সড়ক-মহাসড়কের হাল : মানুষ উন্নয়নের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা চায়
দেশের সমস্যার অন্ত নেই। একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে এসব আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু কিছু কিছু সমস্যা আছে যা সমাধান একবারে বা চিরতরে সম্ভব না হলে সময়ের আগে যদি পরিকল্পনা করা যায় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাহলে অন্ততঃ জনভোগান্তি এড়ানো সম্ভব হয়। বলা হচ্ছে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশার কথা যতো কম বলা হবে ততোই মঙ্গলের। যদিও সরকার এই খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বলেই আমরা জানি। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প সরকার নিজস্ব অর্থায়নে করতে শুরু করেছে এবং দেশের প্রায় প্রতিটি মহাসড়কই দুই লেন থেকে চার লেইনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে সরকারের প্রথম মেয়াদ থেকেই। কিন্তু আজ অবধি জনগণ তার সুফল খুউব একটা পেয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। নিশ্চয়ই এর পেছনে একটা কারণ রয়েছে।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে দেশের একটি প্রখ্যাত সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই যে, দেশের ৮০ ভাগ সড়কের বেহাল দশা। আমরা ধরেই নিচ্ছি যে, এই সংবাদের সঙ্গে সরকার একমত হবে না। ধরে নিচ্ছি যে, ৮০ ভাগ না হোক অন্ততঃ অর্ধেক অর্থাৎ ৪০ ভাগ সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা বেহাল। যদিও আমরা কোথাও এটা দেখতে পাইনি যে, সরকার এই রিপোর্টের প্রতিবাদ করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ ও বিপজ্জনক এই তথ্যও আমরা জানতে পারি আন্তর্জাতিক সড়ক পর্যবেক্ষক সংস্থার রিপোর্ট থেকে। সে সময় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সড়ক বিভাগ থেকে একজন উপসচিব পর্যায়ের ব্যক্তি একথা জোর দিয়েই বলেছিলেন যে, এই রিপোর্ট সত্য নয়। তার দাবি ছিল বাংলাদেশে প্রতি বর্ষার শেষে সড়ক-মহাসড়ক বেশ অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তা পুনরায় মেরামত করতে হয়। হয়তো তার দাবি সত্য, যদিও পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে, প্রযুক্তিও এগিয়েছে, এখন নির্মিত মহাসড়কগুলি দীর্ঘমেয়াদেই নির্মিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে কেন হয় না সে প্রশ্ন তাকে করে লাভ ছিল কিনা জানিনে। কিন্তু তিনি একথা জোর দিয়েই বলতে চাইলেন যে, সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সড়ক-মহাসড়কের এই দশা দূর করতে। একাধিক প্রকল্পের ফিরিস্তি আমরা জানতে পেরেছি তার বক্তব্য থেকে। ফলে ধরেই নেয়া গিয়েছিল যে, এ বছরের মাঝামাঝি এসে দেশের সড়ক-মহাসড়কের চেহারা পরিবর্তন হবে এবং মানুষ অন্ততঃ নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবে।
বর্তমান সরকারের বয়স প্রায় দশ বছর হতে চললো। এই দশ বছরে দেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন বলতে সরকারের ঝুলিতে অনেক কিছুই রয়েছে। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন মানুষ উন্নয়ন উপলব্ধি করবে সেই সড়ক-মহাসড়কের অবস্থাটা কি সেটা জানার জন্য কাউকেই প্রতিদিন সেটি ব্যবহার করতে হবে না।
কোনো কুক্ষণে যদি কেউ ঢাকা ছেড়ে যে কোনো দিকে রওয়ানা দেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, উন্নয়ন বলতে যে বিশাল লিস্টি জনগণের সামনে উপস্থিত করা হয়, সেটাতে নিঃসন্দেহে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যিনি সড়ক-মহাসড়ক ব্যবহার করছেন তার অবিশ্বাস জন্মাবে। কারণ ঢাকা শহরে নিজের পাড়া-মহল্লার রাস্তা-ঘাটতো বটেই মহাসড়কেরও যে পরিমাণ বেহাল দশা তাতে যে কারোরই মনে হতে পারে যে, এতো উন্নয়ন তবে কোথায় গেলো?
যে কোনো অর্থবছরেরই একটি ভাগ থাকে সরকারি কর্মকাণ্ডে। বিশেষ করে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের হাতে এরকম একটি কর্মপরিকল্পনা থাকে। সেখানে বৃষ্টি-বাদলের কথা মাথায় রেখে সড়ক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বর্ষাকালে না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা অনাদি কাল থেকে দেখে আসছি যে, এই দেশে সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরুই হয় বর্ষাকালে কিংবা বর্ষা শুরুর সামান্য আগে।
মজার ব্যাপার হোলো কোনো বছর যদি আগাম বর্ষা শুরু হয় তাহলে রাস্তার উন্নয়ন করতে গিয়ে সরকার যে জনভোগান্তির সৃষ্টি করে তার কোনো মা-বাপ নেই। অথচ একটু সচেতন হলেই এই জনভোগান্তির বিষয়টি এড়ানো যায়। কিন্তু সেটা এড়ানোর দায় যে, সরকারি কর্মকর্তাদের নেই সেটা বলাই বাহুল্য, কারণ তারা হচ্ছেন ‘পার্মানেন্ট সরকার’ কিন্তু যারা ‘অস্থায়ী’ ও পাঁচ বছর পর পর যাদেরকে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসতে হয় তারা কেন এই জনদুর্ভোগের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেন না?
দেখতে দেখতে ঈদ চলে আসছে। প্রতিদিনই দেশের রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশার ছবি দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়। নাগরিক জীবনের ভোগান্তির সঙ্গে দেশের এক প্রাপ্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে মহাসড়কগুলির করুণ চিত্রও জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। এরমধ্যে প্রকৃতিও হয়েছে বৈরি। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র ভয়াবহ।
আমরা যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে প্রায়শঃই রাস্তায় দেখি, তিনি সপ্তাহে অন্ততঃ একবার হলেও রাস্তাঘাট পরিদর্শনে যান। বিভিন্ন নির্দেশনা দেন এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের। কিন্তু তার এই প্রতিনিয়ত রাস্তায় টহল দেওয়ার পরও কেন এই নির্বাচনের বছরেও দেশের রাস্তা-ঘাট ব্যবহারের উপযোগী থাকলো না সে প্রশ্নটি অবশ্যই উত্থাপিত হওয়া জরুরি। বিশেষ করে, এটা সরকারের প্রথম বা মাঝামাঝি কোনো বছর নয়।
দশ বছরের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ সরকারের শেষ বছর এবং এই বছরই সরকারকে জনগণের সামনে দাঁড়াতে হবে ভোটের দাবি নিয়ে। এই বছরই কেন ঈদকে কেন্দ্র্র করে মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠবে? টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরের কোনো এলাকার বাসিন্দা যখন বলেন, “আমাদেরকে তারা মানুষ মনে করে না, কেউ কেয়ারই করে না আমাদের জন্য”, তখন একথা কেবল একজন মাত্র ব্যক্তির, সেটা মনে করার কোনো কারণ আছে কি? নেই। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো কি?
একথা স্বীকার্য যে, বাংলাদেশ এগুচ্ছে। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই বহুবিধ বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু যে উন্নয়ন দেখা যায় না মানুষের কাছে সে উন্নয়ন অর্থহীন এই সত্য কি কোনো ভাবেই বদলানো সম্ভব? মানুষ প্রতিনিয়ত নিজের জীবনে সরকারের কথিত উন্নয়নকে উপলব্ধি করতে চায় কিংবা নিজের চোখে উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করতে চায় মানুষ।
কিন্তু রাস্তায় নামলেই যদি মানুষকে বিপরীত কোনো সত্যের মুখোমুখি হতে হয় তাহলে সবার আগে মানুষের অবিশ্বাস আসে এই উন্নয়ন শব্দটির প্রতি। এবং মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা হারায়। যে ব্যক্তি আজকে ঢাকা শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে অসহায় মনে করেন কিংবা চট্টগ্রাম ভ্রমণ করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় আটকে থাকেন তার কাছে উন্নয়নের মূল্য কতোটুকু সেটা সরকারের ভেবে দেখা উচিত।
পরিকল্পনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ। ঈদ কখন হতে পারে, কখন সড়ক-মহাসড়কের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে সেটা সরকারের অজানা নয়। তাহলে কেন প্রতিবারই ঈদকে কেন্দ্র করে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশার চিত্র জনসম্মুখে প্রচারিত হয়? এতো অস্বীকার করার মতো সত্য নয়, কিংবা নয় কোনো ষড়যন্ত্রকারীর কারসাজিও। তাহলে কেন প্রতিবারই ঈদে ঘরমুখো মানুষকে মানবেতর সড়ক-পরিস্থিতির শিকার হয়ে আত্মীয়-পরিজনের কাছে ঈদ উদযাপনে যেতে হয় বা ফিরে আসতে হয়? কেন আগে থেকেই ব্যবস্থাটি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না?
সড়ক ব্যবস্থাপনা ও সেতু মন্ত্রী বিভিন্ন নির্দেশনা ইতোমধ্যেই দিয়েছেন ঈদকে কেন্দ্র করে সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। কিন্তু সড়কই যদি ঠিক না থাকে তাহলে ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা কাজে আসবে কী করে? হয়তো সাময়িক ভাবে আসন্ন ঈদকে সামলানো যাবে, কিন্তু নির্বাচনের বছরে এসে মানুষকে কি এভাবে বুঝিয়ে রাখা যাবে?
মানুষ এটুকু বুঝতে পারবে যে, সরকার দেশের সড়ক-মহাসড়কের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। যে মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহাসড়কে তা নিঃসন্দেহে মানুষকে আশাবাদী করবে। কিন্তু একথাও সত্য যে, মানুষ নগদ যা পাচ্ছে না তা মানুষকে নিরাশাবাদীও করে তুলছে। সমস্যাটা সেখানেই। এখানে কেবলমাত্র ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণেই মানুষ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না বা বঞ্চিত হচ্ছে।
হতে পারে এটা সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রীদের কাজ কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, দশ বছর বয়সী সরকার যদি সেই ষড়যন্ত্রীদেরও ধরতে না পারে তাহলে বলতেই হয় যে, ত্রুটিটা আমাদের মজ্জাগত। নাহলে, কেন নির্বাচনের বছরেই, ঈদের আগেই দেশের সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে এতো নেতিবাচক সংবাদ প্রচারের সুযোগ তৈরি হবে? কেনইবা একজন সাধারণ মানুষ সরকার-বর্ণিত উন্নয়নকে খালি চোখে দেখতে পাবে না?
ঢাকা ২২ মে, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম