ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদ উৎসব

শামসুজ্জামান খান
শামসুজ্জামান খান শামসুজ্জামান খান
প্রকাশিত: ১০:১৫ এএম, ১৭ জুন ২০১৮

ঢাকার সাবেক কালের সমন্বিত সাংস্কৃতিক জীবনের কিছু নতুন দিক এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। ঢাকার নওয়াবরা উর্দুভাষী হিসেবে বাঈজিনাচ, মহরমের মিছিল, ঈদোৎসব, কাওয়ালি বা জয়বারী গানবাজনার সঙ্গে যেমন জড়িত ছিলেন তেমনি হিন্দুদের দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমি, ঝুলনযাত্রা ইত্যাদিতেও যোগ দিতেন।

নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি (সম্পাদনা- অনুপম হায়াৎ) গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে নওয়াবরা বাংলা নববর্ষ, নবান্ন, গায়ে হলুদ, মেয়েদের ঘুড়ি উৎসব, পৌষ সংক্রান্তি এমনকি ষষ্ঠী প্রভৃতি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান করতেন এবং এসব উৎসবেও অংশ নিতেন।

১৯১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি তারিখের খাজা মওদুদের ডায়েরিতে লেখা আছে : “আজ সোমবার। পৌষ-সংক্রান্তির দিন। নওয়াবজাদী আমেনা বানু আজ আহসান মঞ্জিলে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আয়োজন করেন। এতে তিনি শুধু মহিলাদের দাওয়াত দেন। মহিলাদের এই আনন্দ উৎসবে সারা দিন রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া ও নাচগানের এন্তেজাম করা হয়। পরের বছর নওয়াববাড়ির গোলতালার পারে পুরুষদের ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা বা ‘হারিফি’ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খাজা হুমায়ুন কাদের এতে অংশ নেন। এতে বিপুল দর্শক সমাগম ঘটে।”

ঈদোৎসবে নওয়াবরা নানা আমোদ-ফূর্তির ব্যবস্থা করতেন : যেমন কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারের নাটক ঢাকার নওয়াব বাড়িতে প্রদর্শন, জাদু ও সার্কাস দেখানো, বায়োস্কোপ দেখা বা কোনো খেলাধুলার আয়োজন।

পাটুয়াটুলির ক্রাউন থিয়েটার, জগন্নাথ কলেজ, ন্যাশনাল মেডিকেল ইত্যাদির মঞ্চে বায়োস্কোপ দেখার তথ্য যেমন আমরা পাই তেমনি পিকচার হাউস, এম্পায়ার থিয়েটার ইত্যাদিতে সিনেমা উপভোগের রূপছায়াময় বিবরণ পাওয়া যায় নওয়াব পরিবারের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে। নওয়াবেরা ঈদের এমন সব বিনোদনে অংশগ্রহণের জন্য পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও সুযোগ করে দিতেন।

ঈদ নিয়ে নওয়াব বাড়িতে দু’একবার বিবাদ-বিসম্বাদও বেধে যায়। ১৯২০ সালের ২৫ আগস্টের খাজা শামসুল হকের ডায়েরিতে লেখা হয়েছে- ‘বকরা ঈদ নিয়ে নওয়াব বাড়ির দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ হয়। এক পক্ষে খাজা মোঃ আজম ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করেন যে, আজ বকরা ঈদ হবে। অপর পক্ষে নওয়াব হাবীবুল্লাহ ঢোল পিটিয়ে দেন যে, আগামীকাল ঈদ হবে। শেষ পর্যন্ত ওই বছর ঢাকায় দুই দিন বকরা ঈদ হয়। ১৯২২ সালের ঈদ-উল-আযহার ব্যাপারেও একই ঘটনা ঘটে।’

ঢাকার নবাবেরা রাজনীতিতে রক্ষণশীল ও স্বার্থ ও নেতৃত্ব রক্ষার জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করলেও আমোদ-প্রমোদ-বিনোদনে অসাম্প্রদায়িকতা এবং ইহজাগতিকতার পরিচয় দেন। ঢাকার প্রধান জুয়া রেসের সঙ্গে তাদের ওতপ্রোত সংযোগ ছিল। তাছাড়া অন্যান্য সুস্থ বিনোদন এবং নৃত্যগীত এবং হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মের অনুষ্ঠানে নওয়াবরা শুধু পৃষ্ঠপোষকতা করতেন না, নিজেরা আন্তরিকভাবে অংশও নিতেন।

কাজী কাইয়ুমের ২৮ ফেব্রæয়ারি ১৯০৪ তারিখের ডায়েরির সূত্রে এর একটি উদাহরণ পাই- ‘আজ রোববার, পবিত্র বকরী ঈদ। নামাজ শেষে আমিও অন্যান্যের মতো নওয়াবের সঙ্গে কোলাকুলি করি। নওয়াব সাহেব আমাকে আদেশ দেন অন্যান্যকে নিয়ে বিনা খরচে ক্লাসিক থিয়েটারে নাটক দেখার জন্য।’

ঈদসহ নওয়াব পরিবারের নানান পার্বণে ঘোড়দৌড়ের উল্লেখ লক্ষ্য করি। এ প্রসঙ্গে একটু সবিস্তারে না বললেই নয়। খাজা শামসুল হক ও খাজা আবদুল আলীম ‘প্লেন্টাইন’ নামের ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন। খাজা আবদুল গনির জামাই ছিলেন খাজা আবদুল আলীম। তিনি নওয়াব পরিবার থেকে প্রথমেই কংগ্রেসে যোগদান করেন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মধ্যে, ১৮৮৬ সালে।

জানা যায় তিনি ছিলেন খুবই শৌখিন ও স্মার্ট মানুষ। আর ঘোড়া, ঘোড়ার দৌড় ও ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপারে তিনি একজন ঝানু সমঝদার ও রসজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর ঘোড়াও ছিল বেশুমার, আর চমৎকার সব নাম ছিল সেসব ঘোড়ার। তাঁর একটি ঘোড়ার নাম ছিল, ‘দরিয়াবাজ’। ১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারির খাজা মওদুদের ডায়েরিতে লেখা হয়েছে-‘খাজা আবদুল হাফেজের দুটি ঘোড়া ছিল এবং তিনি দুজন ইংরেজ ঘোড়াচালক আনেন। খাজা সোলেমান কাদের ঘোড়দৌড় দেখতে যান। এই ঘোড়দৌড় এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে যেদিন ঘোড়দৌড় থাকত সেদিন অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বা সভা সমিতি থাকলে তা আর জমত না।’

১৯২৩-এ রকম দুটো ঘটনা পাচ্ছি ১. ‘১০ ফেব্রুয়ারি : আজ ন্যাশনাল এক্সিবিশন হওয়ার কথা ছিল, তবে তা হয়নি।’ রমনা রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় হয়েছে; ওই সালেরই ২১ জুলাইয়ের নবাবদের ডায়েরিতে লেখা হয়েছে : ‘আজ ১নং ওয়ার্ডের জনসভা সদরঘাটে হওয়ার কথা ছিল। রমনা রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় থাকায় এ সভা হয়নি।’ ঘোড়দৌড় নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকার এলিটরা; তবে সাধারণ মানুষ এমনকি দীনদরিদ্ররাও এতে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। আর ঈদের আনন্দে এসব খেলার ধুম ছিটিয়ে দিত বাহারি রং।

এবার ঘোড়দৌড় বিষয়ে একটা বিখ্যাত চুটকি শোনা যাক : ঢাকার ঘোড়দৌড়ের তখন দারুণ জেল্লা। রেসকোর্স ময়দান (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দৌড়ের দিনে জমজমাট। শুধু ঢাকা শহর না, নানা জায়গা থেকে জুয়াড়িরা আসে রেস খেলতে। রেসের জুয়াড়ি থেকে দর্শক, টন্নি, টেন্ডলে মাঠ গিজিগিজি করে। এমনি এক রেসের দিনে ঢাকার বাইরের এক শৌখিন আনাড়ি এসেছেন রেস খেলতে। নিয়মকানুন ও ঘোড়া সম্বন্ধে তার তেমন ধারণা নেই। তাই এক ঢাকাইয়া জুয়াড়ির শরণাপন্ন হয়েছেন টিপসের জন্য।

ঢাকাইয়া ঘোড়া ধরিয়ে দিয়েছে। শুরু হয়েছে দৌড়। কিন্তু ওই ঘোড়া পিছনে পড়ে হাঁপাচ্ছে। দৌড় শেষ, মফস্বলের আনাড়ির বাজির ঘোড়াটি সবার পিছনে।

মফস্বলের জুয়াড়ি ক্ষিপ্ত। ‘মিয়া এইডা ঘোড়া অইল? এক্কেবারে হ¹লের পিছে পইড়া লাইদা দিছে। এমন মরা ঘোড়া জীবনে দেহি নাই’।

ঢাকাইয়া : ‘ছাব ঘোড়ার পলিসি বুঝেন নাইক্যা! ওই হালায় ঠিক করছে, বেবাক ঘোড়ারে খেদায়ইয়া লইয়া যাইব। হালায় হেই মতনই কাম করছে। রেসে জিতে নাইক্যা মাগর তার বুদ্ধির ছাব্বাছি না দিয়া পারবেন না।’

ঢাকাইয়ার রগড়ের কথা শুনে নব্য জুয়াড়ি অতি দুঃখে হেসে ফেলেন। ঘোড়ার কথা উঠলেই বলতে হবে বুদ্ধিদীপ্ত কোচোয়ানদের কথা। সরস বুদ্ধি ও জীবনরসিক এই গাড়োয়ান বা কোচোয়ানেরা ছিলেন মজাদার মানুষ। চটপটে। বেশির ভাগই হাসিখুশি।

ঘোড়া তরতাজা-মোটাসোটা হোক আর হাড় বের করাই হোক তারও গুণ ছিল মেলা। সেকালের ঘোড়ার গাড়ির ছন্দময় চলনের শ্রুতিমধুর শব্দ যেন ছিল শহর ঢাকার গতিময়তার প্রতীক। এই ঘোড়া আর ঘোড়া গাড়ি নিয়ে কত রঙ্গরসিকতা, কত যে চুটকি প্রচলিত ছিল!

তার দু-তিন উদাহরণ পেশ করি : ১. ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া কম বললে গাড়োয়ান বলত : ‘ছাব আস্তে কন, হুনলে আমার ঘোড়ায় ভি হাসবো’; ২. এক গাড়োয়ানকে : মামা-আশেক লেন যাইবেন? গাড়োয়ান : যামু না ক্যালা! গাড়োয়ান : আট আনা। মামা : ছয় আনায় যাইবেন? গাড়োয়ান : খাড়ন, এই বলে সে ঘোড়ায় কাছে যায়! ঘোড়ার লেজে ধরে মোচড় দেয়। ঘোড়া চিঁহি করে ডাক ছাড়ে।

গাড়োয়ান : ছাব, ঘোড়ায় তো কয় যাইবো না। খাড়ন খাড়ন, শেষ চেষ্টা কইরা দেহি। এই বলে ঘোড়ার পায়ে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত মর্দন করে। মনে হয় লোম চকচক করছে। হঠাৎ ঘোড়া একটা লাফ দেয়। তখন গাড়োয়ান বলে : দেখছেন ছাব হালার পুতে কেইছা হারামি। আর পায় ধইরা খোসামোদ করলাম। তাও যাইবো না। হালায় ফাল মারে’।
এক গাড়োয়ান ছুটির দিনে তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। খটখট ধ্বনি তুলে গাড়ির চলেছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। এ সময় এক লোকও রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেলেদুলে গদাইলস্করি চালে হেঁটে চলেছে। গাড়ির শব্দে তার রাস্তার কিনারে যাওয়ার গরজ নাই। বহু চেষ্টা করেও পথচারীকে রাস্তার একদিকে নিতে না পেরে ত্যক্ত-বিরক্ত গাড়োয়ান গাড়ি থামায়। কিন্তু মুখে রাগ বা বিরক্তির চিহ্ন নেই।

গাড়ি রেখে দ্রুতগতিতে সেই পথচারীর কাছে গিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বলে : ‘আসসালামু আলাইকুম। আপনের আব্বা হুজুরে কেমন আছেন?’ লোকটা একটু ধন্দে পড়ে। ‘আপনি আমার আব্বারে চেনেন? কিন্তু আমি তো আপনেরে চিনবার পারলাম না।’ গাড়োয়ান : ‘কওতো হালায়, আপনে আমারে কেমতে চিনবেন?

আমি অইলাম এক ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান, আর আপনের বাপে অইল আমাগো ঢাকার নওয়াব ছাব। হেইতো এই রাস্তাডা বানাইছে। আপনে নওয়াবজাদার ছাব না?’ লোকটি আর রা কাড়ে না। রাস্তার একদিকে সরে গিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকে। এমনসব রঙ্গরসিকতায় ভরপুর ঢাকার আনন্দময় দিনগুলো আজ নওয়াবদের সেই সময়ের মতোই কালের অতল গহ্বরে লুপ্ত।

ঈদসহ নানা পালা-পার্বণে ঢাকার নওয়াবদের মহল এবং পরিবার ঘিরে সৃষ্টি হওয়া সাংস্কৃতিক চাঞ্চল্য শেষ পর্যন্ত নওয়াবি সীমানা ছাড়িয়ে সাধারণ ঢাকাবাসীর মাঝেও বইয়ে দিয়ে যেত আনন্দের হল্লা। সব মানুষের মিলিত অংশগ্রহণে ঢাকা পরিণত হতো সার্বজনীন উৎসবের নগরে।

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি, গবেষক।

এইচআর/জেআইএম

‘ঈদসহ নানা পালা-পার্বণে ঢাকার নওয়াবদের মহল এবং পরিবার ঘিরে সৃষ্টি হওয়া সাংস্কৃতিক চাঞ্চল্য শেষ পর্যন্ত নওয়াবি সীমানা ছাড়িয়ে সাধারণ ঢাকাবাসীর মাঝেও বইয়ে দিয়ে যেত আনন্দের হল্লা। সব মানুষের মিলিত অংশগ্রহণে ঢাকা পরিণত হতো সার্বজনীন উৎসবের নগরে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।