রাজীবের কাটা হাত ও নিত্য দিনের হতাশা

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৩৪ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবের ছবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালে কান্না ও বিষাদের বাণী। সড়ক দুর্ঘটনায় হাত হারানোর পর প্রাণও হারাতে হলো তাকে। দুই বাসের রেষারেষিতে পড়ে হাত হারাতে হয় রাজীবকে। তখনই যে সে মাথাতেও আঘাত পেয়েছিল সেটা নাকি চিকিৎসকরা খেয়াল করেননি। পরদিন আবার এই আঘাতের চিকিৎসা শুরু হয়।

রাজীবের মৃত্যু আমাদের এই সমাজে কোন ঘটনাই না। কারণ এর আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় বহু প্রাণ ঝরে গেছে। কি প্রতিকার হয়েছে সেসবের? সড়ক দুর্ঘটনার কথা বললেই এক সারি নাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীররা তো আছেনই। ঢাকা শহরের ভিতরেও বেপরোয়া বাসের চাকায় ঝরে যাচ্ছে প্রাণ।

ঢাকা নগরী যেখানে কি না যানজটের ঠেলায় গাড়ির চলাচল করাই দায় সেখানেও একটু সুযোগ পেলেই বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালায় চালকরা। বাসে যারা চলাচল করেন তারা জানেন কিভাবে প্রাণ হাতে করে বাস থেকে ওঠা নামা করতে হয়। শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট কোথাও কিন্তু বাস নির্দিষ্ট স্টপেজে থামে না। জায়গা মতো একটু গতি কমে। তারপর আবার ‘টান’।

পথে যাত্রী দেখলে আবার ‘স্লো’ করে তাকে তুলে নেওয়া। দৌড়ে বাসে ওঠো, দৌড়াতে দৌড়াতে নামো। কি বিপদজনক এই যাতায়াত। অথচ এ ছাড়া নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কোন উপায় আছে? শ্রমিকশ্রেণির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি বাংলাদেশে পরিবহন খাতের চালক, হেলপারদের মতো বেপরোয়া, মানবতাবোধবর্জিত, নৃশংস খুনি ও নারীর প্রতি অশালীন আচরণকারী আর দ্বিতীয়টি নেই। আল্লাহর অশেষ রহমত যে ঢাকায় দুর্দান্ত ট্রাফিক জ্যাম। না হলে প্রতিদিন বেপরোয়া পরিবহন চালনার কারণে কত শত প্রাণ যে ঝরে যেত তার কোন কূল কিনারা নেই।

বাস, ট্রাক, হিউম্যান হলার, সি এন জি, রিকশা যেভাবে চলে তাতে যাত্রীদের বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্য। অথচ এদের বিরুদ্ধে কোন কিছু বলার জো নেই, করার উপায় নেই। খুনি চালকের শাস্তি দেওয়ারও উপায় নেই। শাস্তি দিলেই ধর্মঘট করে দেশ অচল করে দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু হবে। চোরের মায়ের বড় গলা ছিল প্রবাদবাক্যে। আর খুনি চালকের আস্ফালন দেখছি বাস্তবে।

লাইসেন্সবিহীন ও ভুয়া লাইসেন্সযুক্ত চালকে পরিবহন খাত সয়লাব। হিউম্যান হলারগুলোতে কিশোর বয়সী চালক তো হরহামেশাই দেখা যায়। আর একটু রাতের দিকে বাস-ট্রাকের চালকদের মদ্যপানও কোন ঘটনা নয়। যেভাবে বাসগুলো রিকশা ও সি এন জিকে কচুকাটা করে চলে তাতে যে কোন সময় প্রাণ যেতে পারে যাত্রীদের।

মালিবাগ থেকে বাড্ডা পর্যন্ত যদি কেউ রিকশায় চলাচল করেন তাহলে দুর্ঘটনার আতংকেই তার হায়াত কমে যাবার কথা। পুরনো, মেয়াদ উত্তীর্ণ, ফিটনেসবিহীন পরিবহন এবং বেপরোয়া অদক্ষ চালক দুর্ঘটনার মূল কারণ। ট্রাফিক জামেরও একটা মূল কারণ এগুলো। বাঁদিকের লেন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবহনগুলো সকল রাস্তায় বাড়তি জ্যামের জন্য দায়ী।

কিছুদিন আগে মগবাজার রেলগেটে আমিই একটুর জন্য বেঁচে যাই। রিকশায় চড়ে সাতরাস্তা থেকে বাংলামোটরের দিকে যাচ্ছিলাম। রিকশাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয় একটি প্রাইভেট কার। রিকশা উল্টে যায়। রাস্তায় পড়ে যাই আমি। সৌভাগ্যক্রমে গুরুতর আহত হইনি। সেদিন যদি প্রাণ হারাতাম তাহলে আমাকে নিয়েই কলাম লিখতেন কোন সতীর্থ।

গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌনহয়রানির ঘটনাও সুবিদিত। এমনকি কিছুদিন আগে একটি মেয়ের স্ট্যাটাসে দেখা যায় উত্তরা থেকে রামপুরার দিকে বাসে চড়ে যাচ্ছিল মেয়েটি ও তার মা। যাত্রীর সংখ্যা ছিল কম। বাসটির চালক ও কর্মীরা মেয়েটিকে হয়রানি করে। এমনকি মা বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর মেয়েকে আটকে রাখার পাঁয়তারা করে। উপস্থিত বুদ্ধির বলে বেঁচে যায় মেয়েটি।

গণপরিবহন যেমন অনিরাপদ তেমনি পায়ে হেঁটে চলাও কম বিপদজনক নয়। ফুটপাতগুলো দখল হয়ে গেছে হকার, দোকানদার, নির্মাণ সামগ্রী ও ছিন্নমূল মানুষ দ্বারা। ইস্কাটন থেকে বাংলামোটর হেঁটে গেলে দেখবেন গাড়ি ও মোটরাবাইক মেরামতকারী দোকানগুলো ফুটপাত দখল করে রাস্তার একাংশও দখল করে রেখেছে। কোন পথচারীর সাধ্য নেই ওদিক দিয়ে চলাচল করে। কারণ রাস্তার উপরেই মোটরবাইক ও গাড়ি মেরামত করা হচ্ছে বিনা দ্বিধায়। পুলিশ দেখছে। কিন্তু কিছুই বলছে না। পুরোপুরি ‘ডোন্ট মাইন্ড’।

এমন অবস্থা ঢাকার অধিকাংশ এলাকায়। বর্ষাকাল আসন্ন। এখন বরাদ্দ টাকা ‘হালাল’ করতে খোঁড়াখুঁড়ি বাড়বে, পথচারী ও যানবাহন যাত্রীদের অবস্থা আরও সঙ্গীন হবে।

বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা, ঢাকা শহরে সাধারণ মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা কবে সুস্থ ও নিরাপদ হবে তা খোদা মালুম। যে দুই বাসের রেষারেষিতে কলেজছাত্র রাজীব প্রাণ হারালেন তাদের চালকদের কঠোর শাস্তি দাবি করি। শুধু এই চালকদের নয়, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যেসব চালকরা দায়ী তাদেরও শাস্তি দাবি করি। কিন্তু আমার মতো গরীবের কথা কেই বা শোনে। ষোলকোটি জনসংখ্যার এই দেশে মানুষের প্রাণ যে বড় সস্তা।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌনহয়রানির ঘটনাও সুবিদিত। এমনকি কিছুদিন আগে একটি মেয়ের স্ট্যাটাসে দেখা যায় উত্তরা থেকে রামপুরার দিকে বাসে চড়ে যাচ্ছিল মেয়েটি ও তার মা। যাত্রীর সংখ্যা ছিল কম। বাসটির চালক ও কর্মীরা মেয়েটিকে হয়রানি করে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।