রিজার্ভ চুরি, স্বর্ণ বিতর্ক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০১:০২ পিএম, ২১ জুলাই ২০১৮

 

আবার আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক। হ্যাকিং করে রিজার্ভ চুরির ঘটনার পূর্ণ তদন্ত এখনো হয়নি, এখনো জনমন সন্দেহের মধ্যে আছে, পাচার হওয়া এতগুলো টাকা কোনদিন উদ্ধার হবে কিনা।

দুই বছর আগে ২০১৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মূল্যবান ৮১ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিয়েছিল। সে অর্থের সামান্য অংশ পুনরুদ্ধার হলেও বাকিটা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই কমে আসছে। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত কিছু স্বর্ণের পরিমাণ ও ধরন বদলে গেছে বলে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়েছে।

খবরটি পড়ে প্রায় সব মানুষই আঁতকে উঠেছে। সবার মনে প্রশ্ন, কি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে, যেই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের একমাত্র কাস্টডিয়ান বা আমানতকারী। শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আবারও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ সংরক্ষণের দক্ষতা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

স্পর্শকাতর এ বিষয়টি সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস করি। উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করে ভল্টকে আরও আধুনিকতর এবং অধিকতর নিরাপদ করা যায় কিনা, তা বাংলাদেশ ব্যাংক পরীক্ষা করে দেখতে পারে।

আর সোনাসংক্রান্ত এ বিতর্কটি একটি নিরপেক্ষ তদন্ত দলের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে জনসমক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করে জনমনে স্বস্তি আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সামান্যতম সংশয় বা সন্দেহ থাকলে সেটা যেন দূরীভূত হয়, যদি কোন গাফিলতি ঘটে থাকে, ঘুণাক্ষরেও ঘটে থাকে, সেটা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের।

তবে সামগ্রিকভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। মার্কিন রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা যেমন দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনায়, তেমনি আলোচনায় হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি।

নতুন করে আলোচনায় ফারমার্স ব্যাংক আর ব্যাংকিং খাতে মালিক নামের উদ্যোক্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সরকারি ব্যাংকগুলো রুগ্ণ, বেসরকারি ব্যাংকগুলো মালিকদের খপ্পরে। চেয়ারম্যানের নির্দেশের বাইরে এমডি-ডিএমডি কেউ যেতে পারেন না।

এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের মেয়াদ টানা ৯ বছর এবং একই পরিবার থেকে ৪ জন পরিচালক করার সুযোগ সৃষ্টিকে আরো অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন খাত সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে খাতটিতে সুশাসনের ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট থাকবে না।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন ঘাটতি পূরণে অনেক টাকা দেয়া হয়েছে। জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে এই ব্যাংকগুলোকে কতদিন সরকার বাঁচিয়ে রাখবে সে এক বড় প্রশ্ন। এর মধ্যে আরো তিনটি ব্যাংকের অনুমতি দিতে যাচ্ছে সরকার। ছোট এই দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০ হতে যাচ্ছে। সুশাসনের ঘাটতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ঋণ ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতির কারণে ব্যাংকিং খাতে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।

সবার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বোর্ডকে বোঝাতে হবে। তবে এ কথা সবাই জানে যে পরিচালনা পর্ষদ ঠিক না হলে ব্যাংকের মূলধন রক্ষা করা যাবে না। এক্ষেত্রে বোর্ডের অনেক কিছু করার রয়েছে অথচ সরকার সেই পরিচালনা পর্ষদকেই পরিবারকেন্দ্রিক করতে চলেছে।

সরকারি ব্যাংক চলছে খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়ে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংকের বোর্ড ও সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে নানা উদ্যোগের কথা বলে। কিন্তু যে কথা বলে না তাহলো, কোনো একক ব্যক্তি বিশেষের হাতে যে প্রায় পুরো ব্যাংকিং খাতটাই বন্দি হয়ে যাচ্ছ।

আর্থিক খাতের এই চিত্র দেশ থেকে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অসমতা দূরীকরণ প্রক্রিয়াকে দুরূহ করে তুলছে। অন্যের সম্পদ গ্রহণ, অধিগ্রহণ, হরণ, দখল, বেদখল, আত্মসাতের মাধ্যমে দুর্বৃত্তায়ন হয়। দুর্বৃত্তরা সমাজের মোট সম্পদ শুধু হরণই করে না, প্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংস করে দেয়।

এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির সহযোগিতায় ক্ষমতাধররা অধিকতর ক্ষমতাবান হয় আর ক্ষমতাহীন দরিদ্রের অক্ষমতা কেবলই বাড়তে থাকে। দুর্বৃত্ত-লুটেরাদের সঙ্গে বাজার-অর্থনীতি-রাজনীতি-সরকারের সমস্বার্থের সম্মিলনই যেন চারদিকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আর্থিক খাতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাবই দুর্নীতির বড় কারণ। ব্যাংক কর্মকর্তারা না চাইলেও অনেক সময় অনিয়মের সঙ্গে আপস করতে হয় রাজনৈতিক চাপের কারণে। ঋণ পাওয়ার যোগ্য না হলেও ঋণ দিতে বাধ্য হয় ব্যাংক, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংক। সব সরকারের আমলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে দলীয় লোকদের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসানোর কারণে এ ব্যাংকগুলোতে সবসময়ই দুর্নীতির প্রকোপ থাকে বেশি। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে আর্থিক খাতে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও অসহায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অনিয়মে কিছুই করার থাকে না বাংলাদেশ ব্যাংকের। সেখানে মূল আধিপত্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের। একজন সচিবের নেতৃত্বে এই বিভাগ হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ও ব্যাংকিং জগতে সুশাসনের প্রধান অন্তরায়।

বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে ব্যাংক বর্তমানে আর শক্ত ভিত্তির ওপর নেই। পুরনো ব্যাংকের সঙ্গে আরো কিছু নতুন ব্যাংক যুক্ত হয়েছে গত কয়েক বছরে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে তাতে ব্যাংকগুলোতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হতে পারে সহসাই, যা কেউ চান না।

ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন নিয়মকানুন সঠিকভাবে পরিপালন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত কর্তৃত্ব দেখতে চায় মানুষ।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

‘আর্থিক খাতের এই চিত্র দেশ থেকে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অসমতা দূরীকরণ প্রক্রিয়াকে দুরূহ করে তুলছে। অন্যের সম্পদ গ্রহণ, অধিগ্রহণ, হরণ, দখল, বেদখল, আত্মসাতের মাধ্যমে দুর্বৃত্তায়ন হয়। দুর্বৃত্তরা সমাজের মোট সম্পদ শুধু হরণই করে না, প্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংস করে দেয়। ’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।