ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১২:৩৭ পিএম, ২৩ জুলাই ২০১৮

অনেকেই চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যৌক্তিক অভিহিত করে তাতে সমর্থন দিচ্ছেন। আমি তাদের সাথে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলছি, আমি বরাবরই প্রবলভাবে কোটার পক্ষের মানুষ। ২০১৩ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই আমি নৈতিকভাবে এর বিরুদ্ধে আমার অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে এসেছি।

৫৫ ভাগ কোটা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমিও কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিলাম। যেটুকু চেয়েছিলাম তা হয়ে গেছে। কোটায় লোক পাওয়া না গেলে সাধারণ তালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে, মানে কোটার জন্য কোনো পদ শূন্য থাকবে না। এই সংস্কারের পর আমার আর কিছু চাইবার নেই। আমি বরং ৫৫ ভাগের সাথে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য অল্প হলেও কোটা রাখার পক্ষে।

কোটার জন্য পদ শূন্য রাখা হবে না, এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর কোনো কোনো বিসিএস'এ কোটা ২৫ ভাগে পর্যন্ত নেমে এসেছে। এর বেশি আমি আমার কিছু চাইবার নেই। আন্দোলনকারীরা মুখে কোটার বাতিল নয়, সংস্কার চান। কিন্তু তারা ৫৫ ভাগ কোটাকে ১০ ভাগে নামিয়ে আনার দাবি করছেন। ৫৫ ভাগকে ১০ ভাগে নামিয়ে আনতে চাওয়া আসলে সংস্কার নয়, বাতিল চাওয়ারই নামান্তর। তবে কোটা বাতিল বা সংস্কার নয়; এই আন্দোলনের মূল টার্গেট মুক্তিযুদ্ধ।

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে দারুণ বিকাশ ঘটে তার পাল্টা হিসেবেই কোটাবিরোধী আন্দোলনকে মাঠে নামানো হয়েছে এবং তারা দারুণ সফল। কয়েক মাস আগে যে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে লাখো মানুষ রাত জেগেছে; সেই শাহবাগেই মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করে স্লোগান দেয়া হয়েছে। স্লোগানটা আমি শুনেছি। কিন্তু এখানে লেখার মত সাহস আমার নেই। যতবার ভাবি স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের চরম অপমান করে স্লোগান দেয়া হয়েছে, ততবার রাগে আমার গা জ্বলে।

মতিয়া চৌধুরীর খন্ডিত বক্তব্যকে পুঁজি করে কোটা আন্দোলনে তরুণরা গায়ে 'আমি রাজাকার' লিখে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজপথে নির্লজ্জের মত দাঁড়িয়ে থাকে, রাগে আমার গা জ্বলে যায়। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অপমান যে আন্দোলন থেকে করা হয়, নৈতিকভাবে সে আন্দোলনের পাশে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যা বলছিলাম, কোটা বাতিল বা সংস্কার নয়; খালি মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে দিন, আন্দোলনকারীরা বিজয় মিছিল করে ঘরে ফিরে যাবে। জেলা,নারী, আদিবাসী কোটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

তবে অনেককেই দেখি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঢালাওভাবে জামায়াত-শিবির বলে কোনঠাসা করতে চান। এটা একটা বড় ভুল। শুরুটা হয়তো কোনো ধুরন্ধর স্বাধীনতা বিরোধীর মাথা থেকেই হয়েছে। তবে এখন এই আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই বেশি। বাম ঘরানার কর্মীরাই আন্দোলনে বেশি সক্রিয়। আমাদের দেশে একটা প্রবণতা আছে, সরকার বিরোধী কোনো আন্দোলন পেলেই তেলে-জলে মিলে তার পাশে দাঁড়ানোর।

আমার বামপন্থী বন্ধুরা যে আন্দোলনকে বেগবান করছেন,তারা কি একবারও মুক্তিযুদ্ধের অবমাননটা দেখেননি? বিএনপির বন্ধুরাও দেখি আন্দোলনের পাশে। আচ্ছা কোটা তো শেখ হাসিনা চালু করেননি, ৭২ সাল থেকেই চালু আছে। তো বিএনপি তো দফায় দফায় ক্ষমতায় ছিল। তখন তারা এই ঘৃণিত কোটা ব্যবস্থা বাতিল করেনি কেন? আগুন লাগলে তাতে আলু পুড়ে খাওয়ার লোকের অভাব নেই।

শুধু মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করছে বলেই যে আমি এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে তা নয়, আন্দোলনটিও আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে যতদিন বৈষম্য থাকবে, ততদিন কোটা ব্যবস্থাও থাকবে। কোটা বৈষম্য সৃষ্টি করে না, দূর করে। অনেকেই এ আন্দোলনকে অতীতের অনেক মহৎ ছাত্র আন্দোলনের সাথে তুলনা করছেন। কিন্তু বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলছি, এটি নিছকই ব্যক্তি স্বার্থের আন্দোলন। তোমাকে চাকরি না দিয়ে আমাকে দিতে হবে, এটাই হলো এই আন্দোলনের মূল সুর।

এমন তো নয় যে, দাবি আদায় হলে দেশে চাকরির সংখ্যা বেড়ে যাবে। এখন যদি ১০ জন চাকরি পায়, কোটা সংস্কার হলেও ১০ জনই চাকরি পাবে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরীরা একটু অগ্রাধিকার পায়, দাবি আদায় হলে কম পাবে। এই তো পার্থক্য! এমন ব্যক্তিস্বার্থের আন্দোলনের সাথে নৈতিকভাবে থাকার কোনো সুযোগ নেই।

আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের সম্পৃক্ত করতে এবং বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন পেতে কিছু চটকদার কথা বলা হয়। কোটার কারণে নাকি বৈষম্য সৃষ্টি হয়, মেধাবীরা বঞ্চিত হয়। প্রথম কথা হলো,বৈষম্য সৃষ্টি করতে নয়, কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে বৈষম্য দূর করতে। আর মেধার প্রশ্নটাই সবচেয়ে হাস্যকর। দাবি শুনে মনে হয়, কোটার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অশিক্ষিত ছেলেপুলেরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। একটা বিষয় পরিষ্কার, কোটায় চাকরি পেতে হলেও সবাইকে মেধা যাচাইয়ের ন্যূনতম ধাপগুলো অতিক্রম করে যেতে হয়।

নৈতিকভাবে আন্দোলনের পক্ষে না থাকলেও আন্দোলনকারীদের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। বয়সের কারণে হয়তো তারা ন্যায্যতার প্রশ্নটা বুঝতে পারছে না, কিন্তু তারা তো খুব অন্যায় কোনো দাবি করেনি। পড়াশোনা শেষে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি চেয়েছে। তাদের বয়সে হলে আমিও হয়তো কোটার ন্যায়-অন্যায়টা বুঝতে পারতাম না। হতে পারে, আমিও এই আন্দোলনের সামনের কাতারেই থাকতাম। এমনকি এবার শুরুর দিকে ছাত্রলীগের অনেকেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিল। ছাত্ররা হয়তো অবুঝের মত আন্দোলন করছে। কিন্তু সরকারকেও কেন তা অবুঝের মত দমন করতে হবে।

শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে বদলে দেয়ার দায় অনেকটাই পুলিশ আর ছাত্রলীগের। এপ্রিল মাসে পুলিশ আন্দোলনের সলতেতে প্রথম আগুন দিয়েছে আর জুলাইয়ে ছাত্রলীগ সে আগুনে ঘি ঢেলেছে। আমার ধারণা, পুলিশ যদি ৮ এপ্রিল আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা না চালাতো তাহলেই পানি এতদূর গড়াতো না। আমি আন্দোলনের সমর্থক না হতে পারি। কিন্তু তাদের দাবি জানানোর, সেই দাবির পক্ষে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তাদের সেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে আমার অবস্থান। যারা ভিসির বাসায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে, তাদের বিচার হতেই হবে। কিন্তু আন্দোলন করার কারণে তুলে নেয়া, গ্রেপ্তার রিমান্ড, হয়রানি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আন্দোলন করা কখনোই অপরাধ নয়। এপ্রিলে আন্দোলন দমনে সরকার পুলিশকে মাঠে নামিয়েছে আর এবার মাঠে নামিয়েছে ছাত্রলীগকে। ছাত্রলীগ ঢাকা, রাজশাহী, হাতুরি নিয়ে, লাঠি নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ছাত্রলীগ শুধু আন্দোলনকারীদের পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, শিক্ষকদের ওপরও হামলা চালিয়েছে। ছাত্রলীগের হুমকির মুখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ক্যাম্পাসে আসতে পারছে না।

আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুকে লেখালেখির অপরাধে চট্টগ্রাম ভেটেরেনারি ইনস্টিউট থেকে এক ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছে। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, কোটা সংস্কারের পক্ষে বলাই এখন বাংলাদেশে অপরাধ। বললেই জামায়াত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার কাছে আন্দোলনটিকে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু আমার মনে হওয়াই তো শেষ কথা নয়। গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবেই। যারা আন্দোলন করছেন বা আন্দোলনের পক্ষে বলছেন; তাদের কাছে নিশ্চয়ই দাবিটা যৌক্তিক মনে হচ্ছে। পিটিয়ে যে আন্দোলন দমন করা যায় না, এটা ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো করে আর কে জানে।

হামলা করে হয়তো আন্দোলনের আগুনে ছাইচাপা দেয়া যাবে, নেভানো যাবে না। বরং বারবার হামলা করে আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আরো বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি বলছি না, আন্দোলনের মুখে তাদের অন্যায় দাবি মেনে নিতে হবে। বরং প্রধানমন্ত্রী যখন অনেকটা অভিমান করে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখনও আমি এর প্রতিবাদ করেছি। জোরালো আন্দোলন হলেই অন্যায্য দাবি ন্যায্য হয়ে যায় না। বরং আমি দাবি করছি, কোটায় লোক পাওয়া না গেলে সাধারণ তালিকা থেকে লোক নেয়া হবে, এই শর্তে ৫৫ ভাগ কোটাই বহাল থাকুক।

তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না, জয় করতে হবে ভালোবেসে। পড়াশোনা শেষে চাকরি না পাওয়া তারুণ্যের দগদগে ক্ষতে হাতুড়ির আঘাত না করে মমতার পরশ বোলানো হোক। সচিব কমিটি তাদের কাজ করুক। পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে একটা কমিটি আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলুক। তাদের পিঠে সান্তনার হাত রাখুক। তরুণ প্রজন্ম তো সরকারের প্রতিপক্ষ নয়। তাদের জোর করে প্রতিপক্ষ বানাতে হবে কেন?

যারা ভিসির বাসায় হামলা করেছে, চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু স্রেফ আন্দোলন করা বা আন্দোলন সমর্থন করার কারণে যেন কেউ হয়রানির শিকার না হয়।

provash

এইচআর/জেআইএম

যারা ভিসির বাসায় হামলা করেছে, চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু স্রেফ আন্দোলন করা বা আন্দোলন সমর্থন করার কারণে যেন কেউ হয়রানির শিকার না হয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।