ঐক্যেই মুক্তি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১০ মার্চ ২০১৮

 

মাত্র কয়দিন আগে, বইমেলার শেষ প্রান্তে আলোকিত মানুষ স্মরণ করছিল বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তমনা মানুষ অভিজিৎ রায়কে। তিন বছর হলো তার খুনের, কিন্তু এখনও আসল খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনভাবে বিচারের অপেক্ষায় আছে আরও কত বিদ্বজ্জনের হত্যার বিচার। বইমেলা শেষ না হতেই আবার আঘাত। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, নিজ ক্যাম্পাসে আক্রান্ত হয়েছেন এ মুহুর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক জাফর ইকবাল।

তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। কিন্তু হত্যা চেষ্টার ধরন সেই খুনিদের মতো, যারা আগের খুনগুলো করেছে। হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল সালাফি মতাদর্শী, যে মতাদর্শ কোন কোন রাজনৈতিক দলের দর্শন। ফয়জুর জাফর ইকবালের কোন বই পড়েনি, বলতেও পারবেনা তাঁর কোন লেখাটি ধর্ম বিরোধী। কিন্তু তার মনে হয়েছে। মনে হয়েছে কথাটা সে বলছে, কিন্তু আসলে তাকে কাজটা করতে বলা হয়েছে।

সত্যি বলতে কি, এই যে আলোকিত, উদার মানুষদের টার্গেট করে করে হত্যা, পরিকল্পনা করে শিয়া-সুন্নি-আহমদিয়া বিরোধ লাগানোর চেষ্টা– জঙ্গিবাদের এই যে বাড়বাড়ন্ত, তার প্রেক্ষাপট অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল। শুধুমাত্র বেগবান হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ থেকে ছিটকে যায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এরপর থেকেই সামরিক শাসকদের প্রত্যক্ষ মদদে মুক্তিযুদ্ধের ‘বিরোধী পক্ষ’ দেশ পরিচারনা করতে শুরু করে।

এদের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী ইসলামি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি তার অবস্থান শক্ত করে নেয়। যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হয়নি শুধু, তাদের মন্ত্রীত্ব দেয় এমন দল যে দলের নেতারা আবার দাবি করে যে তারা নাকি মুক্তিযোদ্ধার দল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার সকল রসদ এদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

আজ সেই ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ। কোন দল এই শক্তির থাবা থেকে মুক্ত নয়। ১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশ মূলত ‘ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ এবং ‘ধর্ম ব্যবসার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ এই দুই ধারায় ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম ধারাটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগেই থেকে যায়, যদিও আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের আপস করতে দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ধারাটি শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান তার দল বিএনপি’র মাধ্যমে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সেই ২০০৯ সাল থেকেই একের পর এক ষড়যন্ত্র। বিচার শুরু হলে রীতিমত একাত্তরের মতো আরেক বাংলাদেশ বিরোধী যুদ্ধ শুরু করে বিচার বিরোধীরা।

আওয়ামী লীগ বিচার করেছে, ব্যক্তিগতভাবে অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন শেখ হাসিনা নিজে। এমনকি যুত্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তাঁকে বিচার থেকে সরে আসার জন্য চাপ দিয়েছে। কিন্তু সেই চাপ মোকাবেলা করে তিনি এগিয়েছেন। জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ বড় কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যকর হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির নানা রসায়নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।

জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর শাহবাগে মানুষ ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু তারা বেদনাহত হয়ে দেখেছে বিভক্ত শাহবাগকে। একদিকে ইমরান এইচ সরকারের গণজাগরণ মঞ্চ, অন্যদিকে ইমরান বিরোধী বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। এটাই দেশের নিয়তি। প্রশ্ন জাগে অসাম্প্রদায়িক মানুষ বা দল, সবটুকু শক্তি দিয়ে, এক হয়ে লড়াই করতে পারেনা? কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলরা পারে। মতাদর্শগত ব্যাপক বিরোধ স্বত্বেও তারা খুনেও এক, খুনকে জায়েজ করার ক্ষেত্রেও এক।

অভিজিৎ রায়দের মরতে হয়, জাফর ইকবালদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কারণ তারা মহাবিশ্ব আর অস্তিত্বের বাস্তবতা নিয়ে, ধর্ম ও কুসংস্কারের অসারতা নিয়ে, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজন নিয়ে কথা বলেন। তারা সব ধর্মের মানুষের প্রতি সহিষ্ণু হতে বলেন। মুক্তচিন্তার গতিকে স্তব্ধ করতে লাগাতার আক্রমণের শিকার যারা হচ্ছেন তার সাম্প্রতিকতম সংযোজন জাফর ইকবাল।

খুনের পক্ষে এক বিশাল সদাজাগ্রত শক্তি। তারা তাদের চিন্তা, ভাবমূর্তি বা অনুভূতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহিংসতার আশ্রয় নেয়, যুক্তিবাদী শান্তিপ্রিয় চিন্তাবিদদের কলম চিরতরে বন্ধ করে দিতে হত্যা করে। আবার নানা প্রান্ত থেকে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শোরগোল করে গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়েই, যে গণতন্ত্রকে তারা আবার কোন শাসন ব্যবস্থাই মনে করেনা।

হুমায়ুন আজাদ বাঁচতে পারেন না, অভিজিৎ, দীপনরা বাঁচতে পারেনা, দেশ ছাড়তে হয় লেখকদের। দুর্ভাগ্য গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। সাধারণ মুসলমানের এসব নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই, আর ধর্মের প্রশ্নে মনোবেদনা হলেও তা নিয়ে রাস্তায় নামার কথা তারা ভাবেন না। তাই বলে অবশ্য তাদের ভাবানোর কিংবা উস্কানোর লোকের অভাব নেই। কারা সেই প্ররোচক? এই প্ররোচকরা আছে রাজনীতিতে, আছে সামাজিক মাধ্যমে যারা নিরন্তর ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা রটাচ্ছে। হামলাকারী ফয়জুরের চেয়ে এরা বড় অপরাধী। গোয়েন্দাদের সেই দিকে নজর আশা করছি।

কিন্তু যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরতে হয়। এই হত্যাচেষ্টা কোন বিক্ষিপ্ত জঙ্গি হামলা নয়। একটি অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুচিন্তিত হামলা হিসেবেই বিবেচনায় নিতে হবে। পুলিশী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইনী পদক্ষেপ রাষ্ট্র দেখবে। কিন্তু একটা বিষয় ভাবাচ্ছে বিশেষ করে। প্রগতিশীল মানুষদের অনেকেও মুখ খুলছেনা। এটি বিপজ্জনক।

এই নিষ্ক্রিয়তা, নির্লিপ্ততা আত্মহত্যার শামিল। যারা উদারনৈতিক পরিবেশ চান, তাদের আজ সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। বিভেদ ভুলে ঐক্যের পথে চলা প্রয়োজন। শাহবাগের দুই প্রান্তে দুই সমাবেশ নয়। চাই সারাদেশ পরিণত হোক এক শাহবাগে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি, অসাম্প্রদায়িক শক্তি তার পুরোটা নিয়ে আজ মাঠে থাকুক ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ একটা ঐক্যের ডাক দিক। সবাই এগিয়ে আসুক। ঐক্য সংকল্প তৈরি করে, সংকল্প ঐক্যকে দৃঢ় করে, দুয়ের মিল অপশক্তি দূর করবে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

`জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর শাহবাগে মানুষ ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু তারা বেদনাহত হয়ে দেখেছে বিভক্ত শাহবাগকে। একদিকে ইমরান এইচ সরকারের গণজাগরণ মঞ্চ, অন্যদিকে ইমরান বিরোধী বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। প্রশ্ন জাগে অসাম্প্রদায়িক মানুষ বা দল, সবটুকু শক্তি দিয়ে, এক হয়ে লড়াই করতে পারেনা? কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলরা পারে। মতাদর্শগত ব্যাপক বিরোধ স্বত্বেও তারা খুনেও এক, খুনকে জায়েজ করার ক্ষেত্রেও এক।‘

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।