নামে-বেনামে এবারও তারাই হজের কারবারি

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ১১ জুলাই ২০১৮

গতবছর হজ ব্যবসায় জঘন্য মাত্রার অপকর্মের কোনো বিচার না করে এবারও আগের তৎপরতা। গেলবারের কারবারিরা এবারো তৎপর। তাদের হাতেই যতো চাবিকাঠি। তারা অধরা। পরাক্রমশালী। হজ কার্যক্রমে অনিয়ম, জোচ্চুরির অভিযোগে গতবছর ৬৬টি এজেন্সি ও মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শাস্তির বদলে প্রকারান্তরে তারা হয়েছে পুরস্কৃত। নামে-বেনামে এবারের হজের যতো কারবার তাদেরই কব্জায়। এ অবস্থায়ই হজ কার্যক্রম উদ্বোধন হয়েছে। ফ্লাইট শুরু হবে ১৪ জুলাই থেকে। চলবে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত।

এবারের নমুনা ও কার্যক্রমও গেলবারের চেয়ে ততো ভিন্ন নয়। হজ ব্যবসা বৈধ কি-না, এ প্রশ্নের নিস্পত্তি হয়ে গেছে বহু আগেই। খরচ বা অর্থের বিষয়-আশয় থাকলে লাভ-লসও প্রাসঙ্গিক। আপেক্ষিকও- এমন যুক্তির কাছে তামাদি হয়ে গেছে বিতর্কটি। তার চেয়ে বড় কথা খোদ সৌদি আরবেই চলে আসছে হজের সঙ্গে অর্থনীতির বিশেষ যোগসূত্র। তা ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম দেশেও। কিন্তু হজকে একেবারে নির্লজ্জ ব্যবসা খাতে ঠেলে দেয়ার ব্যাপকতা বাংলাদেশেই তীব্রতর। দিনকে দিন বিনা প্রতিকারে বাড়তে বাড়তে তা এসে ঠেকেছে চরম নোংরা ও ঠকবাজিতে।

গতবছর হজ কার্যক্রমের শুরুটাই ছিল অনিয়মে ভরা। পাসপোর্ট হাতিয়ে চম্পট দেয়া, ভিসা না দেয়া, ভিসা হলেও টিকিট না দিয়ে কেটে পড়া, মক্কা-মদিনায় মোয়াল্লেম জটিলতাসহ নানা যন্ত্রণার শেষ ছিল না। ধর্ম, বিমান মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মহলের নানামুখী চেষ্টার এক পর্যায়ে মালগাড়ির বগিতে তুলে দেয়ার মতো কয়েক হাজার জনকে সৌদি পাঠানো হলেও শেষ পর্যন্ত হজে যেতে পারেননি ৩৭৫ জন। সেই হতভাগাদের কেউ কেউ এরইমধ্যে ইহলোকও ত্যাগ করেছেন।

সেই অপকর্মের বিহিত করার অঙ্গীকার ছিল সরকারের। তথ্য-প্রমাণ দৃষ্টে বেশ কিছু ব্যক্তি ও হজ এজেন্সিকে সনাক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে গুরুতর নাফরমান-দাগী হিসেবে ৬৬টি এজেন্সির বিরুদ্ধে জরিমানা, জামানত বাজেয়াপ্ত, লাইসেন্স বাতিলসজ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে শুনিয়ে তখন বিষয়টি চাপা দেয়া হয়। আজতক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উপরন্তু তারাই এবারও হজের কারবারি।

যথাসময়ে বা সময়েরও আগে হজের টাকা শোধ করাকে বাড়তি সওয়াব মনে করে অভ্যস্ত হজ ইচ্ছুকরা। আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে শেষ বিদায়ের মতো ঢাকা আসেন তারা। এসেই দুর্গতির শুরু। খাদ্য, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা থেকে শুরু করে অন্তহীন ভোগান্তি হজ ক্যাম্পে।

একের পর এক ফ্লাইট বাতিল, ফ্লাইটে বিলম্ব, হজযাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে হজে না পাঠানো, এক বাড়িতে রাখার চুক্তি করে অন্য বাড়িতে উঠানো, নিম্নমানের খাবার, চুক্তি মতো অন্যান্য সুবিধাদি না দেওয়া হজ ব্যবসার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে পাপবোধের লেশমাত্র নেই এ ব্যবসায়ীদের। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিও প্রতিবছরই। সেইসঙ্গে আবেগী ও ধর্মকর্মের চমৎকার যতো কথামালা।

বরাবরের মতো এবারও কঠোর হুঙ্কারের শেষ নেই। ভিসা, টিকিট জটিলতা, যাত্রী সংকটসহ এবার শেষ পর্যন্ত কী হয় বা হবে তা বলার সময় আসেনি এখনো। গত বছর ভিসা অনিশ্চিত, ভিসা না হওয়ায় টিকিট না মেলা, একের পর এক ফ্লাইট বাতিলসহ নানা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই সাপ্লাইয়ের মালসামানার মতো সৌদিতে ফেলে আসা হয়েছে হজযাত্রীদের। কিন্তু এভাবে আর কতো? তা আর কোথায় গিয়ে ঠেকলে জোচ্চুরি-প্রতারণা মনে হবে?

হজ ফ্লাইটের অপেক্ষায় কাহিল হয়ে বিমানবন্দরে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় এক হজযাত্রীর মৃত্যু তো মাত্র ২০১৫ সালের ঘটনা। এর আগের বছর ২০১৪ সালে ফ্লাইট না থাকায় যেতে পারেননি ১৩৩ জন। একেবারে শেষ মুহূর্তে দুটি বিমান ভাড়া করে কোনো মতে সৌদি পাঠানো হয় ৪শ’ হজযাত্রীকে। নানামুখী অনিয়ম-অদক্ষতা আর বাণিজ্যিক তৎপরতার কারণে গতবার শেষ চেষ্টায়ও পাঠানো যায়নি ৩৭৫ জনকে। হজের সঙ্গে জেঁকে বসা বহুমুখী বাণিজ্যে জড়িত অনেকেই।

তৃণমূলে দালাল-ফড়িয়াদের হাত বদল হয়ে হজযাত্রীরা পড়ে এজেন্টদের খপ্পরে। পথে-পথে, পদে-পদে টাকার পর টাকা খসায় এজেন্সি, মোয়াল্লেমসহ অনেকে। এই আজাব পার হয়ে ভিসা আর ফ্লাইটের জন্য চাতক পাখির মতো উন্মুখ অবস্থায় পড়তে হয় আরেক জটিলতায়। কোনো জায়গায়ই শৃঙ্খলা নেই। এ অপরাধে শেষ পর্যন্ত এ চক্রকে কোনো শাস্তি পেতে হয় না। এর বিপরীতে হতাশ হলেও নিজেকে সামলে নেন হজপ্রার্থীরা।

নিজেদের আল্লাহর মেহমান ভেবে তারা কিছুতেই গোস্যা হন না। আল্লাহর ওয়াস্তে সব হজম করেন। প্রতিকার বা বিচার পেতে পারেন সেই আশা বা অপেক্ষাও করেন না। মোটকথা এতো ভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ হলেও বিক্ষুব্ধ হন না। কোনো রকমে হজে গিয়ে মক্কা-মদিনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের ভাগ্যবরণেও রাজি তারা। যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা ভাবেন, কোনোরকমে আল্লাহর ঘরে হাজিরায় যেতে পারলেই হয়।

মক্কা-মদিনায় গিয়ে মৃত্যুও ভাগ্যের ব্যাপার। আর সেখানে যাওয়ার পর ভোগান্তি সয়ে ভাবেন, কোনোভাবে দেশে ফিরতে পারলেই শুকরিয়া। কিন্তু আয়োজকরা কি এই মানুষগুলোকে আল্লাহর মেহমান ভাবেন? ধরেই নেন হাজিরা তাদের বিজনেস আইটেম। মৌসুমি কারবারের মাল। অথচ ধর্ম মতে, হাজিরা আল্লাহর মেহমান। হজের মেজবান স্বয়ং আল্লাহ। এই মেহমানদের নিয়ে ঠকবাজি খোদার আরশ কাঁপানোর মতোই অপরাধ।

এর জন্য একতরফা সরকারকে দায়ী করার সুযোগ কম। হজ আয়োজনে সরকারের বাইরেও সম্পৃক্ত পাঁচ-ছয়টি সংস্থা। ধর্ম মন্ত্রণালয় ছাড়াও হজ অফিস, বাংলাদেশ বিমান, ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাস, সৌদি এয়ারলাইনস, হজ এজেন্সিজ অব বাংলাদেশ-হাব কেউই এ দায় এড়াতে পারে না। নিজের দায়মুক্তির চেষ্টার পাশাপাশি তারা একে অন্যকে দোষে। চলে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ।

ধর্মমন্ত্রী দায়ী করেন হজ এজেন্সি মালিকদের। আর এজেন্সিগুলো দোষে সরকারকে। পারলে সৌদি সরকারকেও। অভিযোগের আঙুল রয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনের কিছু কর্মকর্তার দিকেও। তাদের কারো কারো কাছেও হজ এক্সট্রা কামাই-রোজগার এবং আয়েসের উত্তম মওসুমের মতো। তা করতে গিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মের দুষ্টচর্চায় মনোযোগী তারা।

ন্যায্য টাকা দিয়েও যেখানে হজযাত্রীদের এমন দুর্গতি সেখানে রয়েছে হজের নামে কারো কারো বেশ মোজে সৌদি ট্যুর করে আসার নোংরামি নাস্তিক- ধর্মহীনের বিবেককেও নাড়া না দিয়ে পারে না। হজের কাফেলায় এর আগে সংখ্যালঘু সদস্য ঢুকে পড়ার কুৎসিৎ কাণ্ড পর্যন্ত হয়েছে। গতবার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ১৭১ জনের হজ চিকিৎসকদের সহায়তাকারী দলেও এমন অনেককে ঢোকানো হয়েছে যারা এই কাজের লোকই নন। যাদের ৩৫ জনই ধর্মমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহের।

টীমে রাখা হয়েছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী ও সংস্থার ২৫ জন গাড়িচালককেও। বাদ পড়েনি নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, অফিস সহায়ক, পাম্প অপারেটর, টাইপিস্টসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও। রয়েছেন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষিবিদ ও ফার্মাসিস্টরাও। হজযাত্রীদের চিকিৎসকদের সহায়তাকারী হিসেবে সৌদিতে অবস্থান বাবদ মোটা অংক পাবেন তারা।

পরিকল্পিতভাবেই আমাদের হজ ব্যবস্থাপনার মধ্যে ফাঁকিঝুকি ও ঠকবাজির ফাঁক লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে একটা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এ অভিযোগ ফয়সালাহীন। অভিযোগটিকে মিথ্যা প্রমাণের কার্যকর চেষ্টাও স্পষ্ট নয়। যা প্রকারান্তরে আসকারা বা মশকরা। পরিণামে বিরতিহীনভাবে প্রতি বছর লাভবান হচ্ছে একটা চক্র। আর হজযাত্রীদের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে এই দুর্ভোগ।

ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা পর্যন্ত ধকল সামলাতে সামলাতে আধমরা হতে হয় তাদের একেকজনকে। এই নিষ্ঠুর-নির্দয়, প্রতারণা-ঠকবাজিতে হজের শুরুর হাসি শেষ পর্যন্ত কোথাও হারিয়ে যাওয়ার এ নিয়মের লাগাম টানা জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

ধর্মমন্ত্রী দায়ী করেন হজ এজেন্সি মালিকদের। আর এজেন্সিগুলো দোষে সরকারকে। পারলে সৌদি সরকারকেও। অভিযোগের আঙুল রয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনের কিছু কর্মকর্তার দিকেও। তাদের কারো কারো কাছেও হজ এক্সট্রা কামাই-রোজগার এবং আয়েসের উত্তম মওসুমের মতো। তা করতে গিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মের দুষ্টচর্চায় মনোযোগী তারা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।