রাজীবের হাত, রোজিনার পা
বেপরোয়া যানের গতিতে জীবন যাচ্ছে অকাতরে। এখন অঙ্গহানিও হচ্ছে। কলেজ ছাত্র রাজীবের হাত, রোজিনার পা কেড়ে নিয়েছে ঘাতক চালকরা। রাজীব চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। রোজিনার অবস্থাও সংকটাপন্ন। প্রশ্ন হচ্ছে আর কত জীবন গেলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?
সত্যি বলতে কি সড়ক দুর্ঘটনা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে যে, তা দেশের প্রতিদিনের দুর্ঘটনার চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। এটা খুবই দুঃখজনক যে, অনেক চেষ্টার পরও সড়কে নিরাপত্তা ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে পারছে না সরকার। জোরালো অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন আইন ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচেটিয়া প্রাধান্যের কারণেই এই খাতে শৃঙ্খলা আসছে না। এছাড়া সরকার, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন একাকার হয়ে গেছে। ফলে সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ করতে গেলেই বাধা আসে। এরফলে রক্ষা হচ্ছে না যাত্রীস্বার্থ। অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সড়কে। তাহলে নিরাপদ সড়ক কি অলীক কল্পনার বিষয় হয়েই থাকবে?
বিদায়ী বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় বেড়েছে। তবে তা ২০১৫ সালের তুলনায় কম। গত বছর সারা দেশে তিন হাজার ৪৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ২৮৪ জন নিহত ও ৯ হাজার ১১২ জন আহত হয়েছেন। নিহতের তালিকায় নারী ও শিশুর সংখ্যা যথাক্রমে ৫১৬ ও ৫৩৯। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে এসব দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। গত সোমবার নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) বার্ষিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ২০১৭-তে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
বছর ব্যাপী পর্যবেক্ষণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির জন্য ৯টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে জাতীয় কমিটি। সেগুলো হচ্ছে- ১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ২. সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি, ৩. স্থানীয়ভাবে তৈরি দেশীয় ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্রযানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, ৪. বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং, ৫. জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ৬. দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ৭, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও বেহাল সড়ক, ৮. ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং ৯. অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিবছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। যানবাহনের উচ্চগতি, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা, অসচেতনতা ইত্যাদি বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য সমন্বিত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা জরুরি। দুর্ঘটনা রোধে চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যাবে না। ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করে পথচারী চলার উপযোগী করতে হবে। তুলে দিতে হবে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। রাস্তা চলাচলে আইন অমান্যের জন্য আরও কঠিন শাস্তি ও জরিমানা আদায় করতে হবে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। ফলে আগে যাওয়ার প্রবণতার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। তাছাড়া রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা, একই রাস্তায় বিভিন্ন গতির যানবাহন চলাচল, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, চালকের মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু ও সমন্বিত পদক্ষেপে দেশ যানজট ও দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা সকলের।
এইচআর/এমএস