কয়লায় সোনা-দানা ধামাচাপা

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:১৯ এএম, ২৫ জুলাই ২০১৮

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা চুরি, ভল্টে রাখা স্বর্ণের গরমিলের পর সামনে এলো কয়লা চুরির ঘটনা। দানার পর সোনা। এখন কয়লা। ছেলে ভোলানো গল্প, ব্যাখ্যা, সার্কাস। পকেট, পোটলা বা ব্যাগে ঢুকিয়ে বড়পুকুরিয়া খনির ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা চুরি করা হয়নি। তা নিশ্চয় দু’চারদিনেও সম্ভব হয়নি। গায়েব হয়ে যাওয়া এ কয়লার দাম অন্তত ২২৭ কোটি টাকা। হিন্দি সিরিয়ালেও এতো অ্যাপিসোড দেখা যায় না। সার্কাসকে হার মানানোর মতো আবার রাজধানীতে গুপ্তধনের খোঁজে খোঁড়াখুঁড়ি।

শঙ্কার মধ্যেই রবিবার রাতে কয়লা সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে গেল বড়পুকরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ। এর পরিণাম সইছে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চল। আগামী একমাস রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। নিয়তির অমোঘ বিধানের মতো তা মেনে নেয়া ছাড়া মানুষের এখন বিকল্প কিছু নেই। সরকারের তরফ থেকে মানুষকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, শক্ত বিচার হবে। জোর তদন্ত চলছে।

চুরি-চামারির সার্কাস ধামাকায় এক সময় কথায় কথায় শোনানো হতো বিদ্যুতের সিস্টেম লসের কথা। চুরি না বলে ইংরেজি তরজমায় সিস্টেম লস শব্দ রপ্ত করানো হয়েছে মানুষকে। অবৈধ সংযোগ বা মিটার রিডিংয়ে চুরির কারণ যে বিদ্যুৎ সরকারি খাতায় যোগ হতো না, সেগুলোকে উৎপাদন হিসাবের সাথে গুলিয়ে ফেলার নামই সিস্টেম লস। বিভাগের প্রধান থেকে শুরু করে মিটার রিডার পর্যন্ত এই ডাকাতদলের সদস্য। লুটের আখড়ার ভাগীদার। গোটা বিভাগটাই চোরের খনি। ছাই চুরি করে পকেটে ঢুকাতেও তাদের বাধে না।

ঘটনাচক্রে এবার চোরের খনি মিললো কয়লা খনির ভেতর। মাত্রাটা ব্যাপক না হলে হয়তো তা ধরা পড়তো না। মানুষও জানতো না। এ ঘটনায় কোম্পানির অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উদ্দিন আহমদ এ দায়িত্ব পান ১৫ মাস আগে। কয়লাগুলো গেলো কোথায়? এ প্রশ্নের আজব জবাব দিয়েছেন তিনি। তার জবাব শুনে বিদ্যুতের সেই সিস্টেম লসের কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি বলেছেন, ‘২০০৫ সাল থেকে এপর্যন্ত এককোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়। খোলা আকাশে নিচে কয়লা রাখা হয়। এতে সিস্টেম লস অর্থাৎ রোদে শুকিয়ে, পানিতে ধুয়ে, বাতাসে উড়ে, মাটিতে মিশে অনেক কয়লা নষ্ট হয়েছে। যে অভিযোগ উঠেছে, তা কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না। মাশাল্লাহ মাপের জবাব। এতোবড়ো চুরি প্রমাণ করা যাবে না, সেই আগাম ইঙ্গিত রয়েছে তার জবাবে।

কয়লা খনি এবং সংরক্ষণ ডিপোকে ঘিরে রয়েছে ‘কঠোর নিরাপত্তা’ ব্যবস্থা। এটি হাই সিকিউরড জোন। সেখান থেকে ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গুম হয়ে গেলো। কেউ কিছু দেখলেন না, জানলেন না। জানালেনও না। আজব কাণ্ড! প্রচলিত গুমের গল্পের স্ক্রিপ্টও এখানে মানুষকে খাওয়ানো যাবে না। কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশে কোনো গুম হচ্ছে না। প্রেমে ও ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে নানানজন নানান দিকে চলে যাচ্ছে। আমরা তাদের এনে হাজির করছি।’

বচন কী চমৎকার! মানুষ নানান দিকে চলে যাচ্ছে এবং পুলিশ তাদের খুঁজে আনছে। এখন তো কয়লা খোঁজার পালা। কয়লা কোন দিকে গেল? কার সঙ্গে গেল? কে নিল? কে খুঁজে আনবে? কয়লা জড় পদার্থ। কেউ না কেই কোনো পরিবহণেই নিয়ে গেছে। ট্রাকে হলে ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা পরিবহনের জন্যে প্রতি ট্রাকে ৫ টন করে হলেও, কমপক্ষে ২৮ হাজার ট্রাক লেগেছে। একটা ট্রাকও কেউ দেখলো না? কোথাও ভুলেও ধরা পড়লো না?

কয়লা কেসের আগে তথ্যবাজার গরম ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে সোনা গায়েব বা হিসাবে গরমিলের খবরে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার থেকে দাবি করা হয়েছে, সোনা ঠিকই আছে। ঘরের সোনা ঘরেই আছে। আবার বলা হয়েছে, কেউ দায়ী হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সোনা যদি ঠিকই থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে কেন? কেন কাউকে ছাড় দেয়া-না দেয়ার হুঁশিয়ারি? আজবের পর আজব সব কথাবার্তা। সোনার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দানাও চুরি হয়েছে। কয়লার ঘটনায় সোনা-দানার ইস্যু কিছুটা তলিয়ে গেছে।

সোনায় গরমিলের ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা চলে ছয় মাস ধরে। চাপা পড়ে গিয়েছিলও। তা ভণ্ডুল হয়ে যায় কয়েকদিন আগে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা খেই হারিয়ে তড়িঘড়ি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলে, সোনা ঠিক আছে। মাপজোখে ভুল হয়েছে। নথিভুক্ত করতে বাংলা-ইংরেজি লেখার কারণে ত্রুটি হতে পারে। গল্প শুনতে পছন্দ করা মানুষের বৈশিষ্ট্যগত বিষয়। বাচ্চারা তা আরেকটু বেশিই পছন্দ করে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা প্রায় এক টন স্বর্ণ কেলেঙ্কারি নিয়ে দেয়া ব্যাখ্যা শিশুদেরকে মাদের শোনানো রূপকথা গল্পকেও পেছনে ফেলে দেয়ার মতো। বিভিন্ন সময়ে আটককৃত স্বর্ণ যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা হয়, সেগুলো নিয়েও বিভিন্ন মহলে টেনশন চলছে। তারা নিশ্চিৎ নন, সেগুলো ঠিক আছে কি-না?

বাংলাদেশ ব্যাংক নামের প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের একমাত্র কাস্টডিয়ান বা হেফাজতকারী। অথচ এই আমানতকারী একের পর এক খেয়ানতকারীর ভূমিকায়। সেখান থেকে রিজার্ভ চুরি, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংক, জনতা ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা গায়েব ও দুর্নীতির কোনো বিহিত আজও হয়নি। প্রসঙ্গ এলেই হয়েছে-হচ্ছে শুধু কথামালা।

হ্যাকিং করে রিজার্ভ চুরির ঘটনার পূর্ণ তদন্ত এখনো হয়নি। পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা কোনোদিন উদ্ধার হবে কি-না, সেই আলোচনা তো বহুদূরের ব্যাপার। দু’বছর আগে ২০১৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয় ৮১ কোটি ডলার। এরপরের পর্ব ব্যাংকটির ভল্টে গচ্ছিত কিছু স্বর্ণের পরিমাণ ও ধরন বদলে যাওয়ার তেলেসমাতি।

দেশের এবং অন্যের সম্পদ হরণ, দখল, আত্মসাতের এই দুর্বৃত্তায়ন আমাদের সৌন্দর্য্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে যেতে বসেছে। এ শ্রেণির দুর্বৃত্তরা এখন সম্পদ শুধু হরণই করে না, একে একে ধ্বংস করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোও। রাষ্ট্র তাদের প্রতিপক্ষ না হয়ে কখনো কখনো সহায়কের ভূমিকায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির বিহিত না হওয়ায় জনমনে এমন ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক। সরকারি ব্যাংক চলছে খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়ে। এ ব্যাংকগুলোকে জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে এই ব্যাংকগুলোকে কতদিন সরকার বাঁচিয়ে রাখবে সে এক বড় প্রশ্ন। এর মধ্যে আরো নতুন ব্যাংকের অনুমতি দিতে যাচ্ছে সরকার। সরকারি এ মানসিকতা তথা আস্কারায় ক্ষমতাধরদের মধ্যে আরো ক্ষমতাবান হওয়ার মোহ চেপেছে।

এ সংস্কৃতির জেরে এখন যোগ হলো সোনা, কয়লা। ময়লাই বা বাদ থাকবে কেন? ঝুট-বর্জ্য, নদীর বালি নিয়ে বাণিজ্যের টুকটাক খবরও রয়েছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে খুনাখুনিও হচ্ছে। এর মাঝেই যোগ হলো গুপ্তধনের তালাশ। একটার চাপে আরেকটা ঢাকা পড়ছে। ‘গুপ্ত ধন আছে’- কেউ একজন জানালেন পুলিশকে। নিরাপত্তাহীনতার মুখে বাড়ির মালিকও জিডি করলেন থানায়। অনুসন্ধান করে দেখতে বললেন। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট মিলে বাড়িতে খোঁড়াখুঁড়ি। এলাহি কাণ্ড।

দুটি রুমে চার ফুট খুঁড়ে গুপ্তধনের সন্ধান মেলেনি। বাড়ির ভিত শক্ত না হওয়ায় খোঁড়া বন্ধ। বলা হলো, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করা হবে না খুঁড়ে গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়ার উপায় আছে কি না। এই যুগে এই সময়ে ঢাকা শহরে দু'টি জিডির ভিত্তিতে পুলিশের নেতৃত্বে গুপ্তধন অভিযান। সার্কাসও ফেল। একজন মানুষের বসত বাড়ির রুম খোঁড়াখুঁড়ি করার আগে কি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটু জেনে নেয়া যেত না? বাড়িটা ক্ষমতবান কোনো রাজনীতিক বা বিত্তবানের হলে কি পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের এমন খনন অভিযান চলতো?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর

একজন মানুষের বসত বাড়ির রুম খোঁড়াখুঁড়ি করার আগে কি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটু জেনে নেয়া যেত না? বাড়িটা ক্ষমতবান কোনো রাজনীতিক বা বিত্তবানের হলে কি পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের এমন খনন অভিযান চলতো?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।