পাল্টে দেয়, পাল্টে যায়

নাসরীন মুস্তাফা
নাসরীন মুস্তাফা নাসরীন মুস্তাফা
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

‘বল তো, চট্টগ্রামের পুরনো নাম কি?’
হাতের কাছে ছোট বাচ্চা পেলেই তাকে নানান প্রশ্ন করেন বলে বাচ্চারা কাছে যেতে চায় না। দাদাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে আমিও সাথে থাকা চাচাত ভাই-বোনদের কাছ থেকে সাবধান বাণী শুনছিলাম। কিন্তু প্রশ্নটা যখন তিনি করলেন, তখন আমার ভয় কেটে গেল। ভাগ্যিস বই পড়ে জেনেছিলাম, চট্টগ্রামের পুরনো নাম জাহাঙ্গিরাবাদ। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে নামকরণ করা হয়েছিল চট্টগ্রাম তথা চাটগাঁও-এর।

আমার জবাব শুনে দাদীর হলদে ফর্সা মুখটায় হাসি ভরে উঠল। কাছে টেনে নিয়ে আদর করলেন। আমি সেই ছোট বয়সেই বুঝলাম, প্রশ্নের জবাবটা জানা ছিল বলে এই পুরস্কার। আর জবাবটা পেয়েছিলাম বলে বই পড়ার প্রতি আমার ভালবাসা আরো বেড়ে গেল। দাদীর অনেক পড়ার অভ্যেস ছিল। উনি যা হাতের কাছে পেতেন, তা-ই পড়তেন। কোন দিন স্কুলে যাননি, কিভাবে কিভাবে যেন পড়তে শিখেছিলেন। বাংলা তো বটেই, তিনি ইংরেজিও জানতেন। শুনেছিলাম, কাজী ইমদাদুল হকের বিখ্যাত উপন্যাস আব্দুল্লাহ্ তাঁর পড়া ছিল। কলেজে উঠে এই উপন্যাসটি পেলাম পাঠ্য হিসেবে। এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি, আর চোখ ভিজে উঠেছে এই ভেবে যে, দাদী যদি বেঁচে থাকতেন, এই আব্দুল্লাহ্ নিয়ে কত কথাই না হ’ত আমাদের! আমার পড়ুয়া দাদীটা তখন ছেড়ে গেছেন আমাদের। আফসোস! তাঁর রেখে যাওয়া ছেলে-মেয়ে-নাতি-পুতিদের মাঝে কেবল মাত্র আমার আব্বা আর আমি পেলাম তাঁর পড়ার অভ্যেসটা।

দাদীকে নিয়ে আমার প্রথম স্মৃতি এটাই। এক হলদে বিকেলে তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘বল তো, চট্টগ্রামের পুরনো নাম কি?’
অজপাড়া গাঁয়ের এক গ্রাম্য বধূ বই পড়তে শিখেছিলেন বলেই তাঁর ঘর-বাড়ির উঠান-গ্রাম তো বটেই, না দেখা শহর-দেশ আর পৃথিবীর খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলেন। এই ভ্রমণ আমারও আছে। আমি জানি, চাঁদের মাটিতে পা রাখার পর বুকের ভেতর কেমন ডুগডুগি বেজে ওঠে। রবিনসন ক্রুসোর সাথে নির্জন এক দ্বীপে নির্বাসনে যখন ছিলাম, রুটি গাছের ফল খেয়ে দিন কাটাতে কত যে ভাল লেগেছিল! চাঁদের পাহাড়ে ভয়ংকর দানোর অপার্থিব গর্জন শুনে কেঁপে উঠেছি, তবুও ভয় পাইনি। হীরার গুহাটা কখন খুঁজে বের করব, তা নিয়ে কম রোমাঞ্চিত ছিলাম না। আমি জানি, পৃথিবীর পথে আমার বয়সটা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই মোগলি হয়ে যাই। আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমন করছি বেলুনে চড়ে, সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে উড়ে যাচ্ছে আমার বেলুন, এখনো! এক জীবনে এত এত অভিজ্ঞতা, বেঁচে থাকার এত এত আনন্দ আমি আর কোথায় পেতাম!

বই পড়তে পড়তেই বুঝে গেলাম, লেখক ইচ্ছে করলেই যা খুশি তাই ভাবতে পারে। জিওফ্রি চসার তাঁর ছেলের জন্য লিখেছিলেন ‘ট্রেটিজ অন দ্য আস্ত্রলব’, ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রথম বিজ্ঞানের বই সম্ভবত এটিই। আমি লিখতে শুরু করেছিলাম আমার ভাইয়ের জন্য। আমি আর আমার ছোট ভাইটা একা একা বাসা পাহারা দিই, আব্বা-আম্মা অফিস থেকে ফেরেননি। অপুর দুর্গার মত আমি আমার ভাইকে ঝড়ের দিনে অন্যের বাগানে আম কুড়ানোর নিষিদ্ধ আনন্দ দিতে পারিনি। তবে ওর দুষ্টুমি সামলানোর জন্য ছোট্ট খাতায় পেন্সিল দিয়ে মিষ্টি একটা হাতির কান্ড-কারখানা লিখেছিলাম। ও তখনো পড়তে পারে না। যা লিখতাম, তা আবার পড়ে শোনাতে হ’ত। ওর জন্য লিখতে লিখতে আমি পেন্সিল ছেড়ে এক দিন কলম ধরেছিলাম। মনে আছে, ‘লক্ষ তারার মানিক জ্বলে’ নামে একটি উপন্যাস লিখছিলাম। মানিক চরিত্রটি মুক্তিযুদ্ধ করছে। আমি ষড়যন্ত্র এঁটে ফেলেছি, মানিককে মেরে ফেলব। যুদ্ধে শহীদ হবে মানিক। আমার ভাই ওটুকু পড়ে আমাকে থ্রেট দিল। খবরদার, মানিককে মারা যাবে না। ওর জন্যই অবশেষে বেঁচে গেল মানিক!

বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশ হ’ল ‘লক্ষ তারার মানিক জ্বলে’ বইটি। বেশ কয়েকটি সংস্করণও বেরিয়ে গেল। কর্মসূত্রে দুবাই ছিলাম, তখন এক শিশু-সংগঠনকে বইটি উপহার দিলাম। বেশ কিছু দিন পর সংগঠনের এক ক্ষুদে পাঠক আমার সামনে এসে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মানিকের খোঁজ চাইল। মানিক ঢাকা শহরে অপারেশন করতে যাচ্ছে, এরকম একটি সময়ে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে। পাঠক আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, মানিক কি ঢাকায় গিয়ে ওর বাবার খোঁজ পেয়েছিল? কাল্পনিক মানিকের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার কান্ড আমাকে আবেগপ্রবণ করে তুলল।

ছুটির দুপুর, বিছানায় শুয়ে থাকা আমি, আমার হাতে বই, গায়ে কাঁথা, বিছানার পাশে জানালা, জানালার ওপাশে কাঁঠাল গাছ- বইয়ের সাথে এক সময় জানালা গলে বেরিয়ে পড়লাম গল্পের দেশে- এর চেয়ে সুন্দর ভাবনা আছে কোথাও? স্থাপত্যে পড়ালেখা করেছিলাম বলে বাড়িঘরের নকশার কাজটা বুঝি। আমার হাত নিশপিশ করে ঘরের দেয়ালগুলো মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বইয়ের তাক দিয়ে ভরে দিতে। আহা, যদি কখনো নিজের বাড়ি হয়, সেখানে নিশ্চয়ই চার্লস ডিকেন্স-এর বাড়ির মত গোপন দরজা রাখব, যা ঢাকা থাকবে বইয়ের আলমারি দিয়ে। গোপন দরজার ওপাশে থাকবে আমার লেখার জায়গা। ছাদের ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোর রেখা, আমি আর ভাবনা- আহা, এ জীবন-ই আমি চাই!

ছোট বেলায় ভেবেছিলাম, বড় হয়ে দু’টো দোকান থাকবে আমার। একটা বইয়ের, আরেকটা মিষ্টির। কোনটাই হয়নি। তবে বইয়ের দোকানের ‘মামা’দের সাথে খাতির করেছি। বিশেষ করে ঢাকা শহরের পুরনো বইয়ের দোকানের মামাদের স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়। কত অমূল্য বইয়ের সন্ধান যে তাঁরা আমাকে দিয়েছিলেন! ‘মামা’দের জ্ঞানের বহরও আমাকে বিস্মিত করেছে। নীলখেতের একটি বইয়ের দোকানে অনেক পুরনো প্রিন্টের এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড কিনছিলাম, তখন মামা জানালেন, চীন দেশে নাকি এই বইটি নিষিদ্ধ ছিল। প্রাণীরা মানুষের মত কথা বলেছে, এতে নাকি মানুষকে অপমান করা হয়েছে, এই যুক্তি দেখিয়ে কোন্ চীনা রাজা নাকি বইটি নিষিদ্ধ করেছিল। কৌতূহলী আমি পরে খুঁজে দেখলাম, চীনা রাজা নয়, ১৯৩১ সালে চীনা জেনারেল হো চীন ছিলেন সেই নাটের গুরুখান।

পুরনো বইয়ের সন্ধানে নেপালের থামেলে ঘুরছিলাম। এক বৌদ্ধ ভিক্ষু (পরে জেনেছিলাম, তার নাম দর্জে গুরুং) ফিসফিস করে নেপালি ভাষায় কোন এক পুরনো বইয়ের খোঁজ দিতে চাচ্ছিলেন। নেপালি আমি বুঝতে পারি, বলতে একটু সমস্যা। ইংরেজিতে বললাম, ঐ বই আমার চাই-ই চাই। চমৎকার ইংরেজিতে ভিক্ষু দর্জে বলল, কাম উইথ মি। ভিক্ষুর পিছু পিছু হাঁটছি আর শুনছি এক আজব বইয়ের কথা। হাজার বছর আগে চীন থেকে তিব্বত হয়ে বইটা নাকি নেপালে এসেছে। মানুষকে অমর করে ফেলার মন্ত্র আছে এতে।
কাঠমান্ডু শহর ছাড়িয়ে এর পাশের পাটান শহরে আমাদের গন্তব্য। ট্যাক্সি থামিয়ে নেমে পড়ি, পাটান রাজদরবারের সীমানা ছাড়িয়ে নিচু একটা পথ ধরি।

যত কষ্টই হোক, আশ্চর্য সেই বইটি আমাকে দেখতেই হবে। অনেকখানি হাঁটার পর ঢুকলাম এক চার দিকে আটকানো বাড়িতে, সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, তিন-কি চারতলা পার হলাম মনে নেই, কেবল মনে আছে তানখা ড্রয়িং দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা করিডর পেরিয়ে কাঠের দরজায় ঠক্ঠক্ করছি। দরজাটা খুলে গেল, ভিক্ষু দর্জে গুরুং আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। বসতে দিলেন। পুরো ঘরটায় চীনা শিল্পের প্রাচীন সব নিদর্শন। দেয়ালের এক কুলঙ্গি থেকে নিয়ে ভিক্ষু বইসমেত বসলেন আমার সামনে। আমি ছোঁ মেরে নিতে চাই বইটা। আমার চোখ চকচক করছিল, বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে, মাথা ঘুরছে উত্তেজনায়, যেন আমি কোন গুপ্তধন আবিষ্কার করেছি এই মাত্র।
পশুর চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বইটা। ভেতরে কাগজের উপর চীনা অক্ষর, এ-ই কি অমরত্বের মন্ত্র?

ভিক্ষু দর্জে গুরুং ফিসফিস করে বলে, পৃথিবীর প্রথম মুভাবল টাইপ দিয়ে প্রিন্ট করা বই এটি। চীনা বিজ্ঞানী বি শেং এই টাইপ আবিষ্কার করেছিলেন ১০৪৫ সালে। এরও প্রায় ৪৫০ বছর পর গুটেনবার্গ এই টাইপ তৈরি করেছিলেন। গুটেনবার্গকে নিয়ে যতই মাতামাতি কর বাপু, আসল কৃতিত্ব কিন্তু বি শেং-এরই। আমি বইটি কিনতে চেয়েছিলাম। দর্জে গুরুং ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রেখে এর যা দাম বলল, তা দেওয়ার সাধ্য আমার কেন, আমার চৌদ্দগুষ্টির কারো নেই। দর্জের হাসি নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। বলে, তোমাকে দেখে ট্যুরিস্ট ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম, তোমার কাছে অনেক ডলার আছে। ভেবেছিলাম, তুমি এটা কিনতে পারবে।

আমি কোন মতে নিজেকে নিয়ে নিজে নিজে কেটে পড়ি। করিডরটা পার হতে হতে কানে এল দরজা বন্ধ হওয়ার জোর শব্দ। এই ঘটনাটা পরে বলেছিলাম আমার জাপানি কূটনৈতিক বন্ধু তাকা য়্যুকিচি-কে। তাকা জোর দিয়ে বলল, ভিক্ষুটা আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিল। বি শেং-এর টাইপ ব্যবহার করে মুদ্রিত বইয়ের কোন কপি কোথাও আছে বলে কারোর জানা নেই। আমি গোঁ ধরে বলছি, যা কারোর জানা নেই, তার বাইরেও তো কিছু থাকতে পারে। হয়তো সত্যিই আছে অনলি ওয়ান কপিখানা, ঐ দর্জি ব্যাটার কাছেই, জানাজানি হলে তো সাড়া পড়ে যাবে পৃথিবীতে।

তাকা পাল্টা প্রশ্ন করে, ও ব্যাটা তাহলে জানাচ্ছে না কেন? তোমার মত ব্যাকপ্যাক ট্যুরিস্টকে ডেকে ডেকে বলছে, ওয়ান্না বাই? কিনবে, কিনবে? ও কেন লন্ডন মিউজিয়ামের সাথে যোগাযোগ করছে না? তাহলে তো ওর মন মতো দামেই বেঁচে দিতে পারত। আমার তেঁতো মুখ দেখে তাকা ফোন করে নেপালে বেড়াতে এসে তাকার সাথে বন্ধু হয়ে যাওয়া চীনা লেখিকা শিন ইয়াং শাইনকে। শিন ইয়াং পর দিন আমার বাড়ি বয়ে এসে আমাকে নিশ্চিত করে গেল, বি শেং-এর বই নাম করে কিছু প্রতারক নাকি নেপাল আর তিব্বতে এভাবে পর্যটকদের ঠকিয়ে বেড়ায়।

আমি সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখনো এই এত দিন পরেও বইটার জন্য আমার মন কাঁদে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যেভাবে নেপালের রাজদরবারে চর্যাপদ খুঁজে পেয়েছিলেন, সেভাবে যদি আমার কিছু একটা ঘটত! চর্যাপদের কথা যখন এলই, তখন আরেক অভিজ্ঞতার কথা বলি। মহারাজা রামের স্ত্রী সীতা দেবীর জন্মস্থান নেপালের জনকপুরে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলাম মৈথেলি তরুন শ্যামসিংহের সাথে। চর্যাপদকে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলে মানতে চায় না শ্যামসিংহ। গোঁ ধরে বলে, ওটা নাকি মৈথেলি ভাষার সাহিত্যকর্ম। এখনকার মৈথেলির সাথে চর্যাপদের পদগুলোর ভাষার মিল এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে, সেখানে বাংলা অনেক পাল্টে গেছে, যদিও বাংলার সাথে মৈথেলি ভাষা, লেখ্যরূপের মিল আছে। তাই বলে আমার চর্যাপদ আমি ছেড়ে দেব? কিছুতেই না।

আমি তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকি। শারজাহ্-তে পুরনো বই খুঁজতে পেয়ে গেলাম আল মুতানাব্বি বুকশপকে। শারজাহ্-র ওল্ড মিনা রোডে অবস্থিত ওল্ড সেওয়া বিল্ডিং। এর নিচের তলায় সেই অসাধারণ বইয়ের দোকানটি। আরবি সাহিত্যের পুরনো সংগ্রহগুলো হাতে নিয়ে আমি গন্ধ টেনে নেই বুকের ভেতর। আরবি বলে এক অক্ষরও বুঝে উঠতে পারি না, কিন্তু পুরনো বইয়ের জন্য ভালবাসা নিয়ে আমি ঐ বইগুলোর কাছে যেতাম সুযোগ পেলেই।

বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু অট্টালিকা বুর্জ খলিফার টানে শেখ জায়েদ রোডের ডাউন টাউন দুবাইতে গিয়ে দেখলাম আরেক বিস্ময় দুবাই মলকে। পুরো দুই দিন ঘুরেও ঠিক মত দেখা হয় না, এত বড় এই শপিং সেন্টারটি। এখানেই খুঁজে পেলাম কিনোকুনাইয়া। বইয়ের দোকান বললে একে অপমান করা হবে, বলা উচিত বইয়ের দুনিয়া। আমি সকালে ঢুকি, রাতে বের হই। মাঝখানে একবার কিছু খেয়ে নিতে যা একটু সময় নষ্ট করতে হয়। দিরহামে রাখা বইয়ের দাম, আমি টাকায় গুণে দেখে ঢোঁক গিলি। কিনতে না পারলেও নেড়েচেড়ে গন্ধ নিতে, এক কোণায় বসে একটু একটু করে পুরোটাই পড়ে ফেলতে তো আর সমস্যা নেই। ফেরার সময় চক্ষুলজ্জায় বই কিনতে ব্যস্ত হই। দশ দিরহাম থেকে ত্রিশ দিরহামের বই কিনে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে আসি। বলে রাখি, ওদের এক দিরহাম আমাদের বিশ টাকার প্রায় সমান সমান।

বই নিয়ে হাঙ্গামা চূড়ান্ত হয় বই মেলার সময়। নেপালের এক লেখক সম্মেলনে গিয়ে বললাম, আমাদের দেশে তো এক মাস ধরে বই মেলা হয়। কয়েকজন লেখক চোখ কপালে তুলে মুখটা হা করে তাকিয়ে রইল। ওরা দিল্লির খবর খুব রাখে, কলকাতাও চোখে পড়ে না, বাংলাদেশের খবরও জানেই না। এই লেখকদের কেউ কেউ এখন ফেব্রুয়ারি আসার আগে বাংলাদেশের ভিসার জন্য আবেদন করেন। বইমেলায় ঘুরে বেড়ান, হাতে বাদামের প্যাকেট।

বেশ ক’বছর আগে কথা হ’ত- যে বই প্রকাশিত হচ্ছে, তা কি অনলাইনে কিনতে পাওয়া যাবে? ই-বুক করে ফেলা কি যায় আস্ত একটা বই? ই-বুক হলে পড়তেন নতুন যুগের নতুন পাঠকেরা। এখন এই প্রশ্নগুলো তামাদি হয়ে গেছে। ই-বুক এখন খুব সহজ বিষয়। বইমেলায় ই-বুকের স্টল থাকে বেশ কয়েকটা। আমার বই ‘ভিনগ্রহের ক্র’ ই-বুকে পড়া যায় দেখে কী যে অবাক হয়েছিলাম! এখন এ কথা বললেও কেউ অবাক হবেন না, জানি। আমি বুঝতে পারি, কাঁঠাল গাছের পাশে শুয়ে বই হাতে করে সময় কাটানোর দিন ফুরিয়ে এল হয়তো।

পাথরের উপর লেখা বই হারিয়ে গেছে। চামড়ার বই, সে-ও নেই। হাতে লেখা বই কোথাও আর লেখে না কেউ। ছাপার অক্ষরেরও তো কত বিবর্তন হয়েছে। এখন ই-বুক। বই পড়ব কি, বই এখন নিজেই নিজেকে পড়ে শোনাবে। স্মার্ট ফোনে এ্যাপস ডাউনলোড করে নিলেই ই-বুকের বিশাল ভান্ডার আঙ্গুলের খোঁচায় হাজির হবে। আনন্দের সাথেই বলি, এ দেশের সবচেয়ে পুরনো সচিত্র কিশোর মাসিক পত্রিকা ‘নবারুণ’-এর সংখ্যাগুলো এখন বিশ্বব্যাপী মেবাইল অ্যাপসের সাহায্যে স্মার্টফোনে পড়ে ফেলা যাচ্ছে। নবারুণ প্রকাশ হ’ল কি হ’ল না, কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে ভাবে না ডিজিটাল বাংলাদেশের শিশুকিশোররা। মুহূর্তের ভেতর পড়ে ফেলছে প্রিয় লেখাটি।

একুশে বইমেলার হলদে বিকেলগুলো নিবিড় মমতায় জড়িয়ে ধরে কাগজের বইয়ের আদর দিয়ে, আর তাই কাগজের বই টিকে থাকুক ভাবি খুব। কেননা, একুশে বইমেলায় যত বই ছাপা হয়, তা হিসেব করলে গিনিজ বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। একুশে বইমেলা আর কাগজের বই আছে বলেই আমার প্রবাসী বন্ধু এশরার লতিফের লেখা গল্পসংকলন ‘স্ফটিকবাড়ি ও অন্যান্য গল্প ’, তামান্না ইসলামের লেখা উপন্যাস ‘একাকী’ পড়তে পারি। কাগজের বইয়ের ভালবাসা এমনি গাঢ়। এরপরও বলতে হয়, কাগজের বইয়ের আধুনিক ই-রূপটিও খুব দরকারী। কেন? বলছি।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশ আর্মির মেজর, আমার বন্ধু মামুনের সাথে কথা হ’ল। ওর পোস্টিং এখন কঙ্গোতে। মানুষখেকো মানুষ কি আছে কঙ্গোতে, জানতে চেয়েছিলাম মামুনের কাছে। ও বলল, শান্তিরক্ষী বাহিনীর ক্যাম্পের দেড় মাইলের মধ্যে মানুষখেকোদের গ্রাম। কিছু দিন আগে এক অফিসারকে নাকি একা পেয়ে ধরে নিয়ে গেছে। তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মামুনের জন্য মায়া হচ্ছিল। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মামুন জানাল, ওর নাকি দিন ভালই কাটছে। পড়ুয়া মামুন গাদা গাদা বই তো নিয়ে যেতে পারেনি, আইপ্যাডটাই ছিল ভরসা। আইপ্যাডে ছুঁয়ে দিয়ে ই-বুক পড়ে এবং পড়ে শোনায়। কাকে পড়ে শোনায়? লুয়েম্বা নামের এক মানুষখেকো কিশোর ওদের ফুটফরমাস খাটে, তাকে পড়ে শোনায়।

মামুন বলছিল, লুয়েম্বাকে বই পড়ে পড়ে আবার বুঝিয়ে দিতে হয়। মামুন ওর ভাষাটা ভালই রপ্ত করে ফেলেছে। এভাবে লুয়েম্বা পড়ে ফেলেছে প্রিয় লেখক জাফর ইকবালের রাতুলের রাত রাতুলের দিন। পড়েছে রাজুর আদর্শলিপি, মজার মজার ছড়া, বিজ্ঞানের সহজ কথা নামের কয়েকটা বই।

লুয়েম্বার চোখে মামুন আলোর নাচন দেখেছে। লুয়েম্বা পাল্টে যাচ্ছে। মামুন যখন বলছিল, আমিও তখন টের পাচ্ছিলাম লুয়েম্বা নামের না দেখা ছেলেটির চোখের আলোর রং কেমন হতে পারে। এক হলদে বিকেলে এই রকম আলোর নাচন আমি আমার দাদীর চোখেও দেখেছিলাম। লুয়েম্বা পাল্টে যাচ্ছে।

বই এভাবেই পাল্টে দিয়েছিল মানুষকে। এখনো দিচ্ছে। ভবিষ্যতেও দেবে। তা সে যে ফর্মেই থাকুক না কেন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/পিআর

লুয়েম্বার চোখে মামুন আলোর নাচন দেখেছে। লুয়েম্বা পাল্টে যাচ্ছে। মামুন যখন বলছিল, আমিও তখন টের পাচ্ছিলাম লুয়েম্বা নামের না দেখা ছেলেটির চোখের আলোর রং কেমন হতে পারে। এক হলদে বিকেলে এই রকম আলোর নাচন আমি আমার দাদীর চোখেও দেখেছিলাম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।