জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাত, দোষ আমাদের সবারই
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছুরিকাঘাত হওয়ায় ফেসবুকজুড়ে যতটা উত্তাপ, উত্তেজনা, আন্দোলন বাস্তবে কিন্তু তা মোটেও নয়। বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। শাহবাগে কিছু সমাবেশ হয়েছে। মিছিল হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে। আন্দোলন হচ্ছে আসলে ফেসবুকে। ফেসবুক ভার্চুয়াল, নট রিয়াল। বাস্তবতার সঙ্গে পার্থক্য এখানেই। ফেসবুকে অনেক কিছু লেখা যায়, করা যায়। কিন্তু কার্যকর কিছু করতে হলে, আন্দোলন করতে হলে, যেতে হয় রাস্তায়। নামতে হয় পথে। এর কোন বিকল্প নেই।
স্বীকার করি অথবা না করি যে বাস্তবতাটি এসে দাঁড়ায়েছে তা বড় হতাশার। জাফর ইকবালের মতো শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, জনপ্রিয় একজন লেখককে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে সারা দেশজুড়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝড় উঠার কথা, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে আন্দোলন করার কথা, নিন্দে প্রকাশ করার কথা সরবভাবে, বাস্তবে তা দেখা যায়নি মোটেও। এ বাস্তবতা বড় ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এ বাস্তবতা প্রমাণ করে, আমরা কেউ কারো না, কেউ কারো জন্য না, আমাদের কোন কিছুতেই, কোন যায় আসে না। এ বাস্তবতা প্রমাণ করে আমরা নির্মম, অসভ্য ও স্বার্থপর। আমি’র বাইরে, স্বার্থ অর্থের বাইরে আমাদের আর কিছু নেই।
আমরা যেমন অসভ্য, আমাদের বড় দু’দলের নেতাদের কেউ কেউ আরও অসভ্য ও ভয়ঙ্কর। তারা এই হত্যাচেষ্টাটির সুষ্ঠু বিচার ও তদন্তের কথা না বলে, কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছেন পরস্পর। ‘আমরা নই, তোমরা’, ‘নানা আমরা নই, তোমরা’- এটাই তো এখানকার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি ঘাতককে, অপরাধীকে, অন্যায়কারীকে সুযোগ তৈরি করে দেয়। সুযোগ আগেও তৈরি করে দিয়েছে। পার পেয়ে গেছে অপরাধীরা। তা নয়তো হত্যা ও মৃত্যুর মিছিল হতো দীর্ঘ হয়!
‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি’- হামলাকারী ফয়জুরের নিজের স্বীকারোক্তি। জাফর ইকবাল জঙ্গি হামলার স্বীকার, মৌলবাদী আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু তিনি অনেককাল আগে থেকেই। জঙ্গিরা তাকে হিট লিস্টে রেখেছিল। কাফনের কাপড় পাঠিয়েছিল তার প্রযত্নে, সেও পুরনো। জাফর ইকবাল তাদের লক্ষ্য বস্তু হলো কেন? তিনি খুব সহজ ভাষায়, সংক্ষেপে স্বল্পমূল্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিবরণ করেছেন দেশব্যাপী। তিনি, কিশোর বয়সীদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে চান, কল্পবিজ্ঞান লেখেন। জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার।
মুক্তিযুদ্ধে জাফর ইকবালের পরিবারের অবদান অনেক বড়। তার বাবা ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশের একজন সৎ, আদর্শবান কর্মকর্তা ছিলেন। যুদ্ধের সময় মা আয়েশা ফয়েজকে সঙ্গে নিয়ে পিরোজপুরে বাবা ফয়জুর রহমানের লাশ খোঁজার যে বর্ণনা, তার বইয়ে রয়েছে তা যে কোন মানুষ শিউরে উঠবে- বড় মর্মান্তিক, বড় হৃদয় বিদায়ক। তার বাবা ফয়জুর রহমানের হত্যাকারী আর এই হামলাকারী এরা মূলত একই সুতোয় গাঁথা।
‘হামলাকারী ফয়জুর আসলে ‘অপারেটর’, অন্যরা ‘প্ল্যানার’। প্ল্যানাররা বরাবরই নেথ্যের, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। ফয়জুররা সামনে আসে। ফয়জুরদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে ধর্মের ভুল, বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে। ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মস্কিষ্কের নিউরনে, কোষে কোষে। দোষ আমাদেরও কম নয়, যারা ‘মাদ্রাসা’ বলে ফয়জুরদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। বেশির ভাগ মাদ্রাসা আসলে অন্ধকার, কারাগার। সেখানে তো কেউ আলো পৌঁছে দেইনি। তাদের কাছে অতিমাত্রায় পৌঁছেছে ভুল ব্যাখ্যা আর ধর্মান্ধতা। তাদের আমরাই দূরে সরিয়ে রেখেছি। মূলধারার বাইরে রেখেছি। এ দোষ আমাদের।
মাদ্রাসার ছেলেটি বা ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেটি কারো কাছেই তো ‘বাংলাদেশ’ নেই। সে আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগে। একজন নিজেকে আরব ভাবতে চায়, অন্যজন ইউরোপ। তারা নিজেদের ইতিহাস, ঐহিত্য, সংগ্রাম, অর্জন না জানার কারণে শেকড়হীন, ফলে যে কোন স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিতে পারে। নানা প্রলোভন, আয়োজন, প্রস্তাবে পা বাড়ায় জঙ্গিবাদের দিকে। সমাজে বহুমতের, বহুত্ববাদের সুযোগ নেই। সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছি আমরাই। রাষ্ট্র ধর্ম করেছি, রাষ্ট্রের অন্য ধর্মের মানুষদের কথা একটিবারও চিন্তা না করে। রাষ্ট্রের ধর্ম থাকবে কেন? রাষ্ট্র কি কোন ব্যক্তি? তবে তো রাষ্ট্রের লিঙ্গও থাকতে বাধ্য। রাষ্ট্র নারী না কি পুরুষ? রাষ্ট্র তো ইহজাগতিক ধারণা। রাষ্ট্রে প্রত্যেকেই তার বিশ্বাসের অনুগামী হয়ে ধর্ম পালন করবে। যখন শুধুমাত্র একটি ধর্ম পরিচয় হবে রাষ্ট্রের, অন্য সবার সঙ্গে সংঘাত তখনই অনিবার্য।
ধর্ম আর ধর্মান্ধতা এক নয়। ধর্মান্ধতাকে কে, জঙ্গিবাদকে, মৌলবাদকে অনেককাল ধরে এখানে দুধ কলা দিয়ে পোষা হয়েছে। পুষেছে ক্ষমতাবানরা, যে যার স্বার্থে। কেউ ভোটের স্বার্থে, কেউ জোটের স্বার্থে। অথচ তার বিপরীতে ধর্মের সত্যিকারের উদারতা, মানবিকতা, শক্তি ও সৌন্দর্য প্রচার করেনি। ফলে ধর্মান্ধতার চারাগাছ এখন মৌলবাদের বিশাল বৃক্ষ। যে বৃক্ষের ডালপালা, শেকড় সারা দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ। যার হাত থেকে কেউ-ই নিরাপদ নয়, এমনকি ধার্মিকও।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর