গণপরিবহনে শনির আছর!
নদীমাতৃক আমাদের দেশে একসময় জলপথ ছিল চলাচলের প্রধানতম মাধ্যম। পাশাপাশি রেলপথেও সহজে দেশের নানাপ্রান্তে যাওয়া যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে এ দুটিপথ সংকুচিত হয়েছে। জলপথ সংকুচিত হওয়ার পেছনে রয়েছে মূলত দখল, দূষণ আর অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ। আর শোনা যায় রেলপথ সংকুচিত হওয়ার পেছনে কাজ করেছে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন। সেই সাথে গণপরিবহনের মালিকদের চক্রান্ত।
অথচ এ দুটো পথ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী যাতায়াতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ, সস্তা এবং সহজ উপায়। স্বাভাবিকভাবেই এ দুটো পথ যখন তার গতি হারিয়েছে তখন সেখানে এসে জায়গা করে নিয়েছে সড়কপথ। ফলে ধীরে ধীরে দেশের অধিকাংশ মানুষের যাতায়াতের প্রধানতম পথ হয়ে উঠেছে এটি। অথচ সড়কপথ হচ্ছে যাতায়াতের সবচেয়ে অনিরাপদ এবং ব্যয়বহুল একটা মাধ্যম।
উন্নতবিশ্বেও দেখা যায় সড়কপথে দুর্ঘটনার হার বেশি। তবে, তুলনামূলকভাবে সেখানে মৃত্যুর হার কম। পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের এ উপমহাদেশে বিশেষ করে পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে মৃত্যুর হার বেশি। বিশ্বব্যাংক এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর ফলে মৃত্যুর হারে সারাবিশ্বে পাকিস্তানের অবস্থান ৪৮তম আর এশিয়ার মধ্যে প্রথম।
অন্যদিকে, ভারতে সারাবিশ্বের সড়কপথে মোট দুর্ঘটনার ১৫ শতাংশ সংঘটিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মৃত্যুহার সাড়ে ১৮ শতাংশ এবং দুর্ঘটনার হার সাড়ে আট শতাংশ করে বাড়ছে। (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক,১৮ মার্চ, ২০১৮)
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের দেশে সাত হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে । ( সূত্র: বিডিনিউজ২৪.কম, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮) । এ সকল মৃত্যুর পেছনে মূলত চালকের অসতর্কতা, বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতি, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, নিয়ম না মানা, যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়কের ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ মূলত দায়ী।
তবে, সাম্প্রতিককালে একটা অবাক করা ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, গণপরিবহনের চালকদের বেপরোয়া মনোভাব সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। একে তাই দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলাই ভালো।
রাজীবের মৃত্যুর পেছনেও কাজ করেছিলো দুই বাসের চালকের বেপরোয়া মনোভাব। নুরুল আমিন, রাসেলের পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সাইদুর রহমানের নাম। তিনি চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিলেন হানিফ পরিবহনের বাসে।
এটা কিন্তু মুড়ির টিন মার্কা লক্কর ঝক্কর গাড়ি নয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভলবো বাস। এসব বাসের চালক, সুপারভাইজাররা লোকাল গাড়ির চালক, সুপারভাইজারদের মতো একদম নিরক্ষর নয়। বরং এদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে যাত্রীদের সুযোগ সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখতে। অথচ, এরাই কিনা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করলো সাইদুরকে?
সাইদুরের অপরাধ কী ছিলো? ওর অপরাধ ছিলো যানজটে গাড়ি আটকে আছে দেখে নিচে নেমেছিলো প্রাকৃতিক কাজের জন্য সাড়া দিতে। এর মধ্যে যানজট কমে গেলে ভলবো গাড়িটিও এগোতে শুরু করে। সাইদুর তখন দৌড়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে গাড়ির দরজায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
তার নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। সে অবস্থায় কোথায় তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে শুশ্রূষা করবে বাসের সুপারভাইজার, হেলপার!! না, তা তো করলোই না বরং তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া সাইদুরকে তারা ধরাধরি করে নদীতে ফেলে দিয়ে ঢাকার পথে রওনা হলো।
ভাবা যায় একবার? এমন নির্দয় কাজ কেমনে ওরা করতে পারলো? সাইদুরের বন্ধুরা যখন সুপারভাইজারকে ওর কথা জিজ্ঞাসা করেছে তখন ঠাণ্ডা মাথায় সে বলেছে যে সাইদুর গাড়ি থেকে নেমে গেছে। তাকে ডাকলেও আর নাকি গাড়িতে ওঠেনি। পরদিন যখন সুপারভাইজারের সাথে সাইদুরের পরিবারের লোকজন ফোনে কথা বলেছে তখনও সে নির্বিকারভাবে মিথ্যা বলে গেছে।
অবশ্য তার এ ভালোমানুষিভাব কাজে আসেনি। কারণ পুলিশ তাদের যথাযথ কাজটি দ্রুততার সাথে করে ফেলেছে। হত্যাকারী হিসেবে বাসের সুপারভাইজার, চালক এবং হেলপারকে চিহ্নিত করেছে। তারা এখন পুলিশের হাতে। শেষ অবধি বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার ফলে এমন হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষে তার বাস্তবায়ন হতে কত বছর লাগবে তা অবশ্য আমরা কেউ জানি না।
যদি গণপরিবহনে কর্মরত কর্মীদের এমন বেপরোয়া মনোভাবের ফলে ঘটে যাওয়া আগের দুর্ঘটনাগুলোকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হতো তাহলে হয়ত এর লাগাম টেনে ধরা যেতো। সেটা না হওয়াতেই হয়তো হানিফের ভলবো বাসে কর্মরত গণপরিবহন কর্মীরা সাইদুরকে এমন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার সাহস করেছে। অভিযোগ আছে, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পরে এ হানিফ পরিবহনই নাকি দুর্বৃত্তদেরকে ঢাকা ছাড়তে সহযোগিতা করেছিলো।
পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকদের কাছে যাত্রীরা সবসময়ই অসহায় ছিলো। দিন দিন মনে হয় তার মাত্রা বাড়ছে। এ নিয়ে তেমন কোনো প্রকার তদারকি সাদা চোখে দৃশ্যমান হয় না। অথচ রেলপথ এবং জলপথকে যদি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া যেতো তাহলে গণপরিবহনে এমন নৈরাজ্য কখনই চলতে পারতো না।
তাই সময় এসেছে নদী ও রেলপথকে সচল এবং আরো কর্মক্ষম রাখা। তাহলেই হয়ত যাত্রীরা গণপরিবহনের শ্রমিকদের দ্বারা সংগঠিত এমন ইচ্ছাকৃত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। সেটা যতদিন না হচ্ছে ততদিন হয়ত কপালে লেগে থাকে শনির দশা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে না।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/জেআইএম