যাত্রীদের তবে অকল্যাণই হোক

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তারের পরদিন অফিসে এটিএন নিউজের বার্তা সস্পাদক গনি আদম জানতে চাইলেন, দাদা, এই লোক কি সত্যি চাঁদাবাজ? আমি বললাম, হতেও পারেন, নাও হতে পারেন।

মোজাম্মেল হককে আমি বক্তিগতভাবে চিনি না। দুয়েকবার টক শোতে দেখেছি। কথা শুনে তাকে আমার ঠিক চাঁদাবাজ মনে হয়নি। তবে চেহারা দেখে বা কথা শুনে বোঝা মুশকিল কেউ চাঁদাবাজ কিনা। তবে আমার ধারণা, মোজাম্মেল হককে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও এটা আসলে অজুহাত।

গ্রেপ্তারের কারণ নিশ্চয়ই অন্য। দেশে কত বড় বড় চাঁদাবাজ বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মোজাম্মেল হকের মত চুনোপুঁটিকে মাত্র ১০ হাজার চাঁদাবাজির অভিযোগে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নেয়া হলো।

এটা ঠিক দেশে অনেক ছোটখাটো সংগঠন, যেগুলো 'দোকান' নামে পরিচিত, গড়েই উঠেছে চাঁদাবাজি-ধান্দাবাজির জন্য। সংগঠনের নামের শেষে 'লীগ' থাকলে দোকানদারিতে সুবিধা হয়। এছাড়া নামের সাথে 'মানবাধিকার' থাকলেই আমার সন্দেহ প্রবল হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতিও তেমন সংগঠন হতেই পারে। তার বিরুদ্ধে দুলাল নামে একজন পরিবহন শ্রমিক মামলা করেছেন। মামলায় অভিযোগ করেছেন, মোজাম্মেল হক তার কাছে দুই লাখ টাকা চেয়েছেন। নইলে গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে রিপোর্ট করার হুমকি দিয়েছেন। বাদী তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেনও। অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য। পত্রিকায় লিখে দেয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ ভূরি ভূরি।

কিন্তু সব গোমর ফাঁস হয়ে যায় পরদিন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাদী দুলাল আসামী মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে চেনেনই না। মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের মিরপুর শাখার দুই নেতা একটি টাইপ করা কাগজে দুলালের স্বাক্ষর নেন। সেটা দিয়েই মামলা করা হয়েছে। দুলালের স্ত্রী হাসিনা বেগম সাংবাদিকদের বলেছেন, 'মামলা দিছে শুইনা আমি বলছি, তুমি কী করছো? ঐ লোকরে পাইলে আমি মাফ চাইতাম।' কিন্তু এই গোমর ফাঁস হওয়ার আগেই পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়েছিল।

আমার ধারণা ছিল, গোমর ফাঁসের পর পুলিশ লজ্জা পেয়ে তার জামিনের বিরোধিতা করবে না। কিন্তু হলো উল্টো। পুলিশ মোজাম্মেল হককে পেশাদার চাঁদাবাজ অভিহিত করে, তার আরো ৫ দিন রিমান্ড আবেদন করে। বিচারক অনেক দয়ালু। তিনি মোজাম্মেল হককে আর রিমান্ডে না পাঠিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। বাদি আসামীকে চেনেন না, এমন এক মামলায় এখন কারাগারে মোজাম্মেল হক।

গোমর ফাঁস হয়ে গেলে পুলিশ লজ্জা পাবে, এমন ধারণা করা আমার ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ এখন পুলিশী রাষ্ট্র, তাদের আল লাজ-লজ্জার বালাই নেই। ভবিষ্যৎ ধরপাকড়ের সুবিধার্থে পুলিশ ঘটনা ঘটেনি এমন ঘটনায়ও কাল্পনিক মামলা দিয়ে রাখে। ককটেলের আওয়াজ কেউ শোনে না, কিন্তু মামলা হয় ককটেল বিস্ফোরণের। সেই মামলাময় আসামী হন মৃত ব্যক্তি বা ঘটনার সময় হজে থাকা মানুষ। বলা বাহুল্য আসামীরা সবাই বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মাফিয়া হলো পরিবহন খাত। পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকদের যে কত সংগঠন, আর তার কত শাখা-প্রশাখা আছে; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পরিবহন খাত হলো নগদ চাঁদাবাজির সবচেয়ে বড় উৎস। পরিবহন খাত মানেই কাঁচা টাকা। তাদের পৃষ্ঠপোষকেরও কমতি নেই। তাদের নেতারা মন্ত্রী হন। তারা চাইলে যখন-তখন বিনা নোটিশে ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দিতে পারেন। তাই পরিবহন মালিক বা শ্রমিকদের কেউ ঘাটাতে চায় না। তারা ইচ্ছামত গাড়ি চালাবে, ইচ্ছামত মানুষ মারবে। তাদের কিছুই বলা যাবে না।

পরিবহন মালিক শ্রমিকদের নানা সংগঠন থাকলেও যাত্রীদের সংগঠন মাত্র একটি- যাত্রী কল্যাণ সমিতি। পরিবহন নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে মিনমিন করে হলেও কথা বলছিল এই সমিতি। এখন সেই সমিতির মুখ বন্ধ করতেই তাদের মহাসচিবকে চাঁদাবাজির মামলায় কারাগারে নেয়া হয়েছে। পরিবহন খাতের চাঁদাবাজরা ঘুরে বেড়াবে, আর প্রতিবাদকারী চাঁদাবাজির মামলায় জেল খাটবে; এটাই এখন বাস্তবতা।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি ঈদ বা বড় উৎসবে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। মোজাম্মেল হক গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সংগঠনের নেতারা সাংবাদিকদের বলেছেন, এবারের ঈদের সময় বিভিন্ন মহল থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশ না করতে চাপ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও যাত্রী কল্যাণ সমিতি এবারের ঈদের পরও রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ঈদের ছুটির ১৩ দিনে দেশে ২৩৭টি দুর্ঘটনায় ২৫৯ জন মারা গেছে।

দুর্ঘটনা বাংলাদেশের নিত্যদিনের ঘটনা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরও প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়। প্রতিদিনের দুর্ঘটনা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু একসাথে ২৫৯ জনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান নির্বাচনের আগে আগে সরকারের জন্য বিব্রতকর। তাই যাত্রী কল্যাণ সমিতির মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। সোজা আঙ্গুলে ঘি না ওঠায়, আঙ্গুল বাঁকা করতে হয়েছে।

সবার দাবি ছিল সড়ক নিরাপদ করার। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। সরকারের নানা উদ্যোগ সত্বেও দুর্ঘটনা থামেনি। তারপরও সেই চেষ্টাটাই করতে হবে। মানুষের মুখ বন্ধ করে তো সমস্যার সমাধান হবে না, দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না।

provash-amin-

এইচআর/জেআইএম

সবার দাবি ছিল সড়ক নিরাপদ করার। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। সরকারের নানা উদ্যোগ সত্বেও দুর্ঘটনা থামেনি। তারপরও সেই চেষ্টাটাই করতে হবে। মানুষের মুখ বন্ধ করে তো সমস্যার সমাধান হবে না, দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।