‘আমার উলঙ্গ ছবি ও পরিচয়’ প্রকাশ করতে পারে কি মালিন্দ এয়ার?
গণমাধ্যম অন্যের ভুলটি, অন্যায়টি ধরিয়ে দেয়, প্রকাশ করে সচেতনতার লক্ষ্যে। গণমাধ্যম যে কখনই ভুল করে না, তা কিন্তু নয়। মনে আছে নিশ্চয়ই, প্রয়াত সমাজ কল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ধূমপানের ছবিটি ভাইরাল হয়েছিল। দেশের সব নামজাদা দৈনিক পত্রিকায় চার কলামে, পাঁচ কলামে ছাপা হয়েছিল সেই ছবিটি।
মন্ত্রীর প্রকাশ্যে এভাবে সিগারেট খাওয়াটি অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু একইভাবে গণমাধ্যম পাঠকের সঙ্গে যে আচরণটি করেছে সেটিও রীতিমত অন্যায়। কোথাও, কোন পত্রিকায় কেউ একটিবারের জন্যও ছবির নিচে লেখার প্রয়োজন অনুভব করেনি যে, সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ধূমপানের ছবি যখনই প্রচার বা প্রকাশ করা হবে কোনরকম সতর্কীকরণ ব্যতিত, তখনই ধরে নিতে হবে কাজটি অন্যায়। প্রকাশ্যে ধূমপান আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে ধূমপানকে ‘গ্ল্যামারাইজ’ করেছে মিডিয়া। এটি আমার কথা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রহমানের কথা, বুঝতে চাইলে অমন ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন তিনি আমাকে।
গণমাধ্যমে সতর্কীকরণ নির্দেশনা ছাড়াই ছবির প্রকাশটি সেদিন ছিল অন্যায়। অন্তত সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার জায়গায়। অনেকেই মনে করেন গণমাধ্যমে কোন অন্যায় করতে পারে না। ধারণাটি ভুল। গণমাধ্যম কি প্রকাশ করতে, কতটুকু প্রকাশ করবে, সেটিরও নীতি নৈতিকতা রয়েছে। গণমাধ্যম চাইলেই যে কোন কিছু, যে কোনভাবে প্রকাশ করতে পারে না।
কদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশি এক যুবকের চলন্ত বিমানে স্বমৈথনের ছবিটি রীতিমত ভাইরাল। এই ছবিটি কী গণমাধ্যমে চাইলেই এভাবে প্রকাশ করতে পারে? ছবিটি দেখে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারেন। যুবকের ব্যক্তিগত রতিক্রিয়ার ছবিটি দেখে পাঠক বা দর্শকের মনে এক ধরনের ‘যৌন ভ্রান্তি’ তৈরি হওয়াও স্বাভাবিক। তাহলে কেন গণমাধ্যমে এই ছবিটি এভাবে প্রকাশ করলো? এই দায় কে নিবে?
অনেকের ভাবনায় এমন বিশ্বাসের বসবাস খুব স্পষ্ট যে, বিদেশি গণমাধ্যমে কোন বিভ্রান্তিকর কিছু প্রকাশ করে না। খুব ‘সহি’ তারা। অথচ বিদেশি গণমাধ্যমের অনেকে রয়েছে যারা আমাদের অনেক গণমাধ্যমের চেয়ে হাজার গুন পক্ষপাতদুষ্ট। শুধু তাই নয়, প্রায়শই অদ্ভুত সব যৌন সমীক্ষার কথা বলে যৌন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে। কখনও কখনও তাদের এসব সমীক্ষা সর্বোচ্চ দশজনের উপরও হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য কিছুই নয়, কাটতি ও বাণিজ্য।
তবে বাংলাদেশি যুবক প্রকাশ্যে স্বমৈথুন করে যতটা না অপরাধ করেছে, তার চেয়ে শতগুণ অন্যায় ও অপরাধ করেছে মালিন্দ এয়ার। এয়ারলাইন্সটির এই অন্যায় রীতিমত অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে। একটা এয়ারলাইন্স কিছুতেই তার যাত্রীর প্রাইভেসি নষ্ট করতে পারে না। অনেকেই হয়তো জানেন না, মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশগামী এই যুবকটি ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ।
পুলিশের কাছে তার বাবা মেডিক্যাল সার্টিফিকেটও উপস্থাপন করেছেন। যৌন বিজ্ঞান বলছে, নারী বা পুরুষের স্বমৈথুন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিবাহিত অবিবাহিত পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বমৈথুন করেই থাকে। কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞান বলছে, স্বমৈথুন স্বাভাবিক তবে তা প্রকাশ্যে জনসম্মুখে করা স্বাভাবিক নয় এবং অন্যায়। আমি স্বমৈথুনের বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না।
আমার আপত্তি ও প্রতিবাদের জায়গাটি হলো, বিদেশি গণমাধ্যম ও মালিন্দ এয়ারলাইন্সের আচরণ। কোথাও কেউ একটিবারের জন্যও উল্লেখ করেনি যে, যুবকটি মানসিকভাবে অসুস্থ। যদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ সে যে অসুস্থ সে সময় এটি জানিয়ে দিতো, তবে অস্বস্তিতে পড়তে হতো না অন্য যাত্রীদের। তারা তার বাবার সঙ্গেও কথা বলতে পারতো। এমনকি সে যদি পাবলিক নুইসেন্স করে থাকে, তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি ও দেওয়া যেত।
এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের ‘সম্মানিত’ যাত্রী বলে থাকে শুরুমাত্র বাণিজ্যিক কারণে। বিমানের ভেতর যখন অন্য যাত্রীরা তার ছবি তুলছিল, ভিডিও করছিল, সে সবের দায়ও এড়িয়ে যেতে পারে না মালিন্দ এয়ার। তার উলঙ্গ ছবি বা পাসপোর্টের ছবি যেখানে যুবক যাত্রীটিকে স্পষ্ট চেনা যায়, তার প্রাইভেসি পাবলিক করার কোন অধিকার মালিন্দ’র নেই।
মালিন্দ অসম্মান করেছে, কেবল মানসিকভাবে অসুস্থ যুবকের ছবি পরিচয় প্রকাশ করে নয়, বাংলাদেশকেও। ভুলে গেলে চলবে না, মালয়েশিয়াতে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের ৬ ভাগের ১ ভাগ বাংলাদেশি। এরা আমাদেরই বাবা, আমাদেরই ভাই। এয়ারলাইন্সটির যাত্রীদের বড় একটি অংশ এই আমরাই। কোনো যুক্তিতে মালিন্দ কি পারে, আমি যেই হই, যাই হই, যাত্রী হিসেবে আমার নগ্ন ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করতে?
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর