আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী এবং মন্ত্রীর ‘হাসি’

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৮:৩১ এএম, ০৪ আগস্ট ২০১৮

আমার ছোটবেলায় একটা সিনেমার গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’। সিনেমার নাম ছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’। সেই সিনেমায় দেখা যায় ছোট একটি ছেলে স্কুল ছুটির পর টয়লেটে আটকিয়ে যায়। গ্রীষ্মের ছুটিতে পুরো স্কুলের শিক্ষার্থীরা যখন যার যার বাড়িতে আনন্দে সময় কাটাচ্ছে তখন সেই ছেলেটি পিপাসায় ও খাদ্যের অভাবে একটু একটু করে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ছেলেটি স্বপ্নের ঘোরে একটি গান দেখে । সেই গানটিই ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’।

গত কয়েকদিনের ঘটনায় গানটি মনে পড়ছিল খুব। আমাদের দেশটা সত্যিই দারুণ ‘শিশুবান্ধব’ হয়ে উঠেছে। এখানে পঞ্চম শ্রেণির শিশুকে বীভৎস নির্যাতনের পর হত্যা করা হচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের উপর উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাস আর সেই ঘটনার প্রতিবাদে তাদের বন্ধুরা রাস্তায় নামলে তাদের পেটানো হচ্ছে গুন্ডাবাহিনী দিয়ে। আর এসব কথা বলতে গিয়ে দাঁত কেলাচ্ছেন একজন মন্ত্রী।

পার্বত্য অঞ্চলে খুন ধর্ষণ চলছেই। এর কোন যেন শেষ নেই। আদিবাসীদের উপর এই নির্যাতনে কারও যেন কিছুই আসে যায় না। এরই সর্বশেষ সংযোজন হলো কৃত্তিকা ত্রিপুরার হত্যা। ছোট একটি শিশু। স্কুল থেকে টিফিনের সময় বাড়ি এসে আর স্কুলে ফিরে যেতে পারেনি সে। তাকে গণধর্ষণ শেষে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। কেন? কোন অপরাধে? কেন এখনও আমাদের দেশের শিশুরা এমন অরক্ষিত? কবে রাষ্ট্র পারবে শিশুর নিরাপত্তা নিশিচত করতে?

যদি প্রতিটি শিশু হত্যা ও নির্যাতনের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত তাহলে আজ কোন শিশুকে এইভাবে প্রাণ হারাতে হতো না। পাহাড়ে আইনের শাসন বলতে গেলে কিছুই নেই। জোর যার মুল্লুক তার। দরিদ্র ও অসহায় আদিবাসী শিশু ও নারীর উপর তাই চলছে অবাধ নির্যাতন। ধর্ষকরা সহজেই টাকা ও প্রতিপত্তির জোরে এড়িয়ে যাচ্ছে শাস্তি। কৃত্তিকা ত্রিপুরার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লজ্জা করে আমরা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। আর যে ঘটনা গত ক’দিনে সংবাদ পত্রে শিরোনাম হয়ে এসেছে তার কথা তো সকলেরই জানা।

ছেলেমেয়েগুলো নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে দিল সড়কের পাশে। কলেজ শেষে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছিল ওরা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বাসের অপেক্ষায়। ওদের মা-বাবা অপেক্ষায় ছিলেন, কখন ফিরবে সন্তান। ওরা ফিরেছে। লাশ হয়ে। ঢাকা বিমান বন্দর সড়কে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্টের শিক্ষার্থীরা কলেজ ছুটির পর বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল।এর মধ্যে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের উপরে উঠিয়ে দেয় বেপরোয়া চালক। মৃত্যু হয় একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া ও দ্বাদশ শ্রেণির রমিজের। ১২জন আহত হয়।
কয়েকদিন আগেই হানিফ পরিবহনের বাসের চালক, সুপারভাইজার, হেলপার মিলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পায়েলকে রীতিমতো খুন করে।

এর আগে বাস চাপায় নিভে যায় আরেক কলেজছাত্র রাজীবের জীবন। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় কারও না কারও মৃত্যু হচ্ছে। বেপরোয়া চালনা এবং ফিটনেসবিহীন পরিবহন এর জন্য দায়ী। এই ঘটনায় শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানায়। খুব স্বাভাবিক ছিল এই প্রতিবাদ। কিন্তু এই ঘটনা প্রসঙ্গে যখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান ‘হাসিমুখে’ মিডিয়ায় মন্তব্য করেন তখন আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের উপর সরকারি গুন্ডাবাহিনীর হামলা ছিল রীতমতো ন্যক্কারজনক।

একথা সকলেই জানেন যে এদেশে মানুষ খুনের কোন বিচার হয় না যদি সে খুন হয় বাস চালকের বেপরোয়া চালনায়। যদি ট্রাক চালক, বাস চালকের বেপরোয়া চালনা ও মানুষ খুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় সরকার তাহলে শুরু হয় পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট। চালক যদি বেপরোয়া চালনায় কোনো মানুষের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয় তাহলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কারণ তাহলে তারা এক হয়ে একজন খুনির জীবন বাঁচাতে সোচ্চার হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক প্রভাবের বলয়ও কাজ করে খুনির সুরক্ষায়। পরিবহন শ্রমিকদের অন্যায় ধর্মঘটে পিছন থেকে সাহস জোগান কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি। কোনো নেতার মালিকাধীন পরিবহনের চালক ধরাকে সরা জ্ঞান করে অনায়াসে। কারণ সে জানে যতই দুর্ঘটনা ঘটাক না কেন তার বেঁচে যাওয়া সুনিশ্চিত। এমন অবস্থায় মন্ত্রীর ‘হাসি’ দেখলে বুক কেঁপে ওঠে।

কিছুদিন চট্টগ্রামে চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যু হলেও চিকিৎসককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ধর্মঘটে যান চিকিৎসকরা। অশেষ দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। একটা বিষয় বুঝতে পারি না, কেন এরা খুনিদের পক্ষে দাঁড়ায়, খুনিকে ‘ওন’ করে।

এদেশে সবচেয়ে অবহেলিত ও অরক্ষিত শিশু ও কিশোর বয়সীরা। এরা নিপীড়িত, ধর্ষণের শিকার, নির্যাতনের শিকার, দুর্ঘটনার নামে খুনের শিকার। এসব অন্যায়ের বিচার কবে হবে, আদৌও হবে কিনা জানি না। এদেশের শিশু কিশোর-কিশোরীরা যেন ‘ছুটির ঘন্টা’র সেই অসহায় বালক যে তিলে তিলে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর পথে। তবুও স্বপ্ন দেশটা একদিন ওদের জন্য স্বপ্নপুরী হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কবি।

এইচআর/পিআর

কিছুদিন চট্টগ্রামে চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যু হলেও চিকিৎসককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ধর্মঘটে যান চিকিৎসকরা। অশেষ দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। একটা বিষয় বুঝতে পারি না, কেন এরা খুনিদের পক্ষে দাঁড়ায়, খুনিকে ‘ওন’ করে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।