সাংবাদিক মারলে, মরলে কিচ্ছুই হয় না!
রোকসানা ইয়াসমিন
সাল টা ২০০৭ কিংবা ০৮ হবে। নিউ এজে কাজ করি। একদিন অফিসের সিনিয়র ভাই রকিব খান পেশাগত কারণে পল্টনে ছবি তুলতে গেল, কর্মরত অবস্থায় তাকে বেদম প্রহারে শিকার হতে হল। পরে রকিব ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম যে উনাকে যখন মারছিল তখন এক পর্যায়ে উনি সাংবাদিক পরিচয়টি দেন। এটা শোনামাত্র আক্রমণকারীরা বলল, "সাংবাদিক? মার শালারে আরো কয়েকটা।"
সেই সময় আমাদের একজন জুনিয়র কলিগ নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর একজন আনসার ওকে মেরেছিল। এমনকি মেয়েটাকে রমনা থানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই চিত্র ২০১৮ সালে এসেও কি খুব একটা পাল্টেছে? এক্কেবারেই না। এইতো সেইদিন, যখন ছাত্র-ছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছিল তখন এপি, ডেইলি স্টার আর প্রথম আলোর সাংবাদিকরা কি মারটাই না খেল!!!
মারার সময় আক্রমণকারীরা যে অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিল তার মূল কথা ছিল যে সাংবাদিকদের কোন ক্ষমতা নাই, তাদের মারলে কিচ্ছুই হবে না। তারা কি খুব ভুল বলেছিল আমার কিন্ত তা মনে হয় না। এত বছর ধরে দেখে তাইতো মনে হচ্ছে। ওই সাংবাদিকের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে যেদিন সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ঘেরাও করে সাতদিনের আল্টিমেটাম দেয়, সেইদিন রাত্রেই সুবর্ণা খুন হয়।
এখন সাংবাদিকরা সুবর্ণা হত্যার বিচারও চাইছে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে। মানববন্ধন হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে। কিন্ত আদৌ এর কোন প্রতিকার পাওয়া যাবে কি? হত্যার ঘটনাটি ঘটে গত মঙ্গলবার রাতে। ওই রাতে পাবনা পৌর সদরের রাধানগর এলাকার পাওয়ার হাউসপাড়ায় সুবর্ণা নদীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সুবর্ণা নদী বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আনন্দ টিভি ও দৈনিক জাগ্রত বাংলা পত্রিকার পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ওই এলাকায় একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। মঙ্গলবার কাজ শেষে রাত ১০টার দিকে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির নিচে পৌঁছালে তিন থেকে চারজনের একদল দুর্বৃত্ত মোটরসাইকেলে করে এসে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। চিৎকার শুনে প্রতিবেশী ও স্বজনেরা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করায়।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুবর্ণাকে মৃত ঘোষণা করেন। সুবর্ণার বড় বোন চম্পা গণমাধ্যমকে বলেন, এক ব্যক্তিকে স্বামী দাবি করে সুবর্ণা নদী মামলা করেছিলেন। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এই মামলার কারণেই সুবর্ণাকে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। পুলিশ বলছে, ‘ধারণা করা হচ্ছে, পূর্ববিরোধের জের ধরে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ঘটনা তদন্ত ও হত্যাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ (সূত্র: জাগো নিউজ)
এইসব কারণে আমি আমার পরিচয় কোথাও দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা, যদিও ১৮ বছর ধরে কাজ করছি। সাংবাদিকদের সম্পর্কে অনেকেরই নেতিবাচক ধারণা। কী দরকার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে দুইটা গালি বেশি খাওয়ার? প্রশাসন মনে করে এদেরকে ম্যানেজ করা কোন ব্যাপারই না আর সাধারণ মানুষদের অনেকে মনে করে সাংবাদিকদের অল্পকিছু টাকা দিলেই নিউজ করে দেয়। কেউ কেউ এইটাও বলে সাংবাদিকদের আর পুলিশদের দুইশ টাকা দিলেই কাজ হয়ে যায়।
এই কথা বলার সৎসাহস আমার নেই যে আমি বলব তাদের এই কথার কোন ভিত্তি নেই। তারা খুব যে মিথ্যা বলে তা নয়। কিন্ত এর ব্যত্যয় যে নেই তা নয়। এখন ও অনেক সৎ সাংবাদিক আছেন যারা দেশের কথা মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই কাজ করে। তারপরও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধাচরণ এইদেশে একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই কারণেই আমি মনে করি সাংবাদিক সুবর্ণা আক্তার নদীর হত্যার বিচার হবে না। সে সাধারণ মানুষ হলে হয়ত বিচার হত। আমার এই কথা বলার নিশ্চয়ই কারণ আছে। এই দেশে কয়টা সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়েছে? দুই-একট ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ হত্যা মামলা ঝুলে আছে বছরের পর পর। আমার জানা মতে, শুধু গৌতম দাস আর ফরহাদ খান হত্যার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
কমিটি অব প্রটেক্ট জার্নালিস্টের মতে, সাগর-রুনি, হুমায়ুন কবির বালু, মানিক চন্দ্র সাহা আর শামসুর রহমানসহ অন্তত ১৩ জন সাংবাদিক ১৯৯২-২০১৮ পর্যন্ত মারা গেছে। তাদের হিসাবে এখন ও নদীর নামটা আসে নাই। তার মানে নদীসহ ১৪ জন হবে। মাছরাঙা টেলিভিশনের নিউজ এডিটর সাগর সারোয়ার আর তার স্ত্রী মেহেরুন রুনী, এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টারকে তাদের রাজাবাজারের বাসায় মৃতাবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাদের সন্তান মেঘ যখন তার বয়স ছিল মাত্র পাচঁ সেও ওই বাসায় ছিল।
হুমায়ুন কবির বালু মারা যায় ২০০৪ সালে, মানিক চন্দ্র সাহা ২০০৪ সালে, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ১৯৯৬ সালে, সাইফুল আলম মুকুল ১৯৯৮ সালে, মির ইলিয়াস হুসাইন ২০০০ সালে, নাহার আলী ২০০১, হারুনুর রশিদ ২০০২ এবং গোলাম মাহফুজ মারা যায় ২০০৫ সালে। উপরের উল্লেখিত সাংবাদিকদের বেশিরভাগই ঢাকার বাইরে থেকে কাজ করতেন। সাগর-রুনি হত্যার পর পরই সেই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনীদের গ্রেফতার করা হবে। ৪৮ ঘন্টা হতে কত বছর লাগে আমার জানা নেই!!
সাড়ে পাঁচ বছর ধরে র্যাব এই মামলাটির তদন্ত করছে কিন্ত এখনোও কোন কিনারা খুঁজে পায়নি। তদন্তকারীরা এ পর্যন্ত ৫৪ বার সময় বাড়িয়েছে। আরো বাড়াবে, সমস্যা কি!!!
সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, র্যাব যদি খুনিদের খুঁজে বের করতে না পারে, তাহলে তারা অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে তদন্তের দায়িত্বভার হস্তান্তর করুক। (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার) রুনির ভাই নওসের আলম রোমান বলেন, এটা স্পস্টই বোঝা যাচ্ছে যে, পরিকল্পিতভাবে এই ডাবল খুনের মামলাটির তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। (দ্য ডেইলি স্টার) জনকণ্ঠ এর সাংবাদিক সামসুর রহমান কে গুলি করে হত্যা করা হয় ২০০০ সালে। তারপর এখনোও তার হত্যার বিচার পায় নি। পাবে কিনা কে জানে।
সাংবাদিকদের এই দুরাবস্থার জন্য অনেক সাংবাদিকরাই দায়ী। তারা দলাদলি করতেই ব্যস্ত, তাদের নেই কোন একতা। যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে তাদেরকেই তাদের তেলবাজি করতে হয়। কারণ তাদের দরকার প্লট, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। কোন কোন সাংবাদিকের অনেক অনেক টাকা। এত টাকা কোথা থেকে আসে ভাবতেই অবাক লাগে। আর কেউ কেউ মাস শেষে ঠিকমত বেতনও পায় না। আর এই তেলবাজির কারণেই সাধারণ সাংবাদিকরা ভুগতে থাকে।
এই পর্যায়ে একটা ঘটনা মনে পড়ল। সালটা ২০০২ হবে হয়ত। তখন আমি আজকের কাগজে কাজ করি, এক্কেবারেই নবিশ। একটা সিনিয়র ভাল ছিল, কয়েক বছরের সিনিয়র হবে আমার। নামটা বলা ঠিক হবে না। উনি তখন বড়জোড় ৭-৮ হাজার টাকা বেতন পান আর আমি পেতাম ৩২০০। একদিন অফিস থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডে যাচ্ছি। শুনলাম, ওই ভাই আমাকে ডাকছে। কিন্ত আমি তাকে খুঁজে পাচ্ছিনা। এদিক-ওদিক তাকালাম। দেখি, একটা গাড়ির ভিতর বসে আছে। এগিয়ে গেলাম। উনি বললেন, 'এই গাড়িটা কিনেছি'। আমি তো অবাক, পুরাই তব্দা খাওয়া অবস্থা। পরে শুনেছিলাম, উনি তারেক জিয়ার অনেক কাছের। যদিও উনি এখন এই পেশায় নাই, দেশেও মনে হয় নাই।
এখনও শুনি এই সাংবাদিকের ফ্যামিলি বিরাট প্রভাবশালী, ওই সাংবাদিকের ফ্যামিলি তার চেয়েও বিরাট কুতুব। বিশাল বিশাল ধনী লোকজন। কয়েকবছর আগেও এরা যে এত ধনী টেরই পাইনি!!! এইযে, এখন যারা অন্যায়ভাবে সুবিধা ভোগ করছেন তাদের অবস্থা ওই বড় ভাইয়ের মত হতেও পারে আপনারা যদি তেলবাজি বন্ধ করতেন, আমাদের মত যারা ছা-পোষা সাংবাদিক তারা কিছুটা হলেও ন্যায্যতা পেতাম। অনেক মাস হল ওয়েজ বোর্ড ঝুলে আছে। কিন্ত জিনিসপত্রের দাম উপরের দিকে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
কিন্ত তারপর ও কথা থেকে যায়। সমাজের সব শ্রেণির পেশার লোকদের মধ্যে ভাল-মন্দই উভয়ই আছে। সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকের দোষ-ত্রুটি থাকতে পারে কিন্ত বেশিরভাগ এখনোও এই পেশার প্রতি, দেশের প্রতি, এই দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল।
পরিশেষে একটি কথা বলব, সাংবাদিকরাও এই দেশের নাগরিক, দেশের অন্য নাগরিকদের মত তাদেরও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস