মাকে মনে পড়ে

তাহমিনা ইয়াছমিন শশী তাহমিনা ইয়াছমিন শশী , ইতালি প্রবাসী লেখক
প্রকাশিত: ১০:১৯ এএম, ১৩ মে ২০১৮

`মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম পাপোস বানালেও ঋণের শোধ হবে না’— সত্যি এ ঋণ শোধ হওয়ার নয়। কত মধুর ‘মা’ ডাক। এ ডাক শোনার জন্য প্রসব বেদনা ভুলে যান মা। ১০ মাস ১০ দিন গর্ভধারণ করেন গর্ভধারিণী মা। যার নিজের সন্তান নেই অন্যের সন্তান বুকে ধরে লালন-পালন করে নিজ সন্তান না হওয়ার বেদনা ভুলে যান… কবির ভাষায় বলবো, প্রসব ব্যথার যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে যায় রে মা/দুনিয়াতে সেই যন্ত্রণার নাইরে উপমা/সন্তানের মুখ দেখে মা গো সকল কষ্ট ভুলে/কোলে তুলে বুকের সুধা মুখে দেয়রে তুলে/সন্তানকে ছাড়ে রে না মা’য়ে/হলেও আগুনে পোড়া/বাবা মায়ের উজাড় করা আশীর্বাদের ঢাল,/সন্তানকে রক্ষা করে দুনিয়ায় চিরকাল...।

রোববার বিশ্ব মা দিবস। পৃথিবীর নানা দেশে মাকে উপলক্ষ করে পালিত হয় দিবসটি। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগেও অনেক জায়গায় পালিত হতো মা দিবস। তবে তখনকার মা দিবস এখনকার মতো ছিল না। তখন দেবীদের মা হিসেবে পূজা করা হতো। ১৬ শতকে ইংল্যান্ডে মা দিবস পালন করা হতো, যা ছিল রক্ত-মাংসের মাকে নিয়ে আসল মা দিবস। ১৮৭০ সালে আমেরিকার জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামের এক গীতিকার মা দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। ১৯০৭ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ছিল আন্নার মা অ্যান মারিয়া বিভেবা জারভিসের মৃত্যুবার্ষিকী।

সেই দিনটিকে আন্না মা দিবস হিসেবে পালন করেন। এরপর তিনি এই দিবসটিকে মা দিবস ঘোষণা করার জন্য দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সরকারের কাছে চিঠি লিখতে শুরু করেন। এরপর আন্নার একক প্রচেষ্টায় পেনসিলভেনিয়া ও ভার্জিনিয়ার কয়েকটি গির্জায় পালিত হয় মা দিবস। ১৯১৪ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে জাতীয় মা দিবসের মর্যাদা দেন।

১৯৬২ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। আজ রোববার ১৩ মে ‘মা’ দিবস। মায়ের কথা মনে করলে মন আবেগে আপ্লুত হয়। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়— নয়ন সম্মুখে তুমি নাই নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।

‘মা’ ছোট্ট একটি শব্দ। অথচ এর অর্থ ব্যাপক। মা দিবস সবচেয়ে আপন মানুষটিকে আরও বেশি ভালোবাসার, আরও বেশি করে মনে করার দিন। সন্তানের জন্য গর্ভধারিণীকে বিশেষভাবে ভালোবাসার আসনে কোনো বিশেষ দিন থাকে না। তারপরও নানা সূত্রে মায়ের অপার মহিমা তুলে ধরারও একটি দিন এসে গেছে। বিশ্বজুড়ে সন্তানরা আজও মাকে ভালোবাসবে প্রতিদিনের মতো। কিন্তু এই দিনটির কথা মাথায় থাকবে যাদের তাদের মধ্যে কাজ করবে মাকে ভালোবাসার ও তার কাছে ঋণের কথা ভেবে উদ্বেল হওয়ার বাড়তি এক প্রেরণা।

মা তার মাতৃচর্চার কত স্নেহে, কত যত্নে লালন করে মানুষ নামের একটি ছোট্ট মাংসপিণ্ডকে জন্ম দেয় এই সুন্দর পৃথিবীতে। মাকে ভালোবাসা শুধু মুখের কথার মধ্যে প্রকাশ করা নয়। তার প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করা, তার কাজের মর্যাদা দিতে হবে। ‘মা’ তার সন্তানকে জন্ম থেকে শুরু করে আমরণ চিরন্তন সত্ত্বাবোধে সন্তানের প্রতি মমত্ববোধ থেকে বিচ্যুত হন না। সর্বদা ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে। তাই মাকে ভালোবাসার জন্য শুধু একটি দিন যথেষ্ট নয়।

এ তো প্রতিদিনের, চিরদিনের, চিরকালের। মাতৃঋণ কোনোভাবেই শোধ করার নয়। সন্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু মায়ের পর আর কেউ নয়। ‘মা’ পরিপূর্ণতা পায় তার সন্তানের কাছ থেকে। আজকের দিনে অনেক ভালোবাসা মায়ের জন্য। তাই কবির ভাষায় আমার এই অঞ্জলি— ‘জননী তোমার করুণ চরণখানি, হেরিনু আজি এ অরুণ কিরণ রূপে, জননী, তোমার মনোহরণ বাণী। নীরব গগনে ভরি উঠি চুপে চুপে। তোমারি নমি হে সকল ভুবন মাঝে। তোমারি নমিছে সকল জীবন কাজে।

মা দিবসের পেছনের ইতিহাস যাই হোক না কেন, মায়ের জন্য দিনটিকে চাইলেই আপনি পালন করতে পারেন আলাদাভাবে। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মা তাদের সন্তানের জন্য যে ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেন, আমরা কি পারি তার যথাযথ মূল্য দিতে? করপোরেট দুনিয়ার হাতছানিতে অবিরাম ব্যস্ততায় হয়তো সময়ই দেয়া যায় না মাকে। অথচ প্রতিটি মা-ই চান তাদের নিজ নিজ সন্তান মুহূর্তের জন্য হলেও এসে পাশে বসুক। একটু সময় কথা বলুক। সুতরাং মা দিবসে অন্য দিনের তুলনায় একটু আলাদাভাবে সময় দিতে পারেন মাকে।

১. মাকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসতে পারেন, কাছেই কোথাও।
২. মায়ের জন্য কিনতে পারেন তার পছন্দের কোনো জিনিস।
৩. মাকে তার নিত্যকাজ থেকে আজকের দিনের জন্য বিশ্রাম দিতে পারেন। করতে পারেন মায়ের পছন্দের কোনো খাবার রান্না।
৪. মাকে ছবি এঁকে উপহারও দেয়া যেতে পারে।
৫. সময় করে নিয়ে মায়ের কোনো প্রিয় গল্পের বই পড়ে শোনাতে পারেন তাকে। এতে আনন্দ পাবেন তিনি।
৬. আপনি মাকে ছেড়ে দূরে থাকলে অবশ্যই তাকে ফোন করতে ভুলবেন না। অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই সময় দিন এই দিবসটিকে ঘিরে। মায়ের জন্য শুধু একটি দিন নয়, আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনই হোক মায়ের জন্য। মা দিবসে এই মূলমন্ত্র জাগরিত হোক সবার মনে। কারণ মা-ই যে প্রতিটি সন্তানের শেষ আশ্রয়।

কবিতার ভাষায়—
‘চলে যাওয়া মানে নয় ভুলে যাওয়া/ চলে যাওয়া মানে নয় মহাপ্রস্থান তুমি চলে গেছো তবু আছো—/ আমার না থাকা ভুবন জুড়ে।’
পুনশ্চঃ যারা প্রবাসী তাদের জন্য বলছি,

৭. পার্সেল পোস্টের মাধ্যমে মাকে পাঠাতে পারেন হালকা কিন্তু পছন্দনীয় কোন উপহার,মাথায় রাখতে হবে নির্ধারিত দিন-ক্ষণেই যেন তা আপনার প্রিয় মায়ের হাতে পৌঁছে, সাথে রাখতে পারেন কিছু ফুল এবং চকলেট।

৮. স্নেহপ্রতিম অনুজদের মাধ্যমে আপনি হোস্ট হতে পারেন ঘরোয়া পরিবেশে করা আয়োজনের তাতে থাকতে পারে কেক/ফুল/চকলেট/এবং মায়ের পছন্দের বিশেষ কিছু রান্না/বাড়তি যোগ করতে পারেন হালকা রঙের সুন্দর একটি শাড়ি।

৯. দিনটি স্মরণে রেখে সকল ব্যস্ততা পাশ কাটিয়ে মায়ের জন্য কিছুটা সময় বের করুন,যাদের ছুটি আছে, তারাতো বটেই থাকুন মায়ের সাথে কিছু সময় ফোন/স্কাইপি/ইমু/ভাইবারে, দ্বিধা ভুলে প্রকাশ করুন আপনার আবেগি অনুভূতি। এসময় টুকুই হয়তো আপনার জীবনের সেরা হয়ে স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে।

১০. এ দিনটি মাথায় রেখে আপনি ছুটি নিতে চেষ্টা করুন যদি সম্ভব হয়। চলে যান মায়ের কাছে, এ ক্ষেত্রে কোন উপহারের প্রয়োজন নেই, আপনার উপস্থিতই মায়ের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। তথাপি সামর্থ্য অনুপাতে নিতে পারেন হালকা ধাঁচের কোন অলংকার, নিজ হাতে পরিয়ে দিন আপনার প্রিয় মায়ের গলায়/কানে কিংবা হাতে। আপনি অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখবেন প্রিয় মায়ের আনন্দাশ্রু,আপনি ফিরে পেতে পারেন সেই ভুলে যাওয়া প্রিয় ক্ষণ ও মায়ের তপ্ত হৃদয় তৃপ্ত হবার প্রিয় দিনটি, যেদিন আপনি প্রথম ‘মা’বলে ডেকেছিলেন।

মায়ের ভালোবাসা সকল সন্তানের ক্ষেত্রে সমান হলেও প্রবাসী সন্তানের বেলায় হাহাকার টা মরুভূমির পানির জন্য তৃষ্ণার ন্যায় অনেকটা, আমি বিশ্বাস করি নিজেকে দিয়ে আপনার টান টাও মায়ের জন্য তেমনি,আর তাই এখানটায় নকুলের সুরে সুর মিলিয়ে বলবো, ‘থাকবো নারে আর প্রবাসে আমার মনে পড়ে মাকে, ওই বাংলা থেকে মা যেন গো দু হাত তুলে ডাকে......আমার মনে পড়ে মাকে’...

পৃথিবীর সকল মায়ের সুস্থ-সুন্দর এবং নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।

লেখক : ভেনিস, ইতালীপ্রবাসী লেখক।

এইচআর/এমএস

‘মা তার মাতৃচর্চার কত স্নেহে, কত যত্নে লালন করে মানুষ নামের একটি ছোট্ট মাংসপিণ্ডকে জন্ম দেয় এই সুন্দর পৃথিবীতে। মাকে ভালোবাসা শুধু মুখের কথার মধ্যে প্রকাশ করা নয়। তার প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করা, তার কাজের মর্যাদা দিতে হবে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।