বড় লোকের জন্য যা তা কি আসলেই নির্বাচনী বাজেট?
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটকে অনেকে নির্বাচনী বাজেট বলেছেন। কিন্তু এই বাজেটের আসল দর্শন “ধনিকশ্রেণির প্রতি সদয় আচরণ”। বড় লোকদের তুষ্টি যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, যদি গরিব আর মধ্যবিত্তকে পিষ্ট করা মূল নীতি হয়, তবে কি করে এই বাজেট নির্বাচনী হয়? শুধু বড়লোকের ভোটে কি নির্বাচনে জেতা যায়?
অর্থমন্ত্রী আসলে নতুন কিছুই করেননি। বিষয়টি হলো বড় বাজেট, বারবার ব্যর্থ এর বাস্তবায়নে, কিন্তু আবারও বড় বাজেট। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের জন্যও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিদায়ী অর্থ বছরের চেয়ে ১৮.৩ শতাংশের বেশি আকারের একটি বাজেট প্রস্তাবনা। এটি উচ্চাভিলাষী কিংবা অতিকায় কিনা তা বিবেচ্য নয়। আমরা হয়তো ভাবতে পারি, বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজে কি কখনো ভাবেন?
এটি তার শেষ বাজেট যখন, তখন পেছনে ফিরলে তিনি কি দেখতে পান, তার দশটি বছর ব্যাংক কেলেংকারীর দশক হিসেবে রেকর্ড হয়ে থাকবে এদেশে? তিনি কি বিবেচনায় নেন, যে অর্থবছরটি চলে যাচ্ছে, সে সময়টায় সবচেয়ে কম বাস্তবায়িত হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী, রাজস্ব আহরণের ব্যর্থতাও বড় বাজেটের মতই বড়? তবুও অর্থমন্ত্রীকে বারবার অবাস্তব বড় বাজেট দিতে হয়, বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হয় এবং এবারও তিনি তাই করেছেন।
এখন পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার ৫২ শতাংশ। অর্থ বছর শেষ হতে আর মাত্র ২১ দিন বাকি। এর মধ্যে চেষ্টা চলবে বাকি ৪৮ শতাংশ বাস্তবায়নের। প্রতিবছর এটাই ঘটে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বর্ষায় ঢেলে দেয়া হয় হাজার হাজার বা লাখ কোটি টাকা। কোন বছরই রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশের বেশি হয় না, কিন্তু আমরা ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করি।
আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত নেপালেরও নিচে। প্রত্যক্ষ কর সবদেশের প্রধান রাজস্ব খাত হলেও, আমরা সাধারণ মানুষকে বেশি আঘাতকারী পরোক্ষ কর, তথা ভ্যাট নির্ভর করে ফেলেছি আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে কর-জিডিপি অনুপাত ১৩.৪ শতাংশে নিয়ে যেতে চান। তার গত দশ বছরের বাস্তবতায় এটা কি সম্ভব?
ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য চলছে, ব্যাংকের উদ্যোক্তারা যা চাচ্ছেন, তা-ই পাচ্ছেন। তারা তাদের পক্ষে আইন করে নিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করেছে সিআরআর কমিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতে। অর্থমন্ত্রী এবার বাজেটেও নিবন্ধিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট সুদের হার আড়াই শতাংশ কমিয়ে আরও বেশি কিছু অর্থ হাতানোর সুযোগ করে দিলেন তথাকথিত ব্যাংক মালিকদের। এখানে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে ১০০০ কোটি টাকার মতো, যার পুরোটাই যাবে ব্যাংকের মালিকদের পকেটে।
এই কর হার কমানোর কোন সুবিধা পাবেনা ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা কিংবা সঞ্চয়ীরা। ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য না কমিয়ে শুধু মালিকদের স্বার্থ দেখলে হয়তো বড় বিপর্যয়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কর্পোরেট কর হার কমানো প্রয়োজন সব খাতে যেন আমাদের বিনিয়োগকারীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে। কিন্তু আর্থিক খাতকে দেয়া এই সুবিধা কোন উপকার করবে না বিনিয়োগকারীদের। বরং তাদের ভোগান্তি বাড়াবে। সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিবে অধিক হারে। এমনিতেই চলছে তারল্য সংকট। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ কমবে যা চূড়ান্ত বিচারে ব্যক্তিখাতের উৎপাদনশীলতা ও ব্যবসার খরচ বাড়াবে।
ধনিদের প্রতি সদয় দৃষ্টির আরেক প্রস্তাবনা দেখা গেলো আবাসন খাতে। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে ফ্ল্যাটের দামের ওপর মূল্য সংযোজন করের হার পুনর্নির্ধারণ করেছেন। এত দিন ১১০০ বর্গফুট আয়তনের ছোট ফ্ল্যাটের মূল্যের ওপর ভ্যাটের হার ছিল দেড় শতাংশ। অন্যদিকে ১১০১ থেকে ১৬০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটে ভ্যাট ছিল আড়াই শতাংশ। এই দুটি মিলিয়ে ভ্যাটের দাম ২ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে ছোট ফ্ল্যাটে আধা শতাংশ ভ্যাট বেড়েছে, অন্যদিকে মাঝারি ফ্ল্যাটে আধা শতাংশ কমেছে। বড়লোকরা যে বড় ফ্ল্যাট কেনে তার ক্ষেত্রে ভ্যাটের হারে হেরফের হয়নি।
মধ্যবিত্তের ব্যবহার্য আসবাবপত্রের দাম বাড়তে চলেছে, কারণ অর্থমন্ত্রী তার উৎপাদন ও বিক্রি, উভয়ের ওপরই ভ্যাট আরোপ করেছেন। আসবাবপত্র উৎপাদনের উপর ৬ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করেছেন ভ্যাট আর বিক্রির বেলায় ভ্যাট প্রস্তাবনা করেছেন ৫ শতাংশ যা বর্তমানে আছে ৪ শতাংশ।
সব ধরনের আমদানি পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম ভ্যাট আরোপ করেছেন যা এতদিন ছিল ৪ শতাংশ। আমাদের মুদ্রা বিনিময় হারের সমস্যায় এমনিতেই আমদানিকারকরা বেশি দামে পণ্য কিনছেন। এক মার্কিন ডলার এখন আর ৮০ টাকায় নেই, হয়ে গেছে ৮৩ টাকারও বেশি।
কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যারা পাঠাও বা উবারে চলেন, সেইসব মধ্যবিত্তের জন্য খারাপ খবর হল যে, অর্থমন্ত্রী এসব রাইড শেয়ারিং-এর ওপর ৫ শতাংশ হারের ভ্যাট দিয়েছেন। তামাকজাত দ্রব্যের দাম বাড়ানোকে ভাল বলতেই হবে। তবে নির্বাচন সামনে বলে হয়তো বিড়িতে হাত দেননি তিনি, যেটার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। মধ্যবিত্তকে আক্রমণ করার আরেক দৃষ্টান্ত অনলাইন নির্ভর নতুন ব্যবসা-উদ্যোগসমূহকে কর-ভ্যাটের চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয়া।
বরাবরের মতোই অর্থমন্ত্রী সরকারি ব্যাংক সমূহের দুর্নীতি ও সরকারি ব্যাংকের অদক্ষতাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এবারও তিনি জনগণের পকেট থেকে নিয়ে এসব চরম অদক্ষ ও আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জ সরকারি ব্যাংক গুলোর জন্য ২০০০ কোটি টাকা পুঁজি পুণর্গঠনের প্রস্তাব করেছেন।
অর্থমন্ত্রী ৭.৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত করেছেন। অনেকদিন ধরেই এই বড় প্রবৃদ্ধির ঘরে আমাদের বিচরণ। কিন্তু প্রবৃদ্ধির মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরে সরকারের দাবি করা ৭.৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সাথে একমত নয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, অবকাঠামোয় ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু কত টাকা ব্যয় করে, কত সময়ে কী পাচ্ছি আমরা সে এক বড় প্রশ্ন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করার পর ফলাফল হলো এখন রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম যেতে একদিন লেগে যায়। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দুই ঘণ্টার রাস্তা পার হতে ৬ ঘণ্টা লাগে। বড় প্রকল্প পদ্মাসেতুর খরচ ও সময় দু’টিই কেবল বেড়ে চলেছে। তাই বিষয়টা শুধু প্রকল্প করা নয়, প্রকল্পের ফলাফল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বড় প্রবৃদ্ধি যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেনা সেটিও বড় মাথা ব্যথা। সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি নেতিবাচক। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার শুধু বেড়েই চলেছে। আবার যারা শিক্ষিত তাদের শিক্ষার মান এমন এক জায়গায় গেছে যে, দেশীয় বড় কোম্পানিগুলো বড় পদগুলো পূরণ করছে বিদেশি কর্মী দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর এসব বিদেশি কর্মীর বেতন বাবদ প্রায় ৭০০ কোটি ডলার চলে যাচ্ছে বলে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে।
মানুষ বাড়ছে, অর্থনীতির আকার বাড়ছে। বড় বাজেট হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন না হলে বড় বড় করে লাভ কি? গত বছর প্রচেষ্টার পরও ৮০ থেকে ৮২ শতাংশের বেশি ব্যয় সম্ভব হয়নি। এখন পদক্ষেপগুলো নিলে বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্য হারে পূরণ হওয়া সম্ভব। বাজেটে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৫ দশমিক ৬ ঠিকই নির্ধারণ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন। বিরাটসংখ্যক তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই কর্মে নিয়োজিত রাখতে হবে। অর্থমন্ত্রী স্বশাসিত এবং স্বয়ম্ভর জেলা সরকারের ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন এটি ইতিবাচক। স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। উন্নয়ন তাহলেই জনমানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছাবে। সর্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। কৃষিতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাবও ইতিবাচক। বাজেট উচ্চাভিলাষী হোক, কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য হোক। তার সামর্থ্য ও সক্ষমতা আসুক।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম