যুক্তরাষ্ট্রের খাঁচাবন্দী শিশু, লুট হওয়া শৈশব
মানবতা শব্দ টা আসলে কি আপেক্ষিক ? তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রের ডিটেনশন সেন্টার কিংবা বন্দীশালায় এই যে এই যে শত শত শিশু-কিশোর বন্দী আছে,তারা ট্রাম্প সরকারের কোন্ মানবতার মধ্যে পড়ে। মানবতা যখন বিশ্বমোড়লদের কেউ কেউ তাদের বিবেচনায় দেখেন, তখন তারা মনে করে বাচ্চাদেরকে খাঁচার মধ্যে রাখাটাও মানবতা, তাদের কথায় অপরাধ দমন করা।
দু বছরের শিশুটি যখন তার মা’র কাছে যাবার জন্য বুক ভাসায়, তখন কোন মানবিক আবেদন ওয়াশিংটন ডিসিতে বাজে না। কারণ ট্রাম্পের মানবতায় একটা শিশুকেও আটকে রাখা যায় বন্দীশালায়। লোহার তার দিয়ে বেড়া দেয়া খাঁচায়।
বুশ ব্লেয়ার যখন ইরাকে হামলা করেন, শত সহস্র শিশু যখন নিহত হয়েছিল, তখনও মানবতা ছিল তেল-ডলারের কাছে জিন্মি। এখন বিরান করে দেয়া হচ্ছে সিরিয়া। যুদ্ধ শিশুরা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। অথচ ট্রাম্প বলছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে এরা। তাইত এদের বিচ্ছিন্ন করে রাখাটাই যুক্তিযুক্ত। তার কথায়, খাঁচাই হোক তাদের ঠিকানা ।
চোখের সামনে বুশ পত্নী ইরাকের হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, দেখেছিলেন নৃশংস পৃথিবীর একেকটা অধ্যায়। এখন সিরিয়া দেখছেন ট্রাম্প পত্মী, দেখছেন তিনি জেরুজালেম কিংবা প্যলেস্টাইন। কিন্তু তারা নির্বিকার। কারণ মাত্র এক বছরের মধ্যে ট্রাম্প তনয়ার ব্যবসা বেড়েছে দেড়গুণ। ব্যবসাই যখন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্প মানবতা খুঁজতে পারেন হত্যাযজ্ঞেই।
কিন্তু ঘরের মাঝেই আছে বিরোধিতা । ন্যূনতম সংবেদনশীলতা আছে হয়ত তাদের, তাই শিশুদের খাঁচায় বন্দী জেলখানাটা তাদের পছন্দ হয় নি। বুশ পত্নীর তাই ভাল লাগেনি। তাঁর দেশে শিশুদের এই বন্দীদশা দেখে তিনি চমকে হয়ে উঠেছেন। তাইত তিনি বলেছেন, এ জেলখানাকে শুধুই মেলানো যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শিশুবন্দীদের সাথে।
এমনতিইে মেক্সিকোর উপর ক্ষেপে আছেন ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারণায় একটা ইস্যুই ছিল তার এটা। এটা সত্যিও যে, মেক্সিকোর মাদক ব্যবসায়ীদের দমন করতে পারছে না আমেরিকা। এদের অপ্রতিরোধ্য পাড়ি জমানোতে আমেরিকার জনজীবনে ছন্দপতন হচ্ছে। তাইত তাঁর ঘোষণা ছিল, তিনি বিজয়ী হলে দেয়াল তোলবেন সীমান্তে, এবং ইনভয়েস করবেন মেক্সিকোর সরকারের কাছে।
তৃতীয় বিশ্বের নির্বাচনী হাততালিই পেয়েছিলেন তিনি। তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু দেয়াল উঠে নি। এখন তিনি মেক্সিকোর শিশুদের শায়েস্তা করতে লেগেছেন। ছুটে আসা মেক্সিকান বয়স্কদের তার সরকার নিচ্ছে ডিটেনশন সেন্টারে, পাশাপাশি এদের ছেলেমেয়েদের বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, শিশুরা হচ্ছে পিতামাতাহীন। এভাবেই যদি চলতে থাকে, এদের শৈশব লুট হয়ে যাবে।
দুর্দমনীয় মনোবৃত্তি নিয়ে এরা বেড়ে উঠবে। দুবছরের বাচ্চাটি একসময় মনে করবে কোনদিনই হয়ত তারা মা ছিল না, ছিল না বেঁচে থাকার অবলম্বন। তার বেড়ে উঠা হবে আপোসহীন, অপ্রতিরোধ্য আরেক অন্ধকারের দিকে তাদের যাত্রাটা রুদ্ধ করবে কে ? সেকারণেই হয়ত ট্রাম্প পত্নীও বিস্মিত। যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে শিশুদের এই খাঁচার জেলখানা দেখে।
টেক্সাসের শিশুদের বন্দীশালায় তারা ঢোকেছিলেন, দেখেছেন এদের বন্দীদশা। অতি সম্প্রতি শিশুদের ঐ ডিটেনশন সেন্টার দেখার অনুমতি পেয়েছিলেন সাংবাদিকেরাও। তবে শিশুদের সাথে তাদের কথা বলার অনুমতি ছিল না। ছিল না ছবি তোলার অনুমতি। কিন্তু পরে আমেরিকার কাস্টমস ও বোর্ডার কিছু ছবি প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। তাতেই বেরিয়ে আসে শিশুদের প্রতি ঐ নির্মমতার চিত্র।
তারা দেখেছেন কিভাবে একেকটা শিশুর হৃদয় জুড়ে বয়ে যাচ্ছে ঝড়ের তাণ্ডব। এই ঝড় হৃদয়ে ধারণ করেই শিশুগুলোর ’মা’ কিংবা ‘বাপ’ ধ্বনিটা আর্তনাদ হয়ে মিইয়ে যাচ্ছে খাঁচার ছিদ্র দিয়ে অদৃশ্য হাওয়ায়। এই শিশুগুলোর কি অপরাধ ? তাদের মা-বাবার কথিত অপরাধের কারণে অবুঝ শিশুদের প্রতি এই মানবতাহীন আচরণ।
অথচ আমেরিকার আইনতো বটেই, আন্তর্জাতিক আইনেও ১২ থেকে ১৫ বছরের শিশু কিংবা কিশোররাই অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে কয়েদি কিংবা বন্দী হতে পারে। অর্থাৎ শিশুদের খাাঁচার মধ্যে বন্দী রেখে টেক্সাসে মূলত আন্তর্জাতিক আইনই লজ্ঞন করা হচ্ছে। অথচ মানবতার ধ্বজাধারীরা এতে মানবতার লুণ্ঠন দেখে না।
মানবতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শিশুদেরকে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে বরং ‘অভিবাসনে বিভক্তিকরন নীতি’ নিয়েই আগাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। কর্পোরেট দুনিয়ায় রাজনীতি কিংবা সমাজ অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয় হঠকারিতা, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার নৃশংসতার দ্বারাই। বাণিজ্যায়নকেই প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা আজকের পশ্চিমা তথা প্রায় সকল গণমাধ্যমগুলোই। তবুও এই বীভৎসতাকে মেনে নিতে পারে নি বিবিসি। অন্তত শিশুদের এই হাহাকারকে তারা আখ্যায়িত করতে পেরেছে ‘ট্রাম্প মাইগ্রেন্ট সেপারেশন পলিসি’ হিসেবে।
কিন্তু কি সেই বিভাজন। সভ্যতা একটা শিশুকে তার বাবা-মা’র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে প্রতিদিন। এই সভ্যতায়ই যুক্তরাষ্ট্রে এখন অন্তত দুই হাজার শিশু এরকম অনৈতিক বিচারহীনতার শিকার। আর সেকারণেই সারা যুক্তরাষ্ট্রেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে মার্কিন নাগরিকরা।
দ্রোহ নিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমেছে গত ৩০ জুন। দেশটির ৬৩০টি জায়গায় হয়েছে বিক্ষোভ। এতে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমেছে, করেছে প্রতিবাদ। বিক্ষোভে-প্রতিবাদে তারা বিতর্কিত ইমিগ্রেশন নীতির বিলুপ্তি চেয়েছে। আদালতে শিশুদের পক্ষে রায় দিলেও হাজারো শিশু এখনও তাদের মা’র স্পর্শ পায় নি। পায় নি পিতার উষ্ণ আলিঙ্গন।
আমেরিকার মত ট্রাম্পের কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের আরেক দোসর ইসরাইলে হচ্ছে সেই একই নৃশংসতা। যেখানে ফিলিস্তিনি শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে, জেলে ঢোকানো হচ্ছে একের পর এক, শত-সহস্র। দুই কাঁধে ধরে চ্যাং দোলা করে ইসরাইলী পুলিশ এদের নিয়ে যাচ্ছে, কখনও এরা গুম হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব মোড়লদের চোখ তাতে চমকে উঠে না, বরং তখন চোখ যায় তাদেরই জিইয়ে রাখা সন্ত্রাবাদ মোকাবেলায়।
এরকম অভিযোগ ব্রিটেনেও যে নেই তা নয়, তবে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মত কোন নীতিমালা নেই শিশুদের বিভাজন করতে, বরং হোম অফিসের নীতিমালা অনুযায়ী কোন শিশুকেই বিচ্ছন্ন করা যাবে না তার পরিবার থেকে। তবে যে গুটিকয়েক শিশু বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে, তাদের প্রায় সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে পিতার অবর্তমানে মা’র মানসিক সমস্যায় যাতে শিশু ভেঙ্গে পড়তে না পারে, সেজন্যে তারা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে তাদের বেড়ে উঠার সুযোগ করে দেয়।
এরকম শিশুরা সংখ্যায় খুবই অল্প। গত ষোল মাসে তিনটা পরিবার মাত্র এরকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছে বলে এক জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। একটা কথা এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে, সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন শিশুদের বাসস্থান স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা কিংবা লালন-পালন নিয়ে খুব একটা উচ্চবাক্য এমনকি এইসব শিশুদের নিয়ে যে চ্যারিটিগুলো কাজ করে, তারাও জনসমক্ষে আনতে পারে নাই।
মানবতাকামী মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভে মেতে উঠেছে। সেভাবে সারা বিশ্বে এই মানবতার শ্লোগানটা ছড়িয়ে পড়ুক। শুধু বন্দীদশা থেকেই মুক্তি নয়, শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধেই আমাদের মানবিক আবেদনটুকু আরও জাগ্রত হোক।
তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে শিশুদের উপর নির্যাতন চলছে, খবর হচ্ছে এসব দেদার। এসব কিছু থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বের শিশুরা অন্তত মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে থাকুক এই সভ্যতায়। আগামী দিনগুলোতে আমরা যেন এই বার্তাটুকুই পাই, দেখি পৃথিবীর দেশে দেশে।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস