নাসিমা খান মন্টি : নারীর জন্য কঠিন সাংবাদিকতা
সাংবাদিকতা যে কোনো দেশেই এখন ভয়াবহ পেশায় পরিণত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা ভারত বলে কথা নেই, উন্নত দেশেও এ সময়ে সাংবাদিকতা এক ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একথাও সত্য যে, একেবারে শুরু থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কারণ সত্য প্রকাশ বা তুলে ধরাটা ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়, ফলে অনিবার্য বিরোধের জের ধরে সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের ওপর নেমে আসা খড়্গ-এর নিবৃতি এ কালেও সম্ভব হয়নি।
কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পাকিস্তান আমলের ভয়াবহতা পার হয়ে নতুন করে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতায় প্রবেশ করে, সে সময়কালও পার করেছে। নব্বই-এর পরের সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই বাংলাদেশে নারীর সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলতে হয়। আর এ সময়কালে নারীর সাংবাদিকতার কথা বলতে গেলে প্রথমেই উচ্চারণ করতে হয় নারীর সাহসিকতার কথা। এ সাহস কেবলমাত্র রিপোটিং-এর জন্য নয়, এ সাহস সার্বিক ভাবে বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও।
নাসিমা খান মন্টি- এই মুহূর্তে যে ক’জন নারী এদেশের সংবাদপত্র জগতে নিজেদের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে অবস্থান করছেন তার মধ্যে অন্যতম। কেবল নারী হিসেবেই নয়, দৈনিক সংবাদপত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন তাদের মধ্যেও নাসিমা খান অন্যতম। একটি জাতীয় দৈনিক-এর সম্পাদনা খুউব সহজ কাজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো সার্বক্ষণিক সম্পাদকীয়, রিপোর্টিং এবং অফিস ব্যবস্থাপনায় যারা একই সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাদের মধ্যে নাসিমা খান তার নিজস্ব দক্ষতা দিয়েই জায়গাটি করে নিয়েছেন।
কিন্তু শুরুতেই যে কথা বলেছি, এদেশে সাংবাদিকতা খুউব সহজ কাজ নয় বিশেষ করে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার শিকার হওয়াটা এদেশে সাংবাদিকদের প্রতিদিনকার প্রাপ্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাসিমা খান মন্টিকেও এর শিকার হতে হয়েছে একাধিকবার। দেশের অন্যতম প্রধান টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ টিভির নিউজ রুম থকে শুরু করে আমাদের অর্থনীতি পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হওয়া পর্যন্ত এই দীর্ঘ সাংবাকিতার জীবনে নাসিমা খান মন্টিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে জীবননাশের হুমকি থেকে পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলার হুমকিও।
পারিবারিক ভাবে নাসিমা খান এদেশের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের সহধর্মিনী হওয়ায় তার ওপর বিভিন্ন অপশক্তির রোষটি যেনো আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। একাধিকবার নাঈমুল ইসলাম খান এবং তার ওপর হামলা হয়েছে এবং অলৌকিক ভাবে তিনি সন্তানসহ বেঁচে গিয়েছেন।
যতোদূর জানা যায়, নাসিমা খান মন্টি দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’র কার্যকরী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হওয়ার পর থেকে পত্রিকাটিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মপালনের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতি মাসে একেকটি নির্দিষ্ট ধর্ম বিষয়ক লেখা সমৃদ্ধ পাতা প্রকাশ করা শুরু করেন। ফলে সংখ্যাগুরু ধর্মের সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
একই সঙ্গে তিনি সম্পাদক হিসেবে এই পত্রিকায় নারীর অধিকার নিয়েও বিভিন্ন লেখা বা সংবাদ প্রকাশের সুযোগ প্রসারিত করেন, যা মৌলবাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে প্রতিনিয়ত তাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকির সম্মুখীন হতে হয় এবং এক রকমের ব্যক্তি-নিরাপত্তার ঘেরাটোপে জীবন যাপন করতে হয়। যদিও এদেশে এটি নতুন কিছু নয়, যে বা যারাই সমাজের এই অচলায়তন ভাঙার চেষ্টা করেন তাকেই এই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়।
আগেই বলেছি যে, নাসিমা খান মন্টির ক্ষেত্রে এই হুমকি এবং নিজস্ব নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি বহুলাংশে অন্য অনেকের তুলনায় বেশি একারণে যে, ব্যক্তি জীবনে তাকে দেশের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদকের সঙ্গে কাটাতে হয়। যিনি তার প্রথাবিরোধী ও সরকারের সমালোচনায় অভ্যস্ততার জন্য প্রসিদ্ধ। ফলে নাসিমা খান মন্টির ক্ষেত্রে সমস্যাটি বহুবিধ হয়ে ওঠে।
মজার বিষয় হলো, এসব ক্ষেত্রে কোনো সংবাদকর্মী রাষ্ট্রের কাছ থেকে খুব বেশি সুবিধা লাভ করেন না। কারণ ক’জনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে? তাছাড়া সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি এখনও এদেশে তেমন ভাবে লক্ষ্য করা যায় না। নাসিমা খান মন্টি সে কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব হুমকি-ধামকিকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেন কিংবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই তার প্রতিদিনকার কাজকর্ম চালিয়ে যান।
একই সঙ্গে সংসার এবং কর্মক্ষেত্রে সাফল্যলাভ, পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই যেখানে নারীর সবচেয়ে কাঙ্খিত অর্জন হয়ে দাঁড়িয়েছে যা এতোটাই কষ্টসাধ্য যে, খুব কম নারীই এই অসাধ্য সাধন করতে পারেন। এক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় নাসিমা খান মন্টিকে একজন ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরা যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উইমেন স্টাডিজ-এ মাস্টার্স করার আগেই নাসিমা খান মন্টি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নিজের পরিবারের দায়িত্ব সামলে একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন খুব সহজ কাজ নয়। নাসিমা খান মন্টি সেটি করে চলেছেন নিরলস ভাবে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কর্মরত নারীদের জন্য উৎসাহ যোগাবে।
কিন্তু সেই উৎসাহের বিষয়টি তখনই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে যখন এদেশের সাংবাদিকতা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠামুক্ত হবে এবং সার্বিক ভাবেই। কোনো ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় চাপ নয়, এদেশের সাংবাদিকতা হতে হবে উদার ও নৈতিক বলে বলীয়ান। নাসিমা খান মন্টি প্রায়শঃই একথা বলে থাকেন যে, আমরা শুরু করেছি, সামনে নিশ্চয়ই এর সুফল বাংলাদেশ ভোগ করবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস