কৃষকের মুখে হাসি ফুটুক

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ০৪ জুন ২০১৮

কয়েকদিন আগে একদিনের জন্য কুমিল্লা গিয়েছিলাম। এক ফাঁকে এক বেলার জন্য আমার অনেক স্মৃতিবিজড়িত লালমাই গিয়েছিলাম বন্ধু কাশেমের বাড়িতে। সেখানে যাওয়ার পথে দিগন্তবিস্তৃত সোনালী ধানের ক্ষেত দেখে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। কল্পনায় কৃষকের মুখে হাসি দেখতে পেয়েছিলাম।

ঢাকায় ফিরে সেই ধান ক্ষেতের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম, সাথে লিখেছিলাম কৃষকের মুখের কাল্পনিক হাসির কথা। ফেসবুকে কয়েকজন বন্ধু আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, এ হাসি সত্যি নয়, সত্যিই কাল্পনিক। কৃষকের মুখে আসলে হাসি নেই। কয়েকটি যৌক্তিক কারণও তুলে ধরলেন তারা। আগাম বন্যা না হলেও হঠাৎ বৃষ্টি বিপাকে ফেলেছিল কৃষকদের। বাতাসে কোথাও গাছ নুয়ে গেছে, কোথাও পানি আটকেছে, বৈরী আবহাওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

আবার পাকা ধান ক্ষেতে রেখে কৃষকের চোখে ঘুমও আসে না। আর কষ্টেসৃষ্টে ধান কেটে ঘরে আনতে পারলেও ঘন ঘন বৃষ্টিতে শুকানোর ফুরসত পাচ্ছেন না। খোঁজখবর নিয়ে বাস্তবতাটা জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি আসলে গোলাপ দেখেছি, তার কাটা দেখিনি; মেহেদী পাতার ওপরের সবুজটা দেখেছি, ভেতরের রক্তাক্ত ক্ষতটা দেখিনি; মাঠের সোনালী ধান দেখেছি, কৃষকের ভেতরের কান্নাটা দেখিনি। তবে আমাদের এই হা হুতাশে কৃষকদের কিচ্ছু যায় আসে না।

আমাদের এইসব আলগা আবেগ নিয়ে ভেবে নষ্ট করার মত সময় আসলে তাদের নেই। তারা আমাদের মত ভঙ্গুর নয়। বছর বছর ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা-খরার সাথে লড়াই করে তাদের টিকে থাকতে হয়। আমি জানি যত কষ্টই হোক, ক্ষেতের ফসল তারা গোলায় তুলেছে। কিন্তু আসল সঙ্কট শুরু হয় এরপর। পত্রিকার পাতা ওল্টালেই এখন দেখা যায় ‘ধানের দাম না পেয়ে কৃষক হতাশ’ ধরনের সংবাদ।

শুধু এবার নয়, প্রতিবছর বোরো ধান ওঠার সময় হলেই পত্রিকায় শিরোনাম হয় ‘এক মণ ধানে এক কেজি গরুর মাংস’, ‘এক মণ ধানে একটা ইলিশ মাছ’। এ ধরনের সংবাদ পত্রিকার ভেতরের পাতায় বা পেছনের পাতায় ছাপা হয়। আগে ‘পানির দরে ধান’ এ ধরনের শিরোনাম দেখা গেলেও এখন তা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ কখনো কখনো ধানের দাম বোতলজাত পানির চেয়েও কম। এই সংবাদগুলোর কৌতুকটাই আমাদের চোখে পড়ে, পেছনের কান্নাটা আমরা দেখতে পাই না।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের অগ্রগতির, সাফল্যের বড় কৃতিত্ব কৃষকদের। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলান বলেই আমরা পেটপুড়ে খেয়ে বড় বড় বক্তৃতা দিতে পারি, শহরে বসে রাজা-উজির মারতে পারি। মাঠের পর মাঠভর্তি ধানের ক্ষেতে সোনালী ঢেউ দেখে আমরা আপ্লুত হই। দেশাত্মবোধক গান গাই। কিন্তু ভেবে দেখি না, এই সোনালী ঢেউ কৃষকের কতটা হাহাকার বয়ে বেড়ায়।

বাংলাদেশে সবকিছুর দাম বাড়ে, খালি ধানের দাম কমে যায়। ধানের দাম আসলে খুব স্পর্শকাতর ইস্যু। ধানের দাম বেশি বেড়ে গেলে অস্থিরতা তৈরি হবে সারাদেশে। আর ধানের দাম কমে গেলে মরে যাবে কৃষক। এ এক অভেদ্য চক্র। এই ভারসাম্যটা ধরে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই সরকারের দায়িত্ব বেশি। সময়মত সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

গতবছর অকাল বন্যায় হাওর এলাকায় ধান তলিয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছিল বাজারে। তাতে হাহাকার শুরু হয়েছিল সারাদেশে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার দ্রুত চালের আমদানী শুল্ক ২৭ শতাংশ থেকে শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছিল। তাতে উৎসাহ পেয়ে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাপকভাবে চাল আমাদানিতে নামেন। ঘাটতি ছিল ১০ লাখ টন, আমদানী হয়েছে ৮২ লাখ টন। পাইপলাইনে আছে আরো ৪৫ লাখ টন। অঢেল চাল থাকায় বাজার এখন পড়তি।

ব্যবসায়ীরা প্রাপ্য ঋণের টাকা দিয়ে চাল আমাদানী করে ফেলেছেন। তাই তাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। গতবছর দাম বেড়ে গিয়েছিল বলে সরকার শুল্ক মওকুফ করেছিল। কিন্তু এবার বোরোর বাম্পার ফলনের খবরে আগে থেকেই তো সরকারের আবার শুল্ক আরোপ করা উচিত ছিল। এটুকু সুরক্ষা না দিলে কৃষকরা বাঁচবে কিভাবে?

প্রকৃতির সাথে কৃষকরা লড়তে পারে। কিন্তু বাজারের কূট কৌশলের সাথে পারে না, মজুদদারদের সাথে পারে না। এখানেই সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে সহমর্মিতা নিয়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অবশ্য সরকার দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে। ২ মে শুরু হওয়া এ অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

এই সময়ে ৩৮ টাকা কেজি দরে নয় লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ২৬ টাকা কেজি দেড় লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্য সরকারের। এই পুরোটাই যদি সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কেনা যেতো, তাহলে সত্যি সত্যি তাদের মুখে হাসি ফুটতো। কিন্তু এখানেই মার খেয়ে যায় কৃষকরা। সরকারের গুদাম পর্যন্ত যেতে পারে না প্রান্তিক কৃষকরা। চাতাল মালিক আর মধ্যস্বত্বভোগীরা খেয়ে নেয় লাভের গুড়টুকু।

ধানের দাম কমে যাওয়ার সুফল যদি সাধারন মানুষ পেতো, তাও না হয় সান্তনা মিলতো। কিন্তু ধানের কম দামের পুরো মুনাফাটা যায় মজুতদারের পকেটে। মৌসুমের শুরুতে যখন ধানের অঢেল সরবরাহ, তখন পড়ে যায় দাম। কষ্ট করে কয়েকদিন রাখতে পারলেই ভালো দাম পাওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকরা নানারকমের ঋণ নিয়ে ফসল ফলান। তাই তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না, ধান ধরে রেখে লাভ করার। মজুতদাররা অল্প দামে ধান কিনে বেশি দামে বিক্রি করে। তাই লাভটা না যায় কৃষকের পকেটে, না যায় সাধারন মানুষের পেটে। খালি আরো পোক্ত হয় মজুতদারের সিন্দুক।

বীজ সংগ্রহ, বীজতলা তৈরি, চারা রোপন, সেচ, সার- ধান চাষের ধাপে ধাপে টাকা লাগে। সরকার সেচ, সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের পাশে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা যথেষ্ট হয় না। পুরো মারটা যায় কৃষকের ওপর দিয়ে। এবার কৃষকদের ধান বেঁচতে হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে।

একবার বন্যায় ফসল তলিয়ে যাবে, একবার লসে ধান বেঁচতে হবে। তাহলে এই কৃষকরা বেঁচে থাকবে কিভাবে? ধান ফলাবে কেন? আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ধান চাষটা কৃষকদের নেশার মত। নিশ্চিত লস জেনেও অনেকে যেমন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। কৃষকরা তেমনি নিশ্চিত লস জেনেও ধান চাষ করে। আমি খালি অবাক হই, বারবার পুঁজি খোয়ানোর পরও তারা টিকে থাকে কিভাবে? তারপরও কৃষকরা বছরের পর বছর ফসল ফলান কেন? কারণ তাদের আর কিছু করার নেই।

একবছর কিছুটা লাভের মুখ দেখলে সেটা আকড়ে ধরেই স্বপ্ন দেখেন আগামী বছরের। কিন্তু পরের বছরই আবার ধাক্কা খায়। ফলে তারা কখনোই মাথা তুলে দাড়াতে পারে না। আমি ঠিক জানি না, আমরাই এই চক্রটা এভাবে সাজিয়ে রেখেছি, যে কৃষক খালি মাখার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের পেটের ভাত জোগাড় করবে, আর আমরা শহুরে বাবুরা খালি তাদের পেটে লাথি মেরে যাবো? বারবার এত ধাক্কা খাওয়ার পরও যে তারা ফসল ফলান, এ জন্য তাদেও প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। তাদের অদম্য মনোবলকে আমার নতমস্তক কুর্ণিশ।

বাংলাদেশের জমি কম, মানুষ বেশি। আমাদের বিজ্ঞানীরা নানা জাতের উচ্চফলনশীল ধান আবিস্কার করেছেন। আর কৃষকরা মাঠে তা ফলিয়ে নিশ্চিত করছেন অতি জরুরী খাদ্য নিরাপত্তা। মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধানের উৎপাদন। ব্যাপারটি এত অনায়াস আর অবশ্যম্ভাবী মনে হয় যে আমরা ধরেই নিয়েছি বছরের পর তাদের পেটে লাথি মারবো, প্রান্তিক কৃষক আরো প্রান্তে চলে যাবে, আর আমরা আরাম করে খাবো। কিন্তু কৃতজ্ঞতার ঢেকুরটুকুও তুলবো না।

আমরা শহরের মানুষেরা ‘এক মণ ধানে এক কেজি গরুর মাংস’ পড়ে, পত্রিকাটি পাশে রেখে অনায়াসে উঠে যাই। ভাবিই না, কিভাবে কৃষকদের বাঁচানো যাবে, কিভাবে বাম্পার ফলনের সুফলটা, মাঠের সোনালী ঢেউটা তাদের মুখেও ছড়িয়ে দেয়া যাবে। কিভাবে মজুদতার আর মধ্যস্বত্বভোগীদের কবল থেকে লাভের অঙ্কটা কৃষকের জেবে পুড়ে দিতে পারবো। পেটে খেলে পিঠে সয়, এই প্রবাদটা যে কৃষকের ক্ষেত্রেও সত্যি, এটা আমরা বুঝতেই চাই না। যেন কৃষকদের পেট পিঠ কিছুই নেই, থাকতে নেই।

provash

৩ জুন, ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

‘প্রকৃতির সাথে কৃষকরা লড়তে পারে। কিন্তু বাজারের কূট কৌশলের সাথে পারে না, মজুদদারদের সাথে পারে না। এখানেই সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে সহমর্মিতা নিয়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।