মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ২৪ মার্চ ২০১৮

 

বাংলাদেশ অচিরেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হতে চলেছে। জাতিসংঘের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)’র এই খবর এখন ব্যাপক আলোচিত।

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের শর্ত হলো মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা— এই তিনটি সূচকের যে কোনো দুটিতে সিডিপির নির্ধারিত মান অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই নির্ধারিত মান অর্জন করেছে।

মাথাপিছু আয়ে এর সূচক হচ্ছে ১২৩০ মার্কিন ডলার। সিডিপির হিসাব অনুযায়ী আমাদের অর্জন হয়েছে ১২৭২ ডলার। দ্বিতীয়ত, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকের মান হচ্ছে ৬৬ বা তার বেশি। সিডিপির হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের আছে ৭২ দশমিক ৮। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মান হচ্ছে ৩২ বা তার কম। সিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ অবস্থান ২৫।

আনন্দের খবর সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা শুধু সূচকের নয়, মানেরও উন্নতি চাই। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হতে চললেও দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে, যা নিয়ে উদাসীন থাকলে চলবে না। তিনি বলেন, “আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক চেষ্টা করছি। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আমরা এখনও দারিদ্র্য শেষ করতে পারিনি।”

একটি সমাজে বাণিজ্যে যতই বাড়বাড়ন্ত হোক, অল্প কিছু লোক যতই ‘বিলিয়নিয়ার’ হয়ে উঠুক, তাদের বস্তি পরিবেষ্টিত, হাজারো ভৃত্যপরিচারিত ব্যক্তিগত বাড়ি যতই ঝা চক চকে দেখাক, উৎকট বৈষম্যের ফলে সেই সমাজ আসলে উন্নয়নের নামে অনুন্নয়নের সাধনা করছে, তা বুঝতে হবে।

উত্তরণ, উন্নতি, উন্নয়ন- এই শব্দ সমুহের সাথে সমৃদ্ধির সম্পর্ক, তেমনি সৌন্দর্যেরও সম্পর্ক। এই সৌন্দর্য হলো সুষম উন্নয়ন। যার বিপরীত হল বৈষম্য। আমরা এগিয়ে চলেছি, আমরা আরও এগিয়ে যাব। কিন্তু কেমন এক হৃদয়হীন সমাজের সূচনা করেছি তা নিয়ে ভাবছি কম। অপর মানুষ বা প্রাণীকে উৎপীড়িত, যন্ত্রণার্ত, দুঃখী দেখে এখন আর সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের মনে সমবেদনা জাগে কিনা এই বৈভবের সমাজে থেকে বুঝতে পারিনা। প্রতিকারহীন অন্যায় অবিচার দেখতে দেখতে একটি প্রজন্ম বড় হচ্ছে।

বর্তমান বাংলাদেশের ধনিক শ্রেণি সরাসরি জননিপীড়ক নয়। সরকারেও কাগজকলমে জনকল্যাণকারী, দরিদ্রতমের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখার নানা কর্মসূচি আছে। বাজারি অর্থনীতির আদর্শে উচ্চবিত্ত সমাজও গরিবি হঠানোর কথা বলে। কিন্তু বিষয়টা এমন সরব নয়। মাথাপিছু আয় যত বাড়ছে, বৈষম্য তত উৎকট হচ্ছে।

সরকারের লোকজনের বেতন, ভাতা, নানা ধরনের উপহার বেড়েছে, তারা স্ফীত হয়েছে। বেতনের বাইরে স্পীড মানির বদৌলতে তাদের উপরি আয়ের স্পীডও দ্রুতগতিতে ধাবমান। সরকারের বাইরে বিশাল বাণিজ্য জগত থাকলেও কর্মসংস্থান হচ্ছে খুব কম। আবার হলেও পারিশ্রমিকের স্বল্পতায় দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করছে বিশাল এক জনগোষ্ঠী।

যে বিরাট জনগোষ্ঠী কৃষিকাজে জড়িত, যাদের সৃজনশীলতায় এই বিশাল জনসংখ্যা খেয়ে পরে আছে, তারাও লড়াই করে দামটুকু পেতে। অন্তহীন দুর্নীতি, সরকারী উপহারে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি হওয়ায় তারা প্রভূত্ব করছে আর সবার ওপর। আর এভাবে বৈষম্য বেড়ে চলেছে লাগামহীন।

এই যে ক্ষুদ্র কিন্তু অতি শক্তিশালী শ্রেণির কথা বলছি, এরা একজোট হয়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর খাটুনির ফল বিনাশ্রমে উপভোগ করছে। আর এর ফলে তাদের শ্রমের বেতন কমতে কমতে তলানীতে গিয়ে ঠেকছে। বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এবং এই হার ক্রমবর্ধমান।

আমরা ৭ শতাংশও অতিক্রম করেছি। কিন্তু যে কথাটা জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন তা হলো, দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের তাণ্ডব কমছে না। এই যে প্রবৃদ্ধির সাথে বৈষম্য বাড়ে, সেখানে আমরা কী পেরেছি বৈষম্য নিরসনকেই উন্নয়নের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করে এগুতে? না পারিনি। বাজার অর্থনীতির ডামাডোলে ব্যক্তি খাত ও বাজারীকরণের নীতিকে আঁকড়ে ধরার ফলে এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে।

আর এর ফলে আমাদের ভেতর ভয়ংকর এক প্রতিযোগিতার প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয়েছে। আমার সন্তান প্রতিযোগিতায় বা চাকরির বাজারে হেরে যাব, তা আমি সহ্য করতে পারি না। শুধু চাই আমার কাছে সব হেরে যাক। আমাদের একটি নয়, অনেক বাড়ি চাই, ফ্ল্যাট চাই, দেশে শুধু নয়, বিদেশে বেগম পাড়ায় বাড়ি হোক, লুন্ঠিত সম্পদের স্তুপ হোক। এই বৈষম্যবৃদ্ধিকারী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করার ইন্ধন দিচ্ছে এই প্রবৃদ্ধির নেশা।

এই যে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেছেন বৈষম্যের কথা তা মাথায় নিতে হবে। শুধুমাত্র উন্নয়ন এর উত্তর হতে পারে না। উত্তর হবে বহুমুখী। হিংসার রাজনীতি এবং প্রতিশোধস্পৃহামূলক কার্যকলাপ যদি চলতে থাকে তাহলে তা মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে, যাদের নেতৃত্বের উৎস নিপীড়িত মানুষের সম্পদ লুটের সংস্কৃতিতে।

সমাজে যে নানা অস্থিরতা, সংঘাত – এসবের উদ্ভবের আর্থ-সামাজিক কারণ হল অত্যাচার, বঞ্চনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য, পারস্পরিক আস্থার অভাব ইত্যাদি। যদি সত্যিকারের উন্নয়ন চাই তবে শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্য দূর করা, পারস্পরিক আস্থা জাগানো, রোজগারের পথ দেখানো, সর্বোপরি মানুষের মানবিক মর্যাদার পুনরুদ্ধারের অর্থনৈতিক কর্মসূচি আসুক।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

‘যে বিরাট জনগোষ্ঠী কৃষিকাজে জড়িত, যাদের সৃজনশীলতায় এই বিশাল জনসংখ্যা খেয়ে পরে আছে, তারাও লড়াই করে দামটুকু পেতে। অন্তহীন দুর্নীতি, সরকারী উপহারে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি হওয়ায় তারা প্রভূত্ব করছে আর সবার ওপর। আর এভাবে বৈষম্য বেড়ে চলেছে লাগামহীন।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।