জাতিসংঘের সিংহদুয়ারে কড়া নাড়ছে বাংলা
বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি, চেষ্টা, আয়োজন এবার বেশ জোরদার। এর পক্ষে যুক্তিও জোরালো। পারিপার্শ্বিকতাও অনুকূলে। আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হওয়ার দাবিদার বিভিন্ন আঙ্গিকেই। কতোগুলো পর্যায় ও বাঁক পেরিয়েই আজকের অবস্থানে এসেছে উদ্যোগটি। এ গতিতে এগুতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দাবি পূরণের আশাও করা যায়।
বাংলা বা অন্য যেকোনো ভাষা জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে সাধারণ পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হওয়া আবশ্যক। তার আগে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে কী পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন, তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও সম্মেলনবিষয়ক দপ্তরকে বাজেট প্রস্তাব আকারে সদস্যদের জানাতে হবে। এর প্রতিটি পদক্ষেপই কঠিন কাজ। উল্টোদিকে ৫২ থেকে ৯৯ এমন অনেক কঠিনকে জয় করেই এ পর্যন্ত এসেছে বাংলাভাষা। ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বে ব্যাপক আয়োজনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হওয়া বাংলা ভাষারই অবদান। পৃথিবীতে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতিসত্তা খুব কম। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য। আমাদের স্বাধীনতার একাত্তরও এসেছে বায়ান্নর সিঁড়ি বেয়েই। সেই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তথা ভৌগোলিক সীমারেখা অর্জনের পেছনেও ভাষার ব্যাপক অবদান। এটিও বিশ্বের আরেক ভিন্ন বাস্তবতা।
বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে বিশ্বের ৫০ কোটির মতো মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘে সরকারি ভাষা ছয়টি: আরবি, চীনা মান্দারিন, ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ও রুশ। সাধারণ পরিষদের মূল ভাষণ যে ভাষাতেই হোক, প্রতিটি সরকারি ভাষায় তার তাত্ক্ষণিক অনুবাদ করার নিয়ম ও ব্যবস্থা রয়েছে। একাধিক ভাষায় দক্ষ ও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত দোভাষীরা সে ভাষণ শুনে মুখে ভাষান্তর করে দেন। এক সঙ্গে ছয়টি ভাষায় শোনা যায় সে ভাষণ ।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বাংলায় ভাষণ দেওয়ার পর অনেকেই সেখানে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পায় ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এক সপ্তাহ পর ২৫ সেপ্টেম্বর এ বিশ্বসভার সাধারণ পরিষদের ৩০তম অধিবেশনে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। সেটাই প্রথম বিশ্ব সংস্থার কোনো আনুষ্ঠানিক সভায় বাংলা ভাষার ব্যবহার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে প্রতিবারই বক্তব্য রেখেছেন মাতৃভাষা বাংলায়। ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান প্রস্তাব হিসেবে সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে। ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বাংলাকে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আহ্বান জানান।
২১ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থন করে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। প্রস্তাবটিকে জাতিসংঘে উপস্থাপন করতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধও করেছে। ২০১০ সালের ১১ জুন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিধানসভা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবারও বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানান। এ ছাড়াও ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাভাষীদের এই দাবিকে সমর্থন করে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্রিটিশ সংসদ সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেছেন এবং ব্রিটিশ সরকারকে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের উদ্যোগ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন। এসব কার্যক্রম অবশ্যই আশা জাগানিয়া। কাঙ্খিত সূর্য্যের আভার মতো।
ভারতে রাজ্যগুলো প্রয়োজনে হিন্দির পাশাপাশি নিজস্ব এক বা একাধিক দাপ্তরিক ভাষা গ্রহণ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বাংলাকে সেই মর্যাদা দিয়েছে। এছাড়া বাংলা আসাম এবং আন্দামান-নিকোবর রাজ্যের সহ-দাফতরিক ভাষা। ঝাড়খণ্ড রাজ্য ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাকে দ্বিতীয় দাফতরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়া উড়িষ্যা রাজ্যেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচিতে রয়েছে কমবেশি ২০ লাখ বাঙালি। সে কারণে করাচি সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম স্বীকৃত দ্বিতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা।
যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে স্থানীয়দের কাছে বেশ আকর্ষণীয়ও ভাষাটি। পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৫ বছর ধরে বেশ নামডাকে চলছে বাংলা বিভাগ। সেখানে বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করে বের হচ্ছে পাকিস্তানিরা। সম্প্রতি পাকিস্তানের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মডার্ন ল্যাংগুয়েজ বাংলা ভাষায় ‘ফাংশনাল কোর্স’ চালু করেছে। বিভাগটিতে বাংলা সাহিত্যের ওপর প্রায় দুই হাজার গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে সিয়েরালিয়ন। এর প্রতীকী মূল্য ব্যাপক। মধ্যপ্রাচ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সিয়েরালিয়নের পাশাপাশি আফ্রিকার অন্যান্য দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা যেভাবে দৃঢ় হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে বিশ্বের আরো কোনো দেশে বাংলা স্বীকৃত দাপ্তরিক কিংবা অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত হতেও পারে।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে দরকার লেগে থাকা। দুয়ারের কড়ায় অব্যাহত নাড়ায় অতিথিকে বরণের নিয়মেও তা সাধ্য-সিদ্ধ হতে পারে। নানা প্রেক্ষিত ও পারিপার্শ্বিকতায় জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে যোগ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই মোক্ষম সময়। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষাগুলোর মধ্যে বিশ্বে ফরাসি কিংবা রুশ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা বাংলাভাষীর সংখ্যার চেয়ে বেশি নয়। আরবিভাষীর সংখ্যাও বাংলাভাষীর চেয়ে বেশি হবার নয়। অথচ এসব ভাষা জাতিসংঘে জায়গা করে নিয়েছে। তাদের এ অবস্থানের ভিত্তি মোটেই বাংলার চেয়ে ততো সমৃদ্ধ নয়। ব্যবধান অন্যখানে। নিজেদের ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার রাজনীতি-কূটনীতিতে তারা ঢের এগিয়ে। সেইসঙ্গে প্রচার-প্রচারণায়ও তুঙ্গে। যাবতীয় উপাদান ও রসদ থাকার পরও আমরা সেখানে পিছিয়ে। বাংলার রূপ-সৌন্দর্য্য বিস্তারে আমাদের রকমারি বা রংমাখা প্রচারণা জরুরি নয়। দরকার শুধু সত্যের প্রচার। গর্বের ইতিহাস উপস্থাপন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর