশের ওপর গণতন্ত্র আসবে।”

Hasina-2.jpg

স্বৈরাচারের পতন হলো ঠিকই। কিন্তু থেকে গেল সূক্ষ্ম কারচুপির খেল। গণতন্ত্র আর আমাদের দাবি আদায়ের লড়াই চলতেই থাকলো। আপা প্রায়ই চট্টগ্রামে আসতেন জনসভাতে, থাকতেন মেডিক্যাল কলেজের পাশে ও আর নিজাম রদে তার এক আত্মীয় আকরাম ভাই-এর বাসাতে। আমরা ফজরের পর পরই তার সাথে দেখা করতে যেতাম দলে বলে।

১৯৮৯-তে দীর্ঘদিন পর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোল। ছাত্রলীগের বিপক্ষে সবগুলো সংগঠন এক হয়ে গেল। তারপরও আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ পদগুলো পেলাম। আপার সাথে দেখা করতে গেলাম আকরাম ভাই এর বাসায়। তিনি বললেন, “থেমে থাকবার সময় নয় এটি। বিজয়ের উৎসব করার সময় নয় এখন। পরবর্তী নির্বাচনে পুরো প্যানেল দেখতে চাই।” আপার কথা রেখেছিলাম আমরা।

১৯৯৪ তে ডাক্তার হিসেবে বের হয়ে গিয়েছি। আমাদের তখন ভীষণ দুঃসময়। পদে পদে অত্যাচার, অবজ্ঞা। তখন আমরা ক’জন মিলে চলে গেলাম আফ্রিকাতে। কিন্তু দেশের সাথে নাড়ির টান ছিল সব সময়। সব সময় খবর রেখেছি কেমন আছে দেশ, কেমন আছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা।

Hasinaভাগ্যের টানে আফ্রিকা থেকে নিউইয়র্ক হয়ে ফ্লোরিডার অরলান্ডোতে চলে এলাম ২০০৪ সালে। দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পর তরুণ পরিপাকতন্ত্র আর লিভার রোগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেছি কেবল। খবর পেলাম অরলান্ডো থেকে খুব কাছের এক শহরে আপা তার মেয়ের কাছে এসেছেন কিছুদিনের জন্য। সে সময় আবার সুযোগ হোল আপাকে কাছাকাছি দেখবার। এক নৈশভোজে তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম আপা ভুলে গেছেন আমাদের। অথচ অবাক করে দিলেন তিনি। আকরাম ভাইয়ের কথা বলতেই অনেক স্মৃতির রেশ ধরে টান দিলেন তিনি।অসাধারণ তার স্মৃতিশক্তি।

সব সময়ই আপার একটি অসাধারণ ক্ষমতা আমাকে অবাক করে দেয়। তিনি সহজে যে কারো সাথে যে কোন ব্যাপারে কথা বলে মিশে যেতে পারেন। আমার মনে আছে আমার মায়ের সাথে মাছ রাঁধার রেসিপি নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন তিনি। কোলে নিয়ে আদর করলেন আমার সন্তানদের। গল্প করলেন তাদের সাথে তাদেরই একজন হয়ে।

সেসময় একজন চিকিৎসক হিসেবে তার কল্যাণে আসতে পেরে এখনো গর্ববোধ করি।

কঠিন, প্রতিহিংসাপ্রবণ রাজনীতির বলী হয়েছেন তিনি সবসময়। পরিবার, আপনজন, সহকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী তার সামনে দিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে, অনেকে তাকে ছেড়ে চলে গেছে আখের গোছাতে। তিনি লড়াই করে গেছেন সবসময়। এখনো করছেন।

অরলান্ডো থেকে দেশে ফিরলে ভাল লাগে। গণতন্ত্র আর উন্নয়নের পথে দেশ চলছে। চক্রান্তও চলছে। তারপরও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। আপার পেছনে জীবনবাজি রেখে পার করেছিলাম উত্তাল তারুণ্য। প্রায়ই এখান থেকে নতুন প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশে যাই। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলো হস্তান্তর করার পর প্রাণ গোপাল দাদা নিয়ে গেলেন আপার সাথে দেখা করানোর জন্য।

দেখা হোল অল্প কিছু সময়ের জন্য। তিনি মনে রেখেছেন আমাদের। তিনি মনে রেখেছেন অরলান্ডোকে। তিনি বললেন,"চালিয়ে যাও এসব কাজ। সময় পেলে এখানে চলে আসো।"

Hasina-2.jpg

ফ্লোরিডাতে থাকবার সময় আপা আমাদের তার স্বপ্নের বাড়ির কথা বলেছিলেন। বাড়ির উঠোনে দখিনা বাতাস আসবে। সেখানে তিনি দু দণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। বই পড়বেন। লেখাজোখা করবেন। আমি এখন সেরকম এক বাড়িতে থাকি। বাড়ির পিছনে বিশাল দীঘি। কুলে তার পদ্মফুলের বাহার। দখিনা বাতাস খেলা করে সারাদিন সেখানে। মনে ভীষণ আশা জাগে যদি একটি বেলার জন্য পেতাম তাকে।

শেখ হাসিনার অকুতোভয় কুশলী পরিকল্পনাতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুদূর অরলান্ডোতে বসে বন্দনা করি তার দীর্ঘজীবনের। একবার তাকে বলেছিলাম, অরলান্ডোবাসীরা সব সময় তার সাথে থাকবে। বিশেষ করে কঠিন সময়ে।

সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিদের হৃদয় জুড়ে আছেন তিনি। সব সময় থাকবেন তিনি।

জন্মদিনের শুভেচ্ছা শেখ হাসিনাকে, আমার নেত্রীকে। পরম করুণাময় তাকে দীর্ঘজীবন দান করুন।

লেখক : ডা. বি এম আতিকুজ্জামান, একজন খাতিমান পরিপাকপন্ত্র বিশেষজ্ঞ। ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করান।

এইচআর/আরএস/এমএস

ওরা আমাকে বার বার মেরে ফেলার চেষ্টা চালাবে। আমার তো আজ এখানে থাকবার কথা ছিল না। আমার তো অনেক আগেই আপনাদের ছেড়ে চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। স্বৈরাচার নিপাত না হওয়া পর্যন্ত আমরা পথ ছাড়বো না। আমদের লাশের ওপর গণতন্ত্র আসবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।