‘পুলিশকে গালি’ নৈতিকতা নয়, অশ্লীলতা!

জব্বার হোসেন
জব্বার হোসেন জব্বার হোসেন , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৭:২৭ পিএম, ০৪ আগস্ট ২০১৮

ফেসবুকে আমার বিশ্বাস নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অসামাজিক জিনিসপত্রে বোঝাই। যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে লাইভে চলে আসছে, সত্য-মিথ্যে যা খুশি বলছে। কে যে কার সঙ্গে কার ছবি যোগ করছে, বিয়োগ করছে ইয়ত্তা নেই। ফটোশপে সবই সম্ভব। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিবহন অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। অনেক কাল সড়কে যে নৈরাজ্য চলছে, অনিয়ম চলছে, অরাজকতা চলছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তারা। ওরা সাহসী, প্রতিবাদী। সততা থাকলেই কেবল লোকে সাহস দেখাতে পারে, প্রতিবাদ করতে পারে। পারে নায্যতার দাবি করতে। তারা ন্যায় বিচার চায়, সুবিচার চায়।

ওয়ান্ট জাস্টিস। তারা পোস্টার লিখে দাঁড়িয়েছে উই ওয়ান্ট জাস্টিস। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আরও কিছু পোস্টার প্লেকার্ড আমাকে দ্বন্দ্বে ফেলে।

ফেসবুক, ফেইকবুক থেকে রাজপথে, গলিপথে চোখরাখি। ফেসবুক নয়, ফটোশপ নয় ওদের অনেকেই রীতিমতো অশ্লীল সব স্লোগান লিখে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, কিন্তু পুলিশকে অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিচ্ছে। লিখিত ও মৌখিক গালি- ‘পুলিশ … টাইম নাই’, ‘ব্রিজের উপর কাউয়া, পুলিশ আমার ….’, ‘পুলিশ কোন চ্যাটের বাল’, ‘পাতার নাম পুদিনা পুলিশ তোমায় …’। এমন আরও আরও অশ্লীল সব গালাগাল। আমার রুচি, শিক্ষা, বোধ, বিবেচনা এমন অশ্লীলতা লিখতে, উচ্চারণ করতে অনুমোদন করে না।

বেপরোয়া পরিবহন দু’জন শিক্ষার্থীর প্রাণ নিয়েছে। দোষ ড্রাইভারের। ড্রাইভারের অসভ্যতার, অমানবিকতার। দোষ অনুমোদনহীন গাড়ির। দোষ বিআরটিএর। দোষ সড়ক ব্যবস্থাপনার অনিয়মের, ত্রুটির, অসততার। কিন্তু পুলিশ কেন এ ঘটনায় গালি-মন্দের শিকার হচ্ছে? টার্গেট হচ্ছে কেন পুলিশ? পুলিশতো কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্তও নয়। তবে কেন শিক্ষার্থীরা রাজারবাগে টিল ছুড়েছে? থানায় আক্রমণ করেছে? অশ্লীল, অশ্রাব্য, কুৎসিত ভাষায় খিস্তি খেউড় করছে? গালি কখনই ভালো কিছু নয়। অশ্লীলতাসব সময়ই নিন্দনীয়, পরিত্যাজ্য। প্রতিবাদের ভাষায় ‘দ্রোহ’ থাকতে হয়, গালি নয়।

ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন কোথাও কোনো আন্দোলনে ‘অশ্লীল শব্দ’ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ইয়াহিয়াকে আমরা ‘দানব’ বলেছিলাম তাও সেটা শিল্পী কামরুল হাসানের তুলিতে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভুট্টোকে তিনি সাহেব বলেছেন, পাক সেনাবাহিনীকে বলেছেন, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক। ‘ভাই’বলে ডেকেছেন। কেন? কারণ তিনি অন্যের প্রতি সম্মানবোধ, ভদ্রতা ও সততা দিয়েই মানুষের মন জয় করেছিলেন। এমন কী ধর্মেও বলা হয়েছে, অশালীন বাক্যবাজে লোকের হাতিয়ার। মনে রাখতে হবে, পুলিশ কোনো ব্যক্তি নয়, সরকারের একটি সংস্থা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, নিরাপত্তা বাহিনী। একটি প্রতিষ্ঠান বা বাহিনীর সবাই কখনও মন্দ হতে পারে না, সবাই ভালোও হতে পারে না। ভালো-মন্দ মিলিয়েই যে কোনো প্রতিষ্ঠান। আমাদের শিক্ষকদের অনেকেতো ধর্ষণ করে জেলেও গেছেন, তাই বলে কি সব শিক্ষককে ধর্ষক বলবো? কখনোই না। সম্পাদকদের অনেকে

তো যৌন হয়রানি করে চাকরি খুইয়েছেন, তাই বলে সব সম্পাদকতো যৌন নিপীড়ক নয়। যে পুলিশকে গাল দিচ্ছি সেই পুলিশ আমাদের অনেকের বাবা, অনেকের ভাই। আমাদের মায়েদের, বোনদের, মেয়েদের অনেকেই সফলতা, যোগ্যতার সঙ্গে পুলিশের চাকরি করছে। এমন গালি আমার মতে, নারী এবং পুরুষ পুলিশ সদস্যদের প্রতি যৌন হয়রানি ভিন্ন আর কিছু নয়। পুলিশকে কেবল ইউনিফর্মে দেখি। কিন্তু সেও যে ডিউটি আওয়ারের চেয়ে বেশি কাজ করে, কাজের চাপে কোনো কোনো দিন বাড়িই ফিরতে পারে না, তার সন্তানটিও যে বাবার সঙ্গে খাবে বলে অপেক্ষায় না খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, সে খবর কে রাখে।

পুলিশের কত সদস্যের পকেটে টাকা নেই, লজ্জায় বলে না। দোকানে বাকি রাখে। বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারে না ঠিক মতো। সে শহরে, সংসার গ্রামে। রাজারবাগ ব্যারাকের একচিলতে বিছানায় জীবন পার করে। শ্রম ও ঘাম দিয়ে দিনের পর দিন মানুষকে সার্ভিস দিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ২৫ মার্চের কাল রাত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে এই পুলিশেরাই সেদিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে। পুলিশের নথিতে আছে ৭৫১ জন শহীদের নাম, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে ১২৬২ জন শহীদে খবর জানা যায়। আমাদের একটি দার্শনিক দরিদ্র রয়েছে। কোনো ঘটনাকে আতশ কাঁচে ফেলে দেখি না। বিশ্লেষণে যাই না। বইয়ের যেমন শুধু কাভার ফ্ল্যাপ পড়ি, ঘটনারও কেবল ওপর থেকে দেখি, বুঝতে চাই। যে ঘটনার সঙ্গে পুলিশ কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়, সেখানে পুলিশকে টার্গেট করা হবে কেন? দেশে আগুন লাগলে সেই আগুনে আলুপোড়া দিয়ে খাবার লোকের অভাব নেই।

কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও বুঝতে হবে এই ঘটনার সুযোগ নিতে চাইছে। ইস্যু করতে চাইছে। চাইছে সংঘর্ষ হোক। সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠুক। আমাদের বিরোধী রাজনীতিবিদরা জনমানুষের আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মানুষের অধিকারের কথা না বলে তারা কেবল ক্ষমতায় যাবার পাঁয়তারা খোঁজেন। যারা ডাকলে এখন আর দশজন লোকেও একত্রিত হন না। তারাই উস্কানিদাতা। অনেকের ছবিও চলে এসেছে ইতোমধ্যে। কথোপকথনের টেপও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে‘সাবেক’ দিয়ে আবেগ ঘটিয়ে লাভ হবে না। তারা বিচ্ছিন্ন, কেবল নিজস্ব স্বার্থ অর্থ সর্বস্ব। মনে রাখতে হবে এ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক নয়। সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তার আন্দোলন। যার প্রায় সকল দাবি ইতোমধ্যে মেনেও নিয়েছে সরকার। কিছু বাস্তবায়িত, কিছু প্রক্রিয়াধীন। দাবি আদায়ের পরেও তবে শিক্ষার্থীরা কেন রাস্তায়? জাস্টিস চাইতে এসে, নিজেদের কারণে যেন ‘ইনজাস্টিস’ না হয়, অন্যায় না হয়, অশ্লীলতা না হয়। ভুলে গেলে চলবে না, আইন কিন্তু সবার জন্য সমান। জয় হোক মানবতাবাদের। জয় হোক সাম্যের, নায্যতার।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্ট

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।