রাজকীয় বিয়ে ও প্যালেস্টাইনের শিশু

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ২৩ মে ২০১৮

দুটি ঘটনা। আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম দখল করে আছে এ দুটি ঘটনাই। একটি হলো রাজকীয় বিয়ে। ব্রিটেনের ছোট রাজপুত্র হ্যারি ও মার্কিন সেলিব্রিটি মেগান মার্কেলের বিয়ে নিয়ে মিডিয়া সরগরম। এই রাজকীয় বিয়েতে কোন কোন সেলিব্রিটি এলেন, কে দাওয়াত পেলেন, কে না পেয়ে মনক্ষুণ্ণ হলেন সেসব নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই।

আরও মাতামাতি চলছে মেগানের বিয়ের পোশাক কে ডিজাইন করেছেন, কেট মিডলটনকে বিয়েতে কেমন দেখা গেছে, হ্যারি মেগানকে দেখে কতটা আবেগ আপ্লুত হয়েছেন সেসব খুঁটি-নাটি নিয়ে। বিয়ের কেক, তার রেসিপি, তার ফ্লেভার এসব পড়ে যার যার জিভের জল সামলাচ্ছেন আমজনতা। মিডিয়াগুলো হিসেব কষছে হ্যারি-মেগানের বিযেতে কত খরচ হলো সেই তথ্য।

নিরাপত্তা বাবদই নাকি ব্যয় হচ্ছে তিন কোটি পাউন্ডের বেশি। পশ্চিমা মিডিয়ার পাশাপাশি তিন নম্বর অজশাবকের উৎসাহে লাফাচ্ছি আমরাও। যেন আমাদের বাড়ির পাশে বিয়েশাদি হচ্ছে। এই বিয়ের একটি দিকই আমাকে সত্যিকারভাবে আকর্ষণ করেছে। সেটা হলো মেগানের দেহে রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ রক্ত। আচারসর্বস্ব ও বর্ণবাদী, নীল রক্তের মহিমা কীর্তনকারী ব্রিটিশ রাজবংশের প্রতি এটা একটা চ্যালেঞ্জ বৈকি। বখাটে, বাউণ্ডুলে বলে পরিচিত ছোট রাজপুত্র হ্যারি এটা একটা কাজের কাজ করেছে বটে।

ইতিহাস জানে মিশরীয় ডোডি আল ফায়েদের সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে মা ডায়নাকে কতই না কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি গুজব আছে ডোডির সন্তান গর্ভে ধারণের অপরাধে ডায়নাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্ঘটনার নামে। সেটা প্রমাণ হোক না হোক ডোডির সঙ্গে ডায়নার প্রেমে অভিজাত ইংরেজ সমাজ যে চুনকালি নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল তাতে ভুল নেই। মায়ের বেটা হ্যারি তার জবাবটা ভালোই দিয়েছেন। প্রিন্সেস ডায়না হয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজবংশের ফাঁকা কায়দা-কানুনের বলি। আজ তার আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পাবে।

হ্যারির এই বিয়েতে আরেকজনের আত্মাও নিশ্চিতভাবে শান্তি লাভ করেছে। সেই ব্যক্তিটি হলেন রাজা অষ্টম অ্যাডোয়ার্ড। রাজা পঞ্চম জর্জ ও কুইন মেরির প্রথম সন্তান ছিলেন অ্যাডোয়ার্ড। জন্ম ১৮৯৪ সালে। যুবরাজ থেকে তিনি যুক্তরাজ্য ও ব্রিটিশ ভারতের রাজা হন ১৯৩৬ সালে। তখনও অবিবাহিত এই রাজা ছিলেন দেশের কুমারীকন্যাদের চোখের মণি। রাজাকে কোনভাবে বিয়ে করে কুইন কনসোর্ট হতে লালায়িত ছিল রাজরক্তধারী ও অভিজাত সমাজের বেশুমার নারী। কিন্তু প্রেমের দেবতার চক্রান্তে তিনি ভালোবাসেন মার্কিন নারী ওয়ালিস সিম্পসনকে। একে তো সিম্পসনের দেহে রাজরক্ত নেই, তদুপরি তালাকপ্রাপ্ত। ব্যস, আর যায় কোথায়। এই প্রেম রাজকীয় কেতা-বিরোধী বলে অভিজাত সমাজ হৈ হৈ করে ওঠে।

রাজার সামনে তখন দুটি পথ। প্রেমকে ছাড়ো নাহয় সিংহাসন। স্বাধীনচেতা অ্যাডোয়ার্ড সিংহাসনকে তালাক দিয়ে সিম্পসনকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সাল থেকে ২০১৮। একশ বছরও পার হয়নি। এরমধ্যেই সমাজের কতটা বদল হয়েছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন হ্যারি। সাবাশ বটে।

এই রাজকীয় বিয়ের ডামাডোল আর খানাপিনার খবরে পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুদের মলিন ছবিগুলো। ফিলিস্তিনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ইসরাইলি সশস্ত্র হামলা আর নিহতদের রক্তাক্ত ছবিগুলো বিশ্ববিবেককে নাড়া দিচ্ছে না মোটেই।

পবিত্র রমজান মাসে ফিলিস্তিনি শিশুরা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। জেরুজালেমে চলছে আক্রমণ, নির্যাতন। ইসারাইলি হামলার নির্মম বলি হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও চোখে পড়লো। সেখানে একটি ফিলিস্তিনি শিশু বিশ্ব নেতাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তার ঘরে ইফতার করার জন্য। কিন্তু শিশুটির ঘর বোমায় বিধ্বস্ত। সে আশ্রয়হীন। হ্যারি-মেগানের তিনকোটি পাউন্ডের বিয়ের বিপরীতে আশ্রয়হীন, নিরন্ন ফিলিস্তিনি শিশুদের মুখগুলো দেখিয়ে দেয় এই বিশ্ব কতটা বৈষম্যপূর্ণ, কতটা নির্মম। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের কোন সীমা নেই। জোর যার মুল্লুক তার।

দখলদারিত্বের ৭০তম বছরে ৬০জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েল ক্ষমতার দাপট দেখালো। জেরুজালেমে গৃহহীন শিশুদের কান্না কি শুনতে পাচ্ছে জাতিসংঘ? শুনতে পাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব? শুনতে পাচ্ছে মানবতার জিগির তুলে মুখে ফেনা নির্গত করা মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা? নাকি বিয়ের বাদ্যতে তারা বধির হয়ে গেছে? পশ্চিমাদের মিডিয়াও ব্যস্ত কান উৎসব, রাজকীয় বিয়ে আর আসন্ন বিশ্বকাপের ঢোল পিটানোর কাজে।

রোজার মাসে নিহত ফিলিস্তিনি ও তাদের এতিম সন্তানদের চোখের পানির কোন মূল্য তাদের কাছে নেই। বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মীদেরও তেমন কোন বাদ-প্রতিবাদ চোখে পড়ছে না। কোনও মানববন্ধন বা প্রতিবাদ কিছুই নেই। ফেসবুকেও কারও প্রোফাইল পিকচার কালো রং দিয়ে ঢেকে দেওয়ার নজির চোখে পড়েনি। কারণ পশ্চিমাসাহায্য মদদপুষ্ট মানবাধিকারকর্মীরা এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামানোই সমীচিন ভেবেছেন। কিন্তু আমার চোখে যখন তখন ভেসে উঠছে সেই অসহায় শিশুটির ছবি যে গৃহহীন, যে পিতৃহীন।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

‘রোজার মাসে নিহত ফিলিস্তিনি ও তাদের এতিম সন্তানদের চোখের পানির কোন মূল্য তাদের কাছে নেই। বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মীদেরও তেমন কোন বাদ-প্রতিবাদ চোখে পড়ছে না। কোনও মানববন্ধন বা প্রতিবাদ কিছুই নেই।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।