ডাঙায় দানব বাস
জীবিকার তাগিদে ডাঙায় পথ চলতে হচ্ছে প্রতিদিন। পথ থেকে ঘরে ফিরে যাবো সেই ভরসা নেই। প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতেও পারি আবার নাও ফিরতে পারি। ডাঙায় হজম হয়ে যাবার আতঙ্ক রয়েছে। হজম হচ্ছেও প্রতিদিন।
এক, দুই করে সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ গিলে খাচ্ছে দানব। সারাদেশে দানব হা করেতো আছেই, রাজধানীতেও টপাটপ গিলে খাচ্ছে। এই দানবের নাম বাঘ নয় বাস। ঈদে ঘরে ফেরা এবং কাজে ফিরে আসতে গিয়ে একদিনেই ৪৫ জন বাসের পেটে গেছে। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা আড়াইশ।
গত চারদিনে ঢাকায় একজন করে হত্যা করেছে বাস। মানুষ খেকো বাস বেপোরায়া, ক্ষুধার্ত। তার চলনে বলনে সভ্যতা নেই। যেখানে যখন ইচ্ছে দাঁড়িয়ে পড়ছে। যেমন করে ইচ্ছে তেমন করে। পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার ঔদ্ধত্য অহং।
ডাইনোসারের মতো চলা তার অসভ্যতার বহিঃপ্রকাশ। অথচ বাস নামক এই বাহন কেমন করে পথ চলবে, তার নিয়ম নীতি আছে। যিনি এই বাহন চালাবেন আছে তার দক্ষতার মাপকাঠি। কিন্তু বাস দানব হয়ে উঠায়, কোন আইন বা নিয়মকে তোয়াক্কা করছে না। বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখতে হচ্ছে আইন এবং নিয়মকে।
বাস নামের এই দানবের পেটে হরিণ শাবক হয়ে ঢুকে পড়ছে মোটর সাইকেল। হরিণ শাবকের মতোই চঞ্চলতা তাদের। রাজধানীতে মোটর সাইকেলের ভিড় বেড়েছে। মিছিলের মতো মোটর সাইকেল নামছে পথে।
‘পাঠাও’ রাইড জনপ্রিয় হবার পর মোটর সাইকেল ঝাঁক বেঁধে চলছে রাস্তায়। এদের চলাতেও সভ্যতা নেই। অস্থির চলাচল। এই অস্থিরতার নির্মম সমর্পণ বেপরোয়া বাসের পেটে।
পাঠাও রাইড আরোহী এবং চালকেরা যেমন প্রাণ দিচ্ছেন, তেমনি উদ্ধত গতি নিয়ে চলাচলের জন্য সাধারণ মোটর সাইকেল আরোহীরাও প্রাণ দিচ্ছে। দুইদিনে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মোটর সাইকেল নিয়ে বাস চাপা পড়েছে। এজন্য দুই পক্ষের চলাচলকেই প্রশ্নের মুখে রাখতে হচ্ছে।
প্রশ্নের মুখে রাখতে হচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থাকেও। পথে চলাচলকারী কোন বাহনের উপরই আসলে ট্রাফিক বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নেই। রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিও নিধিরাম সর্দার। লাইসেন্স দেয়া নিয়ে বিতর্ক এড়াতে পারলোনা সংস্থাটি।
উৎকোচের মাধ্যমে অযোগ্যদের পথে বাহন নিয়ে নামার লাইসেন্স দেয়ায়, সড়কের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামী করা যায় এই সংস্থাটিকেই। চালক-পথচারী –মালিকপক্ষ এবং ট্রাফিক বিভাগের সম্মিলিত মতোও তাই।
ট্রাফিক বিভাগ ঢাকার রাস্তার জন্য পৃথক লেন বাস থামানোর জায়গা, বাসের গতি, বাস রুট, গাড়ি পার্কিং এর নিয়ম নীতি কোন কিছুই বাস্তবায়িত করতে পারেনি। অটোমেটিক সিগন্যালিং সিস্টেম চালু না করতে পেরে লাঠি-দড়ি-বাঁশ পদ্ধতি দিয়ে যান-বাহনের গতি রোধে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কোন চেষ্টাতেই সাফল্যের মুখ দেখেনি ট্রাফিক বিভাগ।
শুধু জোরপূর্বক বা বাধ্যতামূলক মামলা করাতেই তাদের সাফল্য। হাইওয়ে পুলিশ টোকেন বা চাঁদা তুলে যাচ্ছে নিরলস ভাবে অনুগত কর্মীর মতো। মহাসড়কের বেপরোয়া গতির বাহনের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। মহাসড়ক থেকে রকমারি গতির বাহনও তারা তুলে নিতে পারেনি।
এই সব ব্যর্থতার পাশাপাশি আছে সমাজের নানা প্রজাতির ভিআইপি বা ধনকুবেরদের দৌরাত্ম্য। তারা নিজেরা যেমন বেসামাল। তেমনি তাদের দুলাল-দুলালীরাও তাই। তাদের আদুরিপনার কাছে প্রাণ যাচ্ছে অসহায় পথচারীদের।
এই হত্যা মামলার দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনা। নানা ছলে বলে এবং নগদ টাকায় স্তব্ধ করে দেয়া হয় নিহতদের পরিবারদের। সর্বশেষ একজন সংসদ সদস্যের পুত্র পথচারীকে হত্যা করার পর, নগদে কিনে নেয়া হয় নিহতের স্ত্রীকে।
এই বেচা বিক্রির দোকানদারিতে পড়ে গেছে পুরো পরিবহন এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। যেখানে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি সহজলভ্য সেখানে কোন নিয়ম-নীতির প্রয়োগ প্রত্যাশা করা অস্বাভাবিক। বেসামাল স্বপ্নই।
সহজ ও স্বাভাবিকতা হচ্ছে নামতা গুণে যাওয়া। প্রতিদিন অঙ্ক বদলে যাবে। যোগ হবে শুধু হত্যা বা মৃত্যুর খবর। হত্যাকারী চালক বা বাহনের বিয়োগ হবার নিয়ম নেই এই জাদুর শহরে, আশ্চর্য দেশে!
এইচআর/এমএস