মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : খোলা ছিল সকল দরোজা জানালা

ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম
ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম , অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৯:২৮ এএম, ০১ জুন ২০১৮

সম্প্রতি ক্রসফায়ার কিংবা এনকাউন্টারে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় এক’শর কাছে পৌঁছেছে। নিহতদের প্রত্যেককেই একাধিক মামলার আসামী হিসেবে পুলিশের পক্ষ থেকে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। নিহত কারো কারো নামে ডজন ডজন মামলা নথিবদ্ধ আছে বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- হচ্ছেও।

পুলিশের একথা আমরা মেনে নিলে বাস্তবতার যে চিত্র আমরা অনুধাবনে সক্ষম হই তা হলো নিহত দাগী ও এজাহারভুক্ত এসব আসামীর প্রত্যেকেই মাদক ব্যবসা, মাদক দ্রব্য আমদানি রপ্তানি কিংবা পাচারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই লিপ্ত ছিলেন। সাধারণের প্রশ্ন হলো তাহলে পূর্বে কথিত সেই মাদক ব্যবসায় বা আমদানি রপ্তানিতে নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং অবস্থাদৃষ্টে বলা চলে মাদক ব্যবসায়ীদেরকে উৎসাহ যোগানো হয়েছিল বলেও ধরে নেওয়া যায়।

তাই যদি না হবে তবে হঠাৎ করেই দেশব্যাপী মাদকের এতটা বিস্তার সম্ভব হতো না, জেলায় জেলায় এত মাদক ব্যবসায়ীর অস্তিত্বও দেখা যেত না। পুলিশকেও একের পর এক বিনা বিচারে হত্যা, ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের এসব অভিযোগ হজম করতে হতো না। এখন কেউ কেউ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন বিনা বিচারে হত্যারও। চলমান মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকলে এ লেখা মুদ্রণের আগেই ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ মৃতের সংখ্যা এক’শ পেরোবে।

এক সময়- উনিশ’শ আশির দশকে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন বস্তিতে বিভিন্ন রকমের অস্ত্রের যেমন মজুদ গড়ে উঠেছিল শুনেছিলাম সাম্প্রতিককালে সেসব বস্তি নানা প্রকারের নেশা জাতীয় দ্রব্য তথা মাদকে মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। সেই একই সময়ে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলসমূহ ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। আর সাম্প্রতিককালে সেসব হলসমূহও নেশা জাতীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ সামগ্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে গছে কি না তা ভালো করে খতিয়ে দেখবার সময় এসেছে!

আমাদের কাছে কোন পরিসংখ্যান নেই, সন্দেহও করি না বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ মাদকের আখড়ায় পরিণত হবে। তবে, পুরোনো সেই আশংকা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে মনের গহীনে, গোপনে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান, অভিযানে নিহতের সংখ্যা আর মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত চুনোপুঁটি থেকে শরু করে রাষ্ট্রের কোন কোন রাঘব বোয়ালদের জড়িত থাকবার যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে তা ভয়ের উদ্রেক করে।

আমাদের প্রশ্ন হলো দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের তরুণ সমাজ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদক ও নেশা জাতীয় বিভিন্ন দ্রব্যের মাত্রাহীন বিস্তার ঘটবার পর এ ধরনের অভিযান কেন? আরো আগে কেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না?

আমাদের জানা মতে এদেশে ব্যবহৃত মাদকের সিংহভাগই আসে বিভিন্ন সীমান্ত পথে। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক মাদক বিস্তারের ঘটনায় সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়েও ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে! সীমান্ত রক্ষীদের নজর এড়িয়ে কী করে মাদকের বড় বড় চালান দেশের ভেতর প্রবেশ করে তা এক বিস্ময়ও বটে! বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে মাদকের ওপর রয়েছে সামাজিক, ধর্মীয় এবং আইনি নিষেধাজ্ঞা সেখানে মাদকের বিস্তার শুধু বিস্ময়করই নয় ভয়ংকর বার্তাও বহন করে আনে।

সেই ভয়ংকরতার করাল গ্রাস থেকে আমরা কী আমাদের তরুণদের মুক্ত রাখতে সমর্থ হবো? মাদকের বড় বড় চালান দেশের ভেতর দৃশ্যমান হওয়ায় আমাদের মনের ভেতর অজস্র প্রশ্ন জাগে নিরন্তর- তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, আমাদের সীমান্ত পথ দীর্ঘদিন অরক্ষিত অবস্থায় ছিল? নাকি সর্ষের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভূত বা ভূতেরাই চোরাকারবারীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে অন্ধকার জগতে।

আর তাদের লোভ-লালসার শিকারে পরিণত আমাদেরই যুবসমাজ? প্রশ্ন জাগে সামান্য অর্থলাভের বিনিময়ে কিংবা মাফিয়া ডনদের ভয়ে চোরাকারবারিদের সাথে সখ্য গড়ে তোলে সীমান্তের সকল দরোজা জানালা খুলে রেখে দিয়েছিলেন দায়িত্ব প্রাপ্তরাই! কোন কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও মাদক পাচারের অভিযোগ উঠেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ! যাদের কাছে জাতির সুরক্ষার দায়িত্ব তারাই যদি জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ তরুণ সমাজকে বিপথে চালিত করে তবে ক্রস ফায়ার বা এনকাউন্টারে সবার আগে তাদেরই বিচার হওয়া উচিৎ বলে আমরা মনে করি।

বছরের পর বছর ধরে সমগ্র দেশকে মাদকের নীল রসে ডুবিয়ে সাম্প্রতিকের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এক বিলম্বিত প্রয়াস। তবু, সে যুদ্ধ শুরু হয়েছে এটা আশার কথা। কিন্তু আমরা এই যুদ্ধ থেকে সমগ্র দেশের ভেতরকার মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদক দ্রব্য সকলেরই মূলোৎপাটন চাই।

একটি জতির ভবিষ্যৎ নাগরিক দেশের তরুণ সমাজ। আর এই তরুণ সমাজ যখন নেশাগ্রস্ত ও বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে তখন সেটা কারো কাম্য হতে পারে না। বিশেষ করে দেশ যখন উন্নয়নশীল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, যখন আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পদার্পণের চিন্তা করে নানামুখী কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হওয়ার বাসনায় নানামুখী পরিকল্পনা করছি তখন যদি আমাদের দেশের তরুণরা নেশায় বুঁদ হয়ে ঘাড় গুঁজে অলস পড়ে থাকে তখন তা বড় বেশি বেমানান ঠেকে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

মাদক আসা যাওয়ার সকল দরোজা জানালা বন্ধ করে তরুণ সমাজকে উদ্যমী করে গড়ে তোলবার সময় বয়ে যায়। শুধু ক্রস ফায়ার বা এনকাউন্টারে দাগী আসামীর বিনষ্টিই নয়- তরুণ সমাজকে এই বার্তা দিয়ে তাদেরকে উজ্জীবিত করার দায়ও নিতে হবে পুলিশকেই। দেশের সকল তারুণ্যকে পুলিশকেই বুঝাতে হবে যে, সময় নষ্ট করার সময় আমাদের হতে আর নেই।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/পিআর

শুধু ক্রস ফায়ার বা এনকাউন্টারে দাগী আসামীর বিনষ্টিই নয়- তরুণ সমাজকে এই বার্তা দিয়ে তাদেরকে উজ্জীবিত করার দায়ও নিতে হবে পুলিশকেই। দেশের সকল তারুণ্যকে পুলিশকেই বুঝাতে হবে যে, সময় নষ্ট করার সময় আমাদের হতে আর নেই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।