উন্নয়ন, দুর্নীতি, বৈষম্য

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০১:৫১ পিএম, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঘুষ না দিলে কোনো সেবা খাতে সেবা মেলে না। ২০১৭ সালের খানা জরিপে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। টিআইবির জরিপ অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত খাত যথাক্রমে পাসপোর্ট ও বিআরটিএ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ৮৯ শতাংশ মানুষ কেন, ১০০ শতাংশ কেন নয়? আমারতো মনে হয়, আমার আশেপাশে যে ধরনের আলাপ-আলোচনা দেখি, তাতে শতভাগ মানুষই মনে করে সরকারি দপ্তরে কোন সেবা পেতে গেলে টাকা ছাড়া কাজ হয় না।

অনেকেই বলে থাকেন উন্নয়ন বেশি হচ্ছে, তাই দুর্নীতি বাড়ছে। এটি দুর্নীতিকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়ার চেষ্টা কিংবা দুর্নীতির পক্ষে এটি একটি রাজনৈতিক যুক্তি। অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু কত টাকা খরচ করে, কত সময়ে শেষ পর্যন্ত কি ধরনের অবকাঠামো বা সেবাখাত নির্মাণ করছি সে এক বড় বিতর্ক। অস্বীকার করার উপায় আরও নেই যে, বাংলাদেশের মানুষের আয়বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত।

আমাদের জিডিপি বাড়ছে, দারিদ্র্য কমছে, ব্যয় সক্ষমতা বাড়ছে। কিন্তু তবুও দুর্নীতি মাপার প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর হিসাব মতে, বিশ্বের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সমূহের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান বেশ পাকাপোক্ত। জরিপ করে বলে দেয়া হয়, বিশ্বের সবচেয়ে অবাসযোগ্য শহরের মধ্যে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আমাদের রাজধানী ঢাকা।

দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা সর্বত্র। গত এক দশকে আমাদের ব্যাংকিং খাতে রীতিমত ডাকাতি সংগঠিত হয়েছে। আমাদের বন উজাড় হয়ে যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা গায়েব হয়ে যায়, কয়লা হাওয়া হয়ে যায়, দেশ থেকে পাচার করে নেওয়া টাকায় আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরের নেতাদের বিদেশে হঠাৎ করে বাড়ি গাড়ির গ্রাম গড়ে উঠে। এখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে - উন্নয়ন আর দুর্নীতি কি হাতে হাত ধরে এগোবেই?

একটা সরল উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হয়। বলা হয়, উন্নয়নের পরিমাণ বাড়ায় দুর্নীতির পরিমাণ বেশি দেখায়। আরেকটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা হয় যে, দুর্নীতি হলেও দুর্নীতিবাজদের বিচারতো হচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, গণজোয়ার সৃষ্টি করে, দিন বদলের কথা বলে ক্ষমতায় যারা এলো, তাদের আমলে অর্থনীতিতে দুর্নীতি কেন বাড়বে? এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

সমস্যা হলো দুর্নীতিকে গ্রহণযোগ্য করার এই রাজনৈতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার দীর্ঘস্থায়ী খারাপ ফল কি তা নিয়ে কমই ভাবছি আমরা। খুব জটিল এক অবস্থা। এক সময় সব রকমের দুর্নীতি থেকে মুক্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলা মানুষদের কিছু বাড়তি সম্মান দিত সমাজ। সেই মানুষ আজ আর সন্মান পায়না। আজ একটা সামাজিক অনুষ্ঠান পাওয়া যায় না, যাকে প্রধান বা বিশেষ অতিথি করা হয়েছে, তার সম্পর্কে দুর্নীতি বা নৈতিক স্খলনের অভিযোগ নেই। বড় দুর্নীতিবাজরাই এখন বড় নীতি নির্ধারক।

রাষ্ট্র কিভাবে দুর্নীতির পক্ষে দাঁড়ায় তার সবশেষ দৃষ্টান্ত হলো যে, আইন করে বলে দেয়া হচ্ছে, চার্জশিট হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্ত বা কর্মচারীকে কোন কারণেই স্পর্শ করা যাবে না। তাহলে এতো আয়োজন করে একটি দুর্নীতি দমন কমিশন করার কি প্রয়োজন? শুধু ব্যক্তিখাতের দুর্নীতিবাজদের হয়রানি করার জন্য? কিন্তু দেশের মানুষতো জানে- সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ সরকারি অফিস আদালতে।

আজ এমন এক অবস্থা দাঁড়িয়েছে যেনতেন প্রকারে অতিমাত্রায় রোজগার না করতে পারলে নিজের পরিবারের মানুষজনই পাত্তা দেয় না। দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে সমাজে এমন একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে বা সমাজের নৈতিক অবস্থানকে ভেঙে দেওয়ার চক্রান্তে অনেকেই কম-বেশি শামিল হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূল্যবোধ তৈরির ব্যাপারে আমাদের সামাজিক অনীহা চোখে পড়ার মতো। প্রতিনিয়ত মাত্রাতিরিক্ত বৈভবের প্রদর্শনীকে নিয়ন্ত্রণ করার গুরুদায়িত্ব সরকারও পালন করেন না।

চার পাশের বৈষম্য এর পিছনে অনেকটা কাজ করছে। নিজেদের আশেপাশের মানুষ থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, অফিসের সহকর্মী সবার সঙ্গে নিরন্তর প্রতিযোগিতায় মগ্ন আমরা। টিআইবির নির্বাহি পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, তার ধারণা ছিল সরকারি কর্মীদের যে হারে বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি বেড়েছে তাতে দুর্নীতি কমবে। সত্যি বলতে কি এমন একটা ধারণা আমারও ছিল এবং আমি নিশ্চিত এই দর্শনের উপর ভিত্তি করেই প্রধানমন্ত্রী রাজকোষ খুলে দিয়ে রেখেছেন সরকারি লোকজনের জন্য। কিন্তু স্বভাব বদলায়নি, দুর্নীতি কমেনি।

বেতন যতই বাড়তে থাকুক, উপরি যেন না কমে – এই হলো দর্শন। অমুকের উপরি পাওনায় আরেকজন উদ্বিগ্ন, তাই তিনি প্রতিযোগিতাপরায়ণ। আর এই উপরির জোরে দেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যক্তিখাত আজ পর্যুদস্ত। যারা বেতন বেশি পাচ্ছে, তারা উপরির পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সমাজে ভোগের প্রদর্শনীও বাড়ছে। সরকারি কর্মী ও শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক বলয়ের প্রদর্শনমুখী চরম ভোগবাদের কবলে আজ গোটা দেশ।

উন্নয়ন হচ্ছে, কিস্তু সেই উন্নয়ন কাদের স্পর্শ করছে তা ভাবছি না। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু বৈষম্য যদি বাড়ে তবে তার প্রভাব নিয়ে ভাবছি না। বৈষম্যের সঙ্গে দুর্নীতির এই সম্পর্কটা নিয়ে আমরা সচরাচর কথা বলি না, কেউ বললেও থামিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্র। বলা হচ্ছে উন্নয়নের জন্য কিছুটা বৈষম্য নাকি মেনে নিতেই হবে।

তাহলে কি দাঁড়ালো অবস্থা? উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হবেই! উন্নয়ন হলে বৈষম্য মানতে হবেই! উন্নয়ন, দুর্নীতি ও বৈষম্য যদি হাতে হাত ধরে এগোয়, তবে হয়তো একটা সময় আমরা দেখবো উন্নয়নের নামে শুধু দুর্নীতিই হচ্ছে, উন্নয়নের আর দেখা মিলছে না।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

‘টিআইবির নির্বাহি পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, তার ধারণা ছিল সরকারি কর্মীদের যে হারে বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি বেড়েছে তাতে দুর্নীতি কমবে। সত্যি বলতে কি এমন একটা ধারণা আমারও ছিল এবং আমি নিশ্চিত এই দর্শনের উপর ভিত্তি করেই প্রধানমন্ত্রী রাজকোষ খুলে দিয়ে রেখেছেন সরকারি লোকজনের জন্য। কিন্তু স্বভাব বদলায়নি, দুর্নীতি কমেনি।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।