নষ্ট চিন্তাধারার অবসান হবে কবে?

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ০২ মে ২০১৮

একটি সমাজ কতটা উন্নত মানসিকতার তা বোঝার প্রথম মাপকাঠি হলো সেখানে নারী ও শিশু কতটা নিরাপদ তা উপলব্ধি করা। যে সমাজ নারীকে ঘরে-পথে-কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে পারে, শিশুর সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশকে নিশ্চিত করতে পারে সেই সমাজ যদি অবকাঠামোগতভাবে দরিদ্রও হয় তবু তা অনেক স্বস্তিদায়ক ও উন্নত। আর যে সমাজে নারী ধর্ষণের শিকার, প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার, সহিংসতার শিকার, যে সমাজে শিশুকে পিটিয়ে মারা হয় সে সমাজ যতই ধনী হোক, অবকাঠামোগতভাবে উন্নত হোক সেটা বর্বরের উন্নয়ন। সেটা কখনও প্রকৃত উন্নয়ন নয়। কথাগুলো কেন উঠলো তা ব্যাখ্যা করছি।

অফিস থেকে রিকশায় বাড়ি ফিরছিলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। রিকশা জ্যামে আটকে আছে। পাশে কোথায় যেন ওয়াজ হচ্ছে অথবা ওয়াজের রেকর্ড বাজছে। আমার রিকশা যেখানে দাঁড়ানো তার কাছেই মস্ত মাইক ফিট করা। ফলে ওয়াজের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সেখানে যে কি জঘন্য নারী-বিরোধী কথাবার্তা বলা হচ্ছে তা শুনে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। নারী শিক্ষার বিপক্ষে জোর গলায় বয়ান করা হচ্ছে। নারীদের নাকি দশ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দেওয়া উচিত। যে নারীরা শিক্ষা গ্রহণ করে এবং কারখানা বা অফিসে চাকরি করে তারা সব ‘নষ্ট’।

আমার রিকশাচালকও ওয়াজ শুনছিলেন। এই পর্যায়ে তিনিও পাশের রিকশাচালকের সঙ্গে আলাপে একই মতামত ব্যক্ত করলেন। এতে বোঝা গেল ওয়াজের বক্তব্যের সঙ্গে তাদের কোন দ্বিমত নেই। আশপাশের আরও কয়েকজন সহমত ব্যক্ত করে ঘোষণা করলেন যে নারীরা ঘরের বাইরে বের হচ্ছে বলেই নাকি দেশে এত বালা মুসিবত। এবং বিশেষ করে চালের দাম এত বেশি হওয়ার কারণ নাকি নারীদের স্বাধীনভাবে চলাচল। যদিও এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র কোথায় তা অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়া অর্থনীতিবিদের পক্ষেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কিছুদিন আগের একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছিল।

হবিগঞ্জের সেই বিউটিকে মনে আছে তো? যার মৃতদেহের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। আমরা ধরে নিয়েছিলাম বিউটিকে হত্যা করেছে তার ধর্ষকই। কিন্তু পরে যে কথা জানা গেল তা আরও বীভৎস। জানা গেল বিউটিকে জবাই করে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তারই জন্মদাতা পিতা এবং আরেক আত্মীয় যাকে সে চাচা বলে ডাকতো। সম্পর্কিত চাচা বিউটিকে হত্যার পরিকল্পনা করে কারণ এই মেয়েটির ধর্ষকের মা তার স্ত্রীর প্রতিদ্বন্দ্বী।

মা কলমচান ও তার পুত্র ধর্ষক বাবুলকে শায়েস্তা করতে হলে শুধু ধর্ষণের কেস যথেষ্ট নয়। মার্ডার কেস চাই। বুঝলাম তার বড়সর স্বার্থ ছিল। কিন্তু বিউটির জন্মদাতা পিতা কিভাবে রাজি হলো মেয়েটিকে হত্যা করতে? তাকে বুঝানো হলো ‘তোমার মেয়ে তো ধর্ষিত হয়েছে। অতএব সে নষ্ট হয়ে গেছে। তাকে বাড়িতে রাখলে তোমার অন্য মেয়েদের বিয়ে হবে না। বিউটিকে তাহলে জবাই করে হত্যা করা হোক।’

কি ভয়ংকর এই চিন্তা, কি ভয়ংকর এই সমাজের মানুষগুলো। একটি নারী ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে সে ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়া! কেন? যে ব্যক্তি ডাকাতির ভিকটিম হয় বা দুর্ঘটনায় হাত-পা হারায় বা আহত হয় সেকি ‘নষ্ট’ হয়ে যায়? ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে যৌন আক্রমণের শিকার হওয়া, ভিকটিম হওয়া। সে ‘নষ্ট’ হবে কেন?

একজন মানুষ তখনই ‘নষ্ট’ হয় যখন সে নিজে কোন অপরাধ করে, দুর্নীতি করে বা নৈতিকতা হারায়। খুনি ও ধর্ষক ‘নষ্ট’। কারণ তারা গুরুতর অপরাধে অপরাধী। ‘নষ্ট’ হতে পারে ঘুষখোর, ইয়াবাখোর, মাদক ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, নদী দখলকারী, পরিবেশ ধ্বংসকারী। ‘নষ্ট’ হলো রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী। যারা মানব সমাজের অমঙ্গল কামনা করে, সমাজের অমঙ্গল ঘটায় তারা ‘নষ্ট’ হতে পারে। কিন্তু একজন রেপ ভিকটিম নষ্ট হবে কেন?

নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছেন, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছেন এই বিষয়টিকে যারা ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়া বলছে তারা নিজেরাই কি ‘নষ্ট’ নয়? যারা নারীদের শিক্ষাগ্রহণ ও উপার্জনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় তাদের একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। আজ যদি বাংলাদেশের সব নারী তাদের সব কাজকর্ম বন্ধ করে দেন তাহলে এক ঘন্টার মধ্যে দেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে। ওই লোকগুলো তখন কী বলবে?

পোশাক কারখানা আর চিংড়ি ঘের দেশের রপ্তানি আয়ের দুটি প্রধান উৎস চলছে মূলত নারীর শ্রমে। শুধু তাই নয়, নার্সিংসহ বিভিন্ন সেবাখাতে, শিক্ষা, ব্যাংকিং, চিকিৎসা, আইন, সাংবাদিকতা কোন পেশায় নারীরা তাদের শ্রম দিচ্ছেন না? দেশের অর্থনীতির চাকার অর্ধেকটা তো ঘুরছে নারীর শ্রমেই। তাহলে কেন নারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের বিদ্বেষ ছড়ানো হয়? কেন সমাজের এমন নারী বিরোধী মনোভাব?

নারীর প্রতি মনোভাবের দিক থেকে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ বলে পরিচিত সৌদি আরবেও ইদানিং পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে। যেখানে নারীর গাড়ি চালানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল সেখানে আজ নারীরা অনেক অধিকার পাচ্ছেন। একটু একটু করে নারীদের অধিকারগুলো সেখানে স্বীকৃত হচ্ছে। আর আমরা?

আমরা তো মন মানসিকতায় দিনকে দিন আর পিছিয়ে যাচ্ছি বলে মনে হয়। অনলাইনে কোন একটি সংবাদের নিচে মন্তব্যগুলো পড়লেই আমার বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমনকি সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালনা ও অন্যান্য অধিকার প্রদান সংক্রান্ত সংবাদের নিচেও চোখে পড়েছে নারীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক কুৎসিত সব মন্তব্য।

সমাজ থেকে এই সব নষ্ট চিন্তা দূর করার জন্য প্রয়োজন গণ সচেতনতামূলক প্রচার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং জেন্ডার বৈষম্য-বিরোধী শিক্ষা। সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে এখন সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। নাহলে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

নারীরা ঘরের বাইরে বের হচ্ছে বলেই নাকি দেশে এত বালা মুসিবত। এবং বিশেষ করে চালের দাম এত বেশি হওয়ার কারণ নাকি নারীদের স্বাধীনভাবে চলাচল। যদিও এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র কোথায় তা অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়া অর্থনীতিবিদের পক্ষেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।