ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে আসুক নারী

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ২১ জুন ২০১৮

এশিয়া কাপ জয় করে দেশে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছেন বাংলার নারী ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে দেশের জন্য বয়ে এনেছে বিপুল সম্মান। এই জয় দেশবাসীকে যেমন গৌরব এনে দিয়েছে তেমনি সামনে নিয়ে এসেছে বৈষম্যের চিত্রও।

বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটাররা যেখানে গাড়ি, ফ্ল্যাট এমনি অনেক কিছু পেয়েছেন, উপার্জন করেছেন প্রভূত অর্থ, নারীরা তেমন কিছুই পাননি। তাদের ভাতা যেমন অতি সামান্য তেমনি অন্য কোন সুযোগ সুবিধাও নেই। কিন্তু কেন এই বৈষম্য? ওরা নারী বলে?

আমাদের সমাজে ছেলে শিশুদের খেলাধুলায় উৎসাহ দেয়া হয়। কিন্তু মেয়েশিশুর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় পুতুল। মনে পড়ে অনেক আগে একটা চলচ্চিত্র দেখেছিলাম ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহাম’ নামে। হয়তো অনেকেই দেখেছেন ছবিটা। একটি মেয়ে ফুটবল খেলতে চায়। সে সহজাত দক্ষতাও রয়েছে এ খেলায়। অথচ মেয়ে বলে তাকে ফুটবলার রূপে কেউ দেখতে চায় না।

‘চাক দে ইন্ডিয়া’ নামে আরেকটি সিনেমায়ও দেখা গেছে নারী হকি দলের প্রতি কর্তৃপক্ষের তীব্র অবহেলার চিত্র। আর বছর খানেক আগে মুক্তি পাওয়া ‘দঙ্গল’ ছবিতেও নারী পুরুষের বৈষম্যের ছবি দেখা গেছে। সেখানে ক্রীড়াবিদ নারীকে উৎসাহিতও করা হয়েছে।

আমার শৈশবে দেখেছি খেলাধুলায় ভালো এমন মেয়েদের ‘মর্দা’, ‘গেছো’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করে তাদের নিরুৎসাহিত করা হতো। বিশেষ করে ফুটবল বা ক্রিকেটের মতো খেলায় নারীদের অংশগ্রহণ পরিবার, সমাজ কারও চোখেই ভালো ঠেকতো না। মেয়েরা যেন পুতুল খেললেই স্বস্তি।

বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে অসংখ্য কিশোরী আছে যাদের ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্যের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সকল সম্ভাবনা অকালেই বিনষ্ট হয়ে যায় সামাজিক কিছু কুসংস্কারের কারণে। শুধু গ্রামের কিশোরী নয়, শহরেও কিশোরীদের খেলাধুলায় অনেক রকম সমস্যা রয়েছে।

প্রথমত খেলার মাঠ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহর থেকে। স্কুলেও মাঠ বলতে কোন কিছু থাকে না। আর কোন কোন পাড়ায় মহল্লায় এখনও যে হাতে গোনা কয়েকটি মাঠ টিকে আছে সেখানে মাদকসেবীদের আখড়া। সেসব মাঠে ছেলেরাই খেলার সুযোগ পায় অতি কষ্টে। আর মেয়েকে তো তেমন জায়গায় খেলাতে পাঠানো যায় না নিরাপত্তার কারণেই।

স্কুল পর্যায়ে মেয়েদের খেলাধুলাকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজন মেয়েদের জন্য আরও বেশি টুর্নামেন্টের আয়োজন। প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশে খেলাধুলায় যে মেয়েরা এগিয়ে এসেছেন তাদের বেশিরভাগই নিন্মবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। এদের যেমন রয়েছে পুষ্টি ঘাটতি তেমনি রয়েছে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। এজন্য খেলাধুলায় ভালো এমন মেয়েদের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

স্থানীয় পর্যায়ে কিশোরীদের বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন করলে সামাজিক বাধা ও কুসংস্কারগুলো কাটবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট রয়েছে। এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের ফলে মেয়েদের খেলাধুলার পরিবেশ অনেকটাই অনুকূল হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা দেখেছি সাফ দেশসমূহের মধ্যে আয়োজিত টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের কিশোরীরা দেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে। তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কলাসিন্দুরের মেয়েরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।

ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী মেয়েদের জন্য চাকরির কোটা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ফুটবল ও ক্রিকেটের যে ক্লাবগুলো রয়েছে তাদের প্রত্যেকের মহিলা দল থাকা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। নিয়মিতভাবে নারী ফুটবল, ক্রিকেটের টুর্নামেন্টের আয়োজন করা গেলে ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে।

সামাজিক বাধা ও বৈষম্যও অতিক্রম করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। একজন ছেলে যদি খেলাধুলায় ভালো হয় তাহলে সামাজিকভাবে সে প্রশংসা পায়। অথচ একজন মেয়ে যদি খেলাধুলায় ভালো হয় তাহলে তার কপালে জোটে তিরস্কার। তাকে ‘মর্দা’, ‘গেছো’, ‘পুরুষালী’ ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করা হতে থাকে। তার বিয়েতে সমস্যা হয়।

এমনি পশ্চাৎপদ আমাদের সমাজ। এই বাধাগুলো দূর করার জন্য চাই সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর উদ্যোগে থানা ও উপজেলা পর্যায়ে এমনকি গ্রাম পর্যায়ে যদি নিয়মিত মেয়েদের জন্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায়, যদি খেলাধুলায় ভালো এমন মেয়েদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তাদের সামাজিকভাবে যেমন কদর বাড়বে তেমনি আর্থিক সংকটগুলো কাটবে।

তাহলে আরও বেশি সংখ্যক কিশোরী খেলাধুলায় এগিয়ে আসবে। শুধু ফুটবল বা ক্রিকেট নয়, নারীদের জন্য ভলিবল, বাস্কেটবল, হকি, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন এবং অ্যাথলেটিকস এ বিশেষ সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নদীনালার দেশ বাংলাদেশ। গ্রামের মেয়েরা প্রায় সকলেই সাঁতার জানে। সাঁতারে ভালো করার অনেক সম্ভাবনা আমাদের রয়েছে।

শহরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নারীরা যেন সাঁতার শিখতে পারেন সে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শহরে মেয়েদের জন্য সুইমিং পুলের সংখ্যা অনেক বেশি বৃদ্ধি করতে হবে। কিশোরীদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করা এবং তাদের বিকাশের জন্য আরেকটি বড় বাধা অতিক্রম করতে হবে। সেটি হলো বখাটেদের উৎপাত দূর করা। বখাটেদের উৎপাত এবং যৌন হয়রানি আমাদের দেশে নারীর জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা। বখাটেদের উৎপাত থেকে নারীকে রক্ষা করতে হবে, তাকে নিরাপত্তা দিতে হবে। নাহলে অভিভাবকরা মেয়েদের খেলার মাঠে কিভাবে পাঠাবেন?

আর সামাজিক বাধা দূর করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নারীদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করে তৈরি হওয়া দরকার জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন, টিভি স্পট, বিলবোর্ড, পোস্টার, কার্টুন ইত্যাদি। বিশেষ করে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে চাই ব্যাপক সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ।

ক্রীড়াবিদ মেয়েদের যদি চাকরির নিশ্চয়তা থাকে তাহলে তাদের বিয়ের ক্ষেত্রে বিরাজমান সামাজিক বাধা অনেকটাই দূর হবে। দরকার অনুশীলনের ব্যবস্থা, নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজন, খেলাধুলার জন্য বিশেষ বৃত্তি। দরকার নারী প্রশিক্ষকও।

আমাদের শিশু ও কিশোরীরা মুক্তপাখির মতো আকাশে ডানা মেলুক। তারা ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে যাক। তারা দেশের জন্য আরও অনেক সম্মান বয়ে আনুক।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

‘আমাদের শিশু ও কিশোরীরা মুক্তপাখির মতো আকাশে ডানা মেলুক। তারা ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে যাক। তারা দেশের জন্য আরও অনেক সম্মান বয়ে আনুক। ’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।