চারদিকে পাশবিকতা, আমাদের নির্বাক চেয়ে থাকা

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৫৭ এএম, ১১ এপ্রিল ২০১৮

ধর্ষণ নিয়ে চারদিকে রীতিমতো ত্রাহী ত্রাহী রব উঠেছে। পত্রিকার পাতা, অনলাইন গণমাধ্যম ও সম্প্রচার মাধ্যমের সংবাদে একদল হিংস্র শ্বাপদের থাবা দেয়ার খবর। দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। পৈচাশিকভাবে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে ধর্ষিতাকে। ধর্ষণের হাত থেকে বাদ যাচ্ছেনা শিশুরাও। হত্যার পর লাশের বীভৎস ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। একদল লোক মহাউৎসাহে এসব ছবি ফেসবুকে শেয়ার করছেন। ভাবখানা এমন, এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ালেই বোধ হয় দেশে ধর্ষণ বন্ধ হবে। এসব বিকৃত লাশের ছবি ফেসবুকে আপলোড দেবার ফলে আরো বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমার এক বন্ধু ফোন করে জানালো, গতকাল রাতে ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো মৌলভিবাজারে অনার্স পড়ুয়া ছাত্রীর ট্রেনের নিচে খণ্ডিত লাশের ছবি দেখে সে অসুস্থবোধ করছে। কয়েকবার বমিও হয়েছে। তাকে কী স্বান্তনা দেবো, জানা নেই। আমিও গতরাতে ঠিক একই কারণে ঘুমোতে পারি নি। এক অজানা আতঙ্ক যেন ঘাড়ে নিৎশ্বাস ফেলছে। আমিও তো মানুষ, আমারও তো পরিবার-প্রিয়জন আছে। আমার নিকটজনেরা কী নিরাপদে আছেন! প্রতিনিয়ত হচ্ছে সভা-সেমিনার, মিছিল মিটিং সুধী সমাবেশ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে ধর্ষণের হার, একই সাথে বাড়ছে গণ ধর্ষণের ঘটনা, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা। পত্র পত্রিকার বরাতে বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যাণ গুলোতে নজর দিলেই বিষয়টুকু স্পষ্ট হয়। ‘একটি জাতীয় দৈনিকে জাতীয় মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সমীক্ষা দেখে রীতিমতো প্রাণ আৎকে ওঠে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৪ জন নারী, এদের মধ্যে ৩০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে,গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৬ জন।

২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ১০৭ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে এবং গণধর্ষণ হয়েছেন ৩৫ জন। ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৬ জন। ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৪ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৩ জন। ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪১ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৭ জন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০০ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে এবং গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৬ জন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ১১৫, ২০১৫-তে ১৪১, ২০১৬-তে ১৫৮ এবং ২০১৭-এর ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ১৯৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারী ধর্ষণের ঘটনা কোনো বছর তুলনামূলক কম-বেশি হলেও গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও ধাপে ধাপে প্রতিকূলতার জালে জড়িয়ে পড়ছে বিচার প্রাপ্তির আশা।

ভয়-ভীতি অথবা অর্থের বিনিময়ে বাদী পক্ষের সঙ্গে মীমাংসা করে মামলা দুর্বল করে ফেলা যেন খুবই সাধারণ ব্যাপার। সাক্ষী উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটছে আকসারই। আইন অন্ধ, স্বাক্ষী প্রমাণ ছাড়া আইন কিছুই করতে পারে না।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত পুলিশ সদর দফতরের নথি অনুয়ায়ী, ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে মোট ৪৩ হাজার ৭০৬টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার মামলায় এক লাখ আসামি খালাস পেয়েছেন। আর ধর্ষণ মামলায় খালাস পেয়েছেন ৮৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ আসামি। নারী নির্যাতনের মামলায় আসামি খালাসের পরিমাণ ৯৫ শতাংশ। ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুলিশের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঁচ হাজার তিনটি ধর্ষণের মামলা হয়। এর মধ্যে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ এবং সাজার হার শূন্য দশমিক ৪৫ ভাগ।’’

এছাড়াও গ্রাম্য সালিশের নামে এক প্রহসণ তো আছেই। সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছে ধর্ষিতার পরিবার। অনেকটাই মৌখিকভাব একঘরে রাখা হচ্ছে ভিকটিমদের।

এছাড়াও বর্তমানে যুক্ত হয়েছে নতুন সমস্যা। নারীদের পোষাকের দোহাই দিয়ে ধর্ষণ জায়েজ করার চেষ্টা করছে একদল অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষ। এর ফলে একটি বিশাল ধর্মন্ধ শ্রেণী তৈরি হচ্ছে। অনেক ধর্মগুরু প্রকাশ্যেই সাম্প্রদায়িকতা ও নারী প্রতি সহিংসতা উষ্কে দিচ্ছে। এসব অর্ধশিক্ষিত লোকেরা স্বল্পমূল্যে স্মার্টফোন কিনেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াচ্ছে নারীবিদ্বেষীতা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। মজার বিষয় হলো আমাদের দেশের কথিত অর্ধশিক্ষিত শ্রেণী সামাজিত যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণের জন্য নারীর পর্দা না করাকে দোষারোপ করায় যতটা তৎপর তার বিন্দুমাত্র্রও দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের বিপক্ষে একদমই নয়। দেশে মাদকের সহজলভ্যতার ফলে ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে ছড়ানো হচ্ছে উষ্কানী ও নারী বিদ্বেষীতা।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের উপস্থিতি ব্যপকহারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নারীদের সহজাত বিষয়গুলোকে দেখানো হচ্ছে ট্যাবু ও নোংরা হিসেবে। যান্ত্রিকতা, আধুনিকতা ও অতিরিক্তে পড়ালেখার চাপের ফলে পারিবারিক সুশিক্ষা ও নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের যে চর্চাটুকু পরিবার থেকে আসা উচিত ছিলো তা আর আসছে না। সামাজিক যোগাযোগ ও বিনোদন মাধ্যম গুলোতে সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নারীকে ভোগ্যপণ্য বানানো হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে অর্থের বিনিময়ে যৌনতা কেনা যায়। এসবের ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করার নয়। আমরা প্রতিনিয়তই এসবের শিকার হচ্ছি। বিকৃত মানসিকতার বিষবাষ্পে চারিদিক ভারী হয়ে আসছে। সবই যেন গা সহা হয়ে গেছে। ধর্ষণ হয়েছে একদল প্রতিবাদ করছে, একদল নারী বিদ্বেষীতা ছড়াচ্ছে, আরেকদল যেমনটা ধর্ষণ করার তেমনটাই করে যাচ্ছে। কিছু কাপুরুষ দলবেঁধে ধর্ষণের জন্য নারীর পোষাককেই দায়ী। এই তথইবচ অবস্থায় ঘটছে এসব অমানবিক অপরাধ। আমরা যেন শুধুই নির্বাক দর্শক। আমাদের কিছু করার নেই, কিছু বলার নেই, যেন নির্বাক চেয়ে থাকা।

দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এসেছে। আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছি বিশ্বায়নের যুগে। তবে আমাদের মানসিক উন্নতি তলানিতে ঠেকছে। শ্রেণী লিঙ্গ-বৈষম্যহীন স্বপ্নের সোনার বাংলার স্বপ্ন কী তবে আমাদের অধরাই থাকবে! অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের পঙতি ‘ এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না’

ইফতেখার উদ্দীন
সংবাদকর্মী, চ্যানেল আই

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।