সত্য বলে ক্ষমা চাইতে হয় না মোশাররফ করিম

জব্বার হোসেন
জব্বার হোসেন জব্বার হোসেন , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৪:১৮ পিএম, ২৫ মার্চ ২০১৮

আমি খোলামেলা পোশাক পরি, কী বোরকা পরি, কিছু পরি কী না পরি, এসব আসলে কোনটিই বিষয় নয়, ধর্ষণ যে করবে সে করবেই। কিছু পরলেও করবে, না পরলেও করবে, আমার অন্তত তা-ই মনে হয়।

সম্প্রতি শক্তিমান অভিনেতা মোশাররফ করিম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সচেতনামূলক একটি অনুষ্ঠানে ‘পর্দা ও ধর্ষণ’ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে, সচেতন করতে গিয়ে রীতিমত কিছু উগ্রবাদি, অপব্যাখ্যাকারীদের রোষাণলে পড়েছেন।

মোশাররফ করিমের অনুষ্ঠানটির ভিডিও দেখেছি নিজেও। আমার পরিচিত অনেকের উপস্থিতিও ছিল সেখানে। মোশাররফ তো মন্দ কিছু বলেননি, অন্তত যা বলেছে তা মোটেও মন্দ কিছু মনে হয়নি। হবে কেন, যুক্তি যদি থাকে, সত্য যদি হয় সে কথা? মোশাররফ বলেছেন, মেয়েদের যৌন হেনস্তের জন্য পোশাক দায়ী নয়। তাই যদি হবে তবে ৭ বছরের মেয়েশিশু কেন ধর্ষণের শিকার হয়? মেয়েদের পোশাক নয়, পুরুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা নোংরা ধর্ষণ ইচ্ছেই, দায়ী ধর্ষণের।

শুধু তাই নয়, খুব চমৎকারভাবে ইমাম গাজ্জালী (রা.) থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘দেয়ার ইজ থারটিন এনিমিজ ইনসাইজ ইউ। জিহাদ তো করতে হবে এই শত্রুর বিরুদ্ধে।’ দারুণ বলেছেন মোশাররফ, ধর্মেও আছে নফ্সকে দমন করার কথা। মানুষের নিজের ভেতরের অপইচ্ছে, অনুচিত, অন্যায় প্রবৃত্তিকে দমনের কথা।

আরেকটি দারুণ কাজ করেছেন মোশাররফ করিম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছেলেদের নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে শপথ করান, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন সকল পুরুষ মিলে- এর চেয়ে সুন্দর, ভালো লাগার দৃশ্য আর কি হতে পারে!

আসলে ধর্ষণকে যারা পোশাকের ছুতোয় জাস্টিফাই করতে চান, তারা ভেতরে ভেতরে ধর্ষকামী। তারা কোন না কোন ছুতোয় ধর্ষণকে সমর্থন করেন, অনুমোদন করেন। কোন মেয়ে ধর্ষিত হলে, ভেতরে ভেতরে বাহবা দেন- ধর্ষককে।

কোন মেয়ে ধর্ষণ হলেই সেই ধর্ষণটিকে সমর্থন দেয়ার জন্য আমরা যুক্তি হাতড়াই, কারণ খুঁজতে থাকি ধর্ষণের পক্ষে। ধর্ষকের পক্ষে। খুব বিস্ময়করভাবে অত্যাচারিতের পাশে না দাঁড়িয়ে, দাঁড়াই অত্যাচারীর পাশে। নিপীড়ক, বর্বরের পাশে। মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে দাঁড়াই, অমানুষের পাশে।

কোন মেয়ে ধর্ষণ হলো। কেন হলো? সে নিশ্চয়ই উত্তেজক পোশাকে পরেছিল, সে নিশ্চয়ই রাত করে বাড়ি ফিরছিল, সে নিশ্চয়ই পার্টিতে গিয়েছিল, সে নিশ্চয়ই একা ছিল। কত শত যুক্তি! কিন্তু বলি না কেউ, কেউ একা বেরুতেই পারে, কারো রাতে ঘরবার হবার প্রয়োজন হতেই পারে, কোন মেয়ে একা থাকতেই পারে, কোন মেয়ে তার ইচ্ছেমত পোশাক পরতেই পারেন, এটা তার নিজস্বতা, মানুষ হিসেবে তার চলাফেলার, জীবনযাপনের অধিকার। কিন্তু তাকে ধর্ষণ করতে হবে, এ অধিকার কোনও পুরুষকে কে দিয়েছে?

আসলেই পোশাকের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই ধর্ষণের। প্রাচীনযুগেও ছিল না, মধ্যযুগেও ছিল না, এখনও নেই। প্রাচীনকালেও লুণ্ঠন ও ধর্ষণ ছিল। লুটেরা, লম্পট তখনও ছিল। তবে তা সবাই হয় না, হয় কেউ কেউ। এখনও আছে।

মোশাররফ করিম তো ৭ বছরের মেয়ের কথা বলেছেন। সারা দুনিয়াজুড়ে আরও আরও আরও কম বয়সী মেয়েশিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। প্রচুর মানুষ রয়েছে যারা ‘চাইল্ডপর্নোগ্রাফি’ দেখতে ভালবাসে। সেখানে মেয়েশিশুদের ইচ্ছেমত, ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তা করা হয়, নির্যাতন করা হয়। এসব অবুঝ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের সঙ্গে যৌনতার কী সম্পর্ক থাকতে পারে।

আসলে ব্রা বা বোরকাও বিষয় নয়। তাই যদি হতো, হবে পৃথিবীর প্রতিটি সী বিচ ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হতো। আমি ব্রা বিকিনির প্রচারণা করছি না, প্রতিটি দেশ, জাতির যে নিজস্বতা, সংস্কৃতি রয়েছে সেটির কথা বলছি। ধর্ষণের সঙ্গে মুসলিম, অমুসলিম দেশ, ভূগোলেরও সম্পর্ক নেই। বোরকা, অবোরকার, হিজাব, বেহিজাবেরও সম্পর্ক নেই। আছে এক শ্রেণির পুরুষের অসভ্য, বর্বর মানসিকতার সম্পর্ক।

বোরকা পরা মেয়েরা যে ধর্ষিত হচ্ছে না অমন তো নয়। বিকৃতকাম পুরুষদের হাত থেকে মাদ্রাসা, মক্তবের মেয়েরাও কি ছাড় পায়। ধর্ষণ আসলে একটি মানসিকতার ব্যাপার। বিকৃতির বিষয়। আগেও বলেছি, ধর্ষণ মানসিক বিকৃতির একটি বিশেষ দশা। তার আনন্দ চুমুতে নয় কামড়ে, জড়িয়ে ধরাতে নয় জবরদস্তিতে, যৌনতায় নয় পাশবিকতায়। তা যদি না হয় তবে ধর্ষকেরা মেয়েদের যৌনাঙ্গে কেন লাঠিসোটা, রড, বল, বোতল ঢোকাবে?

যৌন ইচ্ছে, আকাঙ্খা মানুষের থাকবেই। এ বড় সহজাত। তাই বলে তা পাশবিক হবে কেন? মানুষ বলেই তো মানুষের যৌন আচরণ, মানবিক। ধর্ষক সকলেই হয় না, কোন দিন হবেও না। ধর্ষণ আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে পুরুষকেই সোচ্চার হতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। বলতে হবে, বোঝাতে হবে। তবেই সে প্রকৃত পুরুষ, মানবিক মানুষ। চেহারা, জুতো, জামা, চলাফেরা কোন ছুতোয়ই ধর্ষণের মতো বিকৃত আচরণ কাম্য নয়।

মোশাররফ করিম ঠিক প্রতিবাদই করেছিলেন, বলেছিলেন, যে কথাগুলো আগুনের মতো সত্য। সাহসী মানুষই সত্য বলতে পারে। কিন্তু মোশাররফ করিম সত্য বলার পরও ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। ক্ষমা না চেয়ে আপনি ব্যাখ্যা দিতে পারতেন, মোশাররফ। বিশদ ব্যাখ্যা। তা না করে সত্যের আগুনে জল ঢেলে নিজেকে দুর্বল মানুষে রূপায়িত করলেন, এ বড় লজ্জার, এ বড় সাহসহীনতার।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/পিআর

প্রচুর মানুষ রয়েছে যারা ‘চাইল্ডপর্নোগ্রাফি’ দেখতে ভালবাসে। সেখানে মেয়েশিশুদের ইচ্ছেমত, ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তা করা হয়, নির্যাতন করা হয়। এসব অবুঝ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের সঙ্গে যৌনতার কী সম্পর্ক থাকতে পারে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।