মাদকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এবং ব্রিটেন প্রসঙ্গ

ফারুক যোশী
ফারুক যোশী ফারুক যোশী , প্রবাসী সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:১১ এএম, ২৯ মে ২০১৮

বিবিসি’তে ‘ইল গটেন গেইনস’নামের একটা অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। অনেকটা ‘ক্রাইম ওয়াচে’র মত। কিন্তু এ অনুষ্ঠানের বিশেষত্বটা হলো, এখানে শুধু ক্রাইম তোলে ধরাই হয় না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সংযুক্ত থাকে এই রিপোর্টগুলোর সাথে। এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সহযোগিতায় অর্থাৎ সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে অপরাধীদের নিয়ে আসা হয় আইনের আওতায়।

এ অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয় বিভিন্ন ধরনের অপরাধের চিত্র। ইনস্যুরেন্স কিংবা ভুয়া বীমা নিয়ে নাগরিকদের সাথে প্রতারণা , অর্থ পাচার, মানব পাচার, ড্রাগ পাচার কিংবা বাজারজাতকরণ প্রভৃতির মাধ্যম যারা লাখ লাখ পাউন্ড কামাই করে, তাদের জনসমক্ষে নিয়ে আসে এই অনুষ্ঠান। এবং পুলিশের সহায়তায় এদের অবশেষে উঠতেই হয় আদালতের কাঠগড়ায়। যেতে হয় কারাভ্যন্তরে।

অবৈধভাবে কিংবা প্রচণ্ড অসাধুভাবে যারা অর্থ উপার্জন করে এই ব্রিটেনে, তাদের একটা পরিকল্পনাই থাকতো আগে। তারা জানত, তাদের চতুর্দিকে জাল, এ জাল তারা ভেদ করতে পারবে না। ধরা পড়তেই পারে তারা। একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকত, ধরা পড়ে জেলে যাবে। তারপর হয়ত পাঁচ-দশ বছর পর ফিরে এসে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের ব্যবহার তারা করবে আগের মতই। বিশেষত ড্রাগ বা মাদক ব্যবসায় যারা জড়িত, এদের কোন না কোনভাবে একটা চেইন থাকে। কারণ মাদক ক্রেতাদের জন্যে বিক্রেতা প্রয়োজন। যেহেতু অর্থ উপার্জনের প্রধান মাধ্যমই হলো কাস্টমার কিংবা গ্রাহক।

ব্রিটেনে এসব গ্রাহকদের সংখ্যা কম নয়। সৌখিন মাদক সেবী থেকে শুরু করে নেশাবাজরা আছেই। সুতরাং সারা বিশ্বের মতোই ব্রিটেনেও মাদক একটা প্রধান সমস্যা। যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এই ড্রাগ এখানেও। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই মূল মানুষটাকেই টার্গেট করে, চুনোপুটিদের (মূলত বিক্রেতা) তারা তাদের লক্ষ্য হিসেবে নেয় না। বরং এই চুনোপুটিদের ব্যবহার করে এরা তাদের সোর্স হিসেবে। এদেরও হয়ত জেলদন্ড হয়, তবে মূলত এ মূল নিয়ন্ত্রক কিংবা বস্দেরই দীর্ঘ সময়ের সাজা ভোগ করতে হয়।

ব্যবসায়ীরা তাই তাদের সাজা প্রাপ্তির বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে জেলে যাবার সম্ভাবনা সামনে রেখেই তাদের অনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে যেত পূর্বে। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে এরকম শুধু সাজাপ্রাপ্তি কিংবা জেলদন্ডটাই কার্যকর হচ্ছে না, বরং অপরাধীদের বেড়েছে নতুন শংকা। কারণ এখন অপরাধীদের বিশাল সম্পত্তিতে তাদের আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের বাড়ি-গাড়ি-স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এমনকি প্রমাণ সাপেক্ষে বেনামী সম্পত্তিওে হানা দেয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

একদিকে জেলদন্ড, অন্যদিকে একে একে নিয়ে আসা হয় সকল সম্পত্তি। ইনস্যুরেন্স,মানব পাচার, অর্থ পাচার প্রভৃতি করে যারা অর্থ কামায় এবং এদের এই অনৈতিক ব্যবসার ফাঁদে পড়ে যারা অনেক কিছুই হারায়, পুলিশ এদের খোঁজে এবং খোয়া যাওয়া অর্থ তারা এই ফান্ড থেকে ভিকটিমদের ফিরিয়ে দেয়। দেখা গেছে বিবিসি’র ঐ রিপোর্টের মধ্য দিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা শুধু ২০১৬ সালে ২০১ মিলিয়ন পাউন্ড উদ্ধার করেছে। এবং এর একটা অংশ ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত ভিকটিমদের। বাকি অর্থ যায় সরকারি কোষাগারে। এ অর্থ থেকে কমিউনিটিতে অনুদান দেয়া হয়, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে সহায়তা দেয়া হয় অর্থাৎ উদ্ধার করা বিশাল অংকের অর্থের কোন অপচয় হয় না। খোয়া যাবারতো প্রশ্নই উঠে না।

২) ব্রিটেনে এই মাদক সমাজের অন্যান্য ব্যাধির মতো একটা ব্যাধিই। এই সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রয়োজনীয় সংস্থা আছে। সামাজিক সমস্যার মতই এটাকেও ধরে নেয়া হয়। কিন্তু এই যে প্রয়োজনীয় সংস্থাগুলো, তারাই যার যার কাজ চিহ্নিত করে, এবং সমস্যার উৎসের সন্ধান করে। তবে এ কথার অর্থ এই না যে, দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে পেরেছে তারা একেবারে।

যেখানে মনুষ্য সমাজ আছে, সেখানে কিছু মানুষতো লোপাট-জোচ্চুরি-অনৈতিকতায় থাকতেই পারে। এগুলো আছে বলেই একটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার প্রয়োজন পড়ে। একটা সমাজ থেকে একেবারে দুর্নীতি হয়ত নিঃশেষ করা যায় না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের নিরাপত্তা দেয়াতো রাষ্ট্রের অন্যতম একটা দায়িত্ব। এবং সেজন্যে নাগরিকরা নিরাপত্তা ট্যাক্সও দিয়ে থাকেন। ব্রিটেনেও আছে অন্যান্য দেশের মত সব সংস্থাই।

সমালোচনা আছে, তবুও নাগরিক নিরাপত্তার জন্যে আছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। সেজন্যেই দেখা যায় মাদক ব্যবসার সাথে সংযুক্ত থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড কামাই করলেও ম্যানচেষ্টারের একজন মহিলা যিনি পেশায় ছিলেন একাউটেন্ট, তার জেলদন্ডের পাশাপাশি মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়ি, লাখ পাউন্ডের গাড়ি যেমন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, ঠিক তেমনি মানব পাচারের দায়ে এক অসাধু ব্যবসায়ীর লাইটওয়েট বিমান পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করে নিলামে তোলে দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ নিয়ে আসা হয়েছে।

এটাই রাষ্ট্র। সমাজ-রাজনীতির প্রয়োজনে রাষ্ট্র এভাবেই উদ্যোগ নেয়। অপরাধ কমিয়ে আনতে নতুন নতুন পথ খোঁজে। কারণ জনগণতো সেজন্যেই নেতা নির্বাচিত করে। সরকার গঠিত হয় জনগণের কল্যাণের জন্যেই।

৩) বাংলাদেশে সম্প্রতি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে। প্রতিরাতেই মরছে মানুষ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এরা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। এবং এদের সবারই না-কি বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে থানায়।

কে মাদক সেবী নয়, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আছে মাদক সেবনের অভিযোগ। যুব সমাজের এক বিরাট অংশতো ধুঁকছে। নেশায় ঝিমুচ্ছে। বাড়ছে সন্ত্রাস। আর সেকারণেই সরকারের এ যুদ্ধনীতিতে সাধারণ মানুষের সমর্থনতো থাকবেই। কিন্তু কি দেখছি আমরা।

বাংলাদেশে ঘুষ যেমন এখন খোলাসা, মাদক ব্যবসাও যেন ঠিক তেমনি উন্মুক্ত। অতি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তালিকা প্রকাশ করেছে ৬ শত মাদক ব্যবসায়ীর। চাউর হয়েছে, এমপি , সাবেক এমপি থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার কিছু চেয়ারম্যান কিংবা মেয়র-কাউন্সিলার সরাসরি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। তবে এরা কেউই প্রকাশ্যে নন।

হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেছেন, সংসদে মাদক ব্যবসায়ীরা আছেন। তাহলে যুদ্ধটা আমাদের কাদের বিরুদ্ধে করতে হবে। থানায় মামলা আছে, এই অভিযোগে মাদক বিক্রেতাকে ক্রসফায়ারে তোলা হচ্ছে। অথচ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, সারা বাংলাদেশের মানুষ জানে, মাদক পাচার মাদক ব্যবসা করে কোন্ সাংসদ কিংবা তার সারা পরিবার কত শত-সহস্র কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচ কি তাদের লোমটাও স্পর্শ করতে পারে না।

এত শত অভিযোগ থাকার পরও একজন সাংসদকে কি প্রধানমন্ত্রী ডেকে পাঠাতে পারেন না। সরকারের ইমেজের দিকে চেয়ে অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের সংসদ থেকে অব্যাহতি কি দেয়া যায় না। বরং এরা সংসদে টিকে থাকলে কিংবা জনপ্রতিনিধি থাকলে সরকারই ইমেজ সংকটে পড়বে কিংবা পড়ছে। শুধু সরকারি দল নয়, বিরোধী দলেরও অনেকেই এই ব্যবসার সাথে জড়িত বলে খবর বেরুচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকার কারণে অ্যাকশন নেবেই সরকার কিংবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু যদি সরকারি দলের এমপি কিংবা জন প্রতিনিধিদের এড়িয়ে গিয়ে শুধু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা হেনস্থার শিকার হন, তাহলেতো সরকার নতুনভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।

পৃথিবীর যেখানেই হোক, মাদক ব্যবসায়ীরা কাঁচা অর্থ কামায়। আর সেকারণে এরা সমাজের কিংবা রাজনীতির লাইমলাইটে আসতে পারে না। বিলাসী জীবন নিয়ে একটা শংকা-সংকটের মধ্যেই এদের কাটাতে হয় সময়। পশ্চিমের দেশগুলো কিংবা আইন-শৃঙ্খলা মোটামুটি উন্নত থাকা দেশগুলোতে লোকমুখে চাউর হওয়া কিংবা অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ী কেউ অন্তত আইন প্রণেতা হতে পারে না।

এমনকি এদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হবারও সুযোগও নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। দেখা যাচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের একটা বড় অংশ এই অনৈতিক পেশার সাথে জড়িয়ে গেছেন। সেজন্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায় প্রশ্নটা আমাদের মাঝে ঘোরপাক খায়, এরা কি সবাই-ই ‘বদীর মতই গরীবের বন্ধু’?

৪) বাংলাদেশে যেভাবে জন প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে, এতে মনে হচ্ছে সারা দেশটাই যেন ঝিমুচ্ছে। কিন্তু একসাথে এত মানুষের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারবে কি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কারণ পরে যদি লোম খোঁজতে গিয়ে কম্বলই উজাড় হয়ে যায়, এই শংকাতো উড়িয়ে দেয়া যায় না।

সরকারের এই যে যুদ্ধংদেহী উদ্যোগ, তা জনমনে স্বস্তি আনতেই পারে। মাদক ব্যবসায়ীরাও হয়ত একটু নড়ে চড়ে বসবে। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের এখন দ্রুত পর্যবেক্ষণ করার সময়। ব্রিটেনের মতোই নতুন কোন আইন নিয়ে আসা সময়ের দাবি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যারা শত-সহস্র কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন, সমাজ-রাজনীতিকে যারা কলুষিত করছেন,অবৈধভাবে উপার্জিত এদের অর্থ-সম্পত্তিতে সরকারকে হাত দিতে হবে।

আগামী নির্বাচন অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের প্রভাব মুক্ত করতে হবে। কালো টাকার বলয় থেকে বের করে নিয়ে এসে রাজনীতিকে করে তুলতে হবে রাজনীতিকদের প্লাটফরম, তবেই হয়ত সকল দুর্বৃত্তায়ন থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে পারবে সমাজ আর বাংলাদেশ নাম রাষ্ট্রটি। কারণ দুর্বৃত্তায়ন জিইয়ে রেখে উন্নয়নের জোয়ারের শ্লোগান গল্পের মতই শোনায়।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/পিআর

সরকারের এই যে যুদ্ধংদেহী উদ্যোগ, তা জনমনে স্বস্তি আনতেই পারে। মাদক ব্যবসায়ীরাও হয়ত একটু নড়ে চড়ে বসবে। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের এখন দ্রুত পর্যবেক্ষণ করার সময়। ব্রিটেনের মতোই নতুন কোন আইন নিয়ে আসা সময়ের দাবি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যারা শত-সহস্র কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন, সমাজ-রাজনীতিকে যারা কলুষিত করছেন,অবৈধভাবে উপার্জিত এদের অর্থ-সম্পত্তিতে সরকারকে হাত দিতে হবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।