প্রসঙ্গ ব্যাংক ঋণের সুদের হার
আমানতের বিপরীতে কাউকে ৬ শতাংশের বেশি সুদ ব্যাংকগুলো আর দেবে না। আবার ব্যবসা বা শিল্পকারখানা করার জন্য ব্যাংক থেকে কেউ ঋণ নিলে তার বিপরীতে সুদ নেবে ব্যাংকগুলো একক অঙ্ক বা ১০ শতাংশের কম। আগামী ১ জুলাই থেকে এই দুই সুদের হার কার্যকর হতে যাচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর স্বার্থে প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমানো এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা ও এক পরিবারের ৪ জনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ দেয় সরকার।
এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও সুদের হার না কমায় বিরোধী দলের সাংসদ এবং অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র সমালোচনা ছিল। আর এর আগে গত এপ্রিলে এক মাসের মধ্যে সুদের হার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্যাংক মালিকেরা।
গত এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে ব্যাংক মালিকদের তাগিদ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, দেশে বিনিয়োগের স্বার্থে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে অর্থাৎ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতেই হবে। তার সেই নির্দেশনারই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে এখন।
প্রশ্ন উঠতে পারে কাজটি কি ব্যাংক মালিকদের? ব্যাংক মালিকদের সমিতি ঠিক করে দিচ্ছে সুদের হার কত হবে! ফলে বিষয়টা প্রতিযোগিতামূলক না হয়ে বরং বাজার অর্থনীতির পরিপন্থী হলো।
বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণে সুদের হার তার সাথে তুলনীয় দেশগুলো থেকে অনেক বেশি যা ব্যবসায় খরচ অনেক বাড়িয়ে রেখেছে। অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়টি নিয়ে কখনো উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বরারবর যে চেষ্টাটি করে এসেছে তা হলো ব্যাক্তিখাতে ঋণ প্রবাহকে একটু সংকুচিত রাখতে যেন মূল্যস্ফীতির চাপ না আসে। ফলে সুদের হার কখনোই সত্যিকারের বিনিয়োগকতারীদের জন্য সুখকর হয়নি এবং অর্থনীতিতেও কাঙ্খিত বিনিয়োগ আসেনি।
মূল আলোচনায় ঢোকার আগে ব্যাংক ঋণ নিয়ে দু’চার কথা। এটা অনেকেরই অজানা নয় যে, বেশ কিছু দিন ধরেই ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের অনাদায়ী ঋণের বোঝায় জেরবার হয়ে রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির অনাদায়ী ঋণ বা নিষ্ফল সম্পদ বেড়েই চলেছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদেই অনাদায়ী ঋণে প্রাধান্য। সমস্যা সত্যিকারের ভাল ছোট ঋণগ্রহীতাদের। কে ইচ্ছাকৃত খেলাপি এবং কে অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে খেলাপি সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে রাজনীতি বা অন্য প্রভাব কাজ করছে কি-না, সেটা নিশ্চয়ই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে।
ঋণ সুদের হার গ্রহীতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ উদ্যোক্তাকে ব্যবসা করতে হয় লাভের জন্যই। ঋণে সুদের হার বেশি থাকলে, এতে করে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকলে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চাইবেন না। আর এতে করেই বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। আবার বেশি সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় ক্ষতি হলে একজন উদ্যোক্তা ঋণখেলাপী হলে তার চাপও পড়ে ব্যাংকে, তথা অর্থনীতিতে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার ব্যাপক সঙ্কট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে ব্যাংকগুলো মরিয়া হয়ে গেছে। আর বেশি সুদে আমানত নেওয়ায় ঋণের সুদের হারও বেড়ে গেছে। সুদের হার বাড়লে উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। আর উৎপাদন খরচ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিনিয়োগও কমে যায়।
সাধারণত সুদের হার নির্ধারিত হয় চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোয় তারল্য বেশি থাকলে তারা কম সুদে ঋণ দিবে। কিন্তু বাংলাদেশে কখনোই এই নীতির বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। তারল্যে প্লাবিত থাকা অবস্থায়ও ব্যাংকগুলো সুদের হার কমায়নি।
বাংলাদেশে আরেকটি বড় বাস্তবতা হলো বেসরকারী খাতের ব্যাংক মালিকরা নিজেদের ব্যাংকের সুদের হার না কমিয়ে সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপী হতে চান।
দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হল ব্যাংকিং খাত। কিন্তু এ খাত ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ এ খাতের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (আইসিসিআই) ত্রিমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে এ কথা বলা হয়েছে।
দেশে খেলাপি ঋণ কমানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে ঋণ খেলাপিদের শাস্তি প্রদান, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মন্দ ঋণ সমস্যার সমাধানে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির গভীরে যেতে হবে। ঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিল্প খাতের বড় বড় কর্পোরেট গ্রাহক সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হচ্ছে বাধাহীন এবং দক্ষ সঞ্চয়-বিনিয়োগ পদ্ধতি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু মূলধনের বাজার এখনও উন্নত হয়নি। তাই অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় গতিশীল করতে এবং বিনিয়োগকারীদের মূলধনের জোগান দিতে মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল।
ফারমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ বেশি কিছু আর্থিক কেলেংকারীর ঘটনা এর মধ্যেই এই খাতকে অনেকটা আস্থাহীন করে রেখেছে। ব্যাংক মালিকদের মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা দেয়ায় এই খাতের সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এর মধ্যে খেলাপী ঋণের সমস্যা কেবল বেড়েই চলেছে। কিছু ব্যবসায়ী কেন বিপুল পরিমাণ ঋণ পেয়ে থাকেন, কেন তাদের অনাদায়ী ঋণের অঙ্কটি আকাশ ছুঁলেও তা কর্তাদের নজরে পড়িতে চায়না, তাদের আর্থিক গোলযোগের সংবাদ প্রকাশ্যে এলেও কেন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়না— এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে অনিবার্যভাবেই রাজনীতির ছায়া পড়বে।
যারা প্রশ্নাতীত রকম প্রভাবশালী, তাদের হয়েই ব্যাংকের নীতি প্রণীত করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাব হয় না। এসব ব্যাংক মালিকদের প্রভাবের একটি দৃশ্যমান কারণ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষস্তরের নৈকট্য। ব্যাংক মূলত জনগণের, ব্যক্তি বিশেষের নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থের মালিক জনগণ। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক নাসের ব্যক্তি বিশেষদের নৈকট্যের প্রভাব খুব গভীর ও ব্যাপক থাকলে সুদের হার এক অংক হলেই কি কোন ইতিবাচক প্রভাব আসবে?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস