টেলিভিশন নাটকের ভবিষ্যৎ
কোনো ভাবভণিতা নয়, একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে যদি জানতে চাই, আমাদের নাটকের ভবিষ্যৎ কি? নাটকের গতিপথ কি? কেউ কি এর সহজ সমাধান বা উত্তর দিতে পারবেন। নাটক সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা কি এর সঠিক উত্তর জানেন?
আশি বা নব্বইয়ের দশকে আমাদের নাটক সম্প্রচার হত বিটিভিতে। তখন নাটক দেখার জন্য সবার উৎসাহের কমতি ছিল না। প্রতি নাটকের গল্প, অভিনয়, নাটকের আয়োজন ছিল দেখার মতো। ‘সংশপ্তক’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘রূপনগর’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’ বা ‘সবুজ ছায়া’ এইসব নাটক দেখে দর্শক শুধু মুগ্ধ হতেন তাই নয়, এইসব মননশীল নাটক থেকে আমরা অনেককিছু শিখতেও পারতাম।
এইসব নাটক দেখার জন্য একদিকে যেমন দর্শকের আগ্রহের কমতি ছিল না অপরদিকে প্রতিটি নাটক নির্মাণ করা হোত অনেক সময় ধরে। কোনো ধরনের বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যেত না। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, সেই সময়ের নাটক ছিল গল্প নির্ভর।
এই সব নাটকের কথা ছিল মানুষের মুখে মুখে। তখন শুধু বিনোদনের জন্যই নয় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও সবাই নাটক দেখতো। এরমধ্যে ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের কথা না বললেই নয়। প্রতিটি পর্ব আলাদা আলাদা দিনে দেখানো হত। নাটকের পর্ব যখন বিটিভি’তে সম্প্রচার হোত তখন রাস্তাঘাট হয়ে যেত নিরব। জনমানব শূন্য হয়ে যেত পুরো এলাকা।
সেই সময় আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, ফেরদৌসী মজুমদার, হুমায়ুন ফরীদি, গোলাম মুস্তাফা, আবুল খায়ের, সালেহ আহমেদ, খালেদ খানদের মতো বাঘা বাঘা অভিনেতারা অভিনয় করতেন। এইসব স্মৃতিময় নাটক আমাদের অতীত এবং ঐতিহ্য। সেই সময়ও ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে ঝকমকা পোশাক আর মেকআপ করে সিরিয়াল প্রচারিত হোত। আমাদের নাটকের কাছে ওইসব সিরিয়াল ফিকে হয়ে যেত।
পরবর্তী সময়ে একুশে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ধারাবাহিক ‘বন্ধন’ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। ‘বন্ধন’ সেই সময়ের আধুনিক নাটক ছিল। এইভাবেও যে নাটক হতে পারে তা ‘বন্ধন’ দেখে সবাই বুঝতে পারল। নাটক নির্মাণের জন্য আগে আলাদা করে সেট ফেলা হোত। ‘বন্ধন’ এই ধারণাটা ভেঙ্গে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই একুশে টেলিভিশন একটা ঝলক দিয়ে চলে যায়।
এরপরে ‘রমিজের আয়না’, ‘রঙের মানুষ’, ‘শান্ত কুটির’, ‘লাবণ্যপ্রভা’, ‘৫১বর্তী’ বা ‘৬৯’ এইসব নাটক দেখে দর্শকের চাহিদা বাড়তে লাগলো। প্রতিটি টেলিভিশন নিজেদের দর্শক ধরে রাখার জন্য ভালো ভালো অভিনেতা, ভালো মানের নির্মাতা দিয়ে নাটক নির্মাণ করতো। শুরু হল প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় পড়ে আস্তে আস্তে নাটকের মান একটু আধটু করে খারাপ হওয়া শুরু করলো।
একশ্রেণির স্বার্থলিপ্সু লোকজন নাটকের বাজারটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরি করলো। এই সিন্ডিকেট নাটকের গুণগত মানের কথা বিচার বিশ্লেষণ না করে নাটকের সংখ্যার কথা বিচার করা শুরু করল। এই সিন্ডিকেট দুই দিকেই কাজ করতো। অপেশাদার নির্মাতাদের দিয়ে নাটক নির্মাণ, অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে নাটকে অভিনয়, পাণ্ডুলিপি ছাড়া নাটকের গল্প বিস্তৃতি এবং সর্বোপরি সেইসব নাটক টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচার করা। এতে করে যে আমাদের কত বড় মাপের ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা আমরা এখন টের পাচ্ছি।
২.
এখন আমাদের নাটকের এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে নাটকের মান বলে কোনো শব্দ নাই, খালি নাটক হচ্ছে। এই নাটকের নাটকীয়তায় দর্শক হয়তো মুগ্ধ হচ্ছে না কিন্তু ইউটিউবে লোকজন দেখছে। আগের দিনের নাটকের মতো এইসব নাটক দর্শকের মনে দাগ কাটছে না, সময়ের সাথে সাথে এইসব নাটক হারিয়েও যাচ্ছে।
এইসব নাটকে প্রথমত কোনো গল্প থাকে না, বাজেট থাকে না, বাজেটের অভাবে অভিনয় শিল্পীদের নেয়া হয় মেপে মেপে অর্থাৎ বড় দুইজন তারকা নিলে বাবা-মা নেয়া হয় না, আশেপাশে নিজেদের লোক ধরে এনে অভিনয় করানো হয়, বাজেটের অভাবে ভালো এডিটিং করা হয় না, চিত্রগ্রাহক নেয়া হয় দুর্বল মানের, সর্বোপরি বাজেট থাকে না দেখে নাট্যকারের গল্প না নিয়ে নিজেদের মতো গল্প বানিয়ে নাটক নির্মাণ করা হয়।
এরমধ্যে এক শ্রেণির নাট্য নির্দেশক আছেন যারা গল্পকারের নাম বাদ দিয়ে নিজেদের নামে নাটক চালিয়ে দিচ্ছেন। কিছু নাট্যনির্দেশক যে ভালো নাটক নির্মাণ করছেন না তা নয়, তারা নিজেদের পকেট থেকে অর্থ গচ্ছা দিয়ে নির্ধারিত বাজেটের বেশি অর্থ খরচ করে নাটক নির্মাণ করছেন। তাদের নাটক দর্শক সমাদৃতও হচ্ছে। কিন্তু এইভাবে কয়দিন?
নাটকের জন্য গল্প হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে গল্পের উপর ভিত্তি করে গোটা নাটকটি দাঁড়াবে সেই গল্পটি যদি ভালো না হয় তবে নাটকটি গতিপথ শূন্যের দিকে আগায়। অতীতের যেসব নাটক আমাদের ঐতিহ্য সেইসব নাটকের গল্প ছিল শক্তিশালী, এর পাশাপাশি মেধাবী অভিনেতা তাঁদের অভিনয়ক্ষমতা দিয়ে তা আরো প্রাণবন্ত করে তুলতেন। আমাদের দেশে আগে যেমন মেধাবী অভিনেতা ছিলেন এখনো মেধাবী অভিনেতা আছেন। এখন অভিনেতাদের নির্দেশক কিভাবে ব্যবহার করছেন তাই হচ্ছে দেখবার বিষয়।
মানুষের জীবনযাত্রার সাথে অর্থের পরিধি ও ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। আমাদের নাটকে এই কথা একদম উল্টো। নাটকের বাজেট গত বছর যদি দুই লক্ষ টাকা থাকে, এই বছর এসে হয়ে যায় এক লক্ষ আশি হাজার বা দেড় লক্ষ টাকায়। দেড় লক্ষ টাকায় কিভাবে একটি ভালো মানের নাটক নির্মিত হয়? দুইজন বড় অভিনেতা নিলেই নাটকের মোট বাজেটের ৬০ ভাগ খরচ হয়ে যায়।
এরপর থাকে নাট্যকারের সম্মানী, মূল প্রোডাকশন খরচ, চিত্রগ্রাহকের সম্মানী, সম্পাদকের সম্মানী, সহকারী নির্দেশকের সম্মানী, রূপসজ্জা শিল্পীর সম্মানী, শিল্প নির্দেশকের সম্মানী, নাট্যনির্দেশকের সম্মানীসহ সকল কিছু। এতোকিছু কি একজন নাট্যনির্দেশক নিজের পকেট থেকে দিবেন? আর যেখানে টাকার জন্য এতো আহাজারি সেখানে ভালোমানের নাটক কিভাবে নির্মাণ সম্ভব?
৩.
আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পটি এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে। চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায় পেরিয়ে আমরা এখন এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে আমাদের চলচ্চিত্রের কোনো স্থিতাবস্থা নেই। এই শিল্পের আলো ফিরিয়ে আনতে যে পরিমাণ সু-পরিকল্পনা প্রয়োজন তা আমাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। চলচ্চিত্র শিল্পের মতো টেলিভিশন নাটক শিল্পকেও আমরা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
বাংলায় ডাব করা বিদেশি সিরিয়াল বা অনুষ্ঠান বন্ধে অনেক অভিনয় শিল্পীরা জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করলেও তার কোনো সমাধান এখনো পর্যন্ত হয়নি। মাঝে নাট্য নির্দেশকরাও কিছুটা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন যাতে তাদের সুষ্ঠু বাজেট প্রাপ্তির আশায়। যে বাজেটে নাট্যনির্দেশকরা ভালোমানের নাটক উপহার দিতে পারেন। কিন্তু সেই আন্দোলনও আর জমে উঠেনি।
সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত শিল্পী, কলাকুশলী, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশকরা যদি যথাযথ সুযোগ সুবিধা না পান তবে তারা কেন এই মাধ্যমে কাজ করবেন? কেন তারা দিনের পর দিন নিজেদের পকেটের টাকা ঢেলে এই ভালোবাসা টিকিয়ে রাখবেন? টেলিভিশন নাটককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা কি কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? এইসবের পরিবর্তন আনা অতীব জরুরি।
যদি আমরা এই শিল্পকে বাঁচাতে না পারি তবে একদিন এই শিল্পে কাজ করা সকল কলাকুশলী হারিয়ে যাবেন। হারিয়ে যাবে বাংলা টেলিভিশন নাটকের সেই অতীত, ঐতিহ্য। তখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বাধ্য হয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করে বিদেশী অনুষ্ঠান বা নাটক কিনে আনতে বাধ্য হবেন। এর থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সবারই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
[email protected]
এইচআর/এমএস