সহিংস রাজনীতির অনুশীলন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। গত বৃহস্পতিবার এই রায় দেওয়া হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অন্য আসামিরা হলেন তার পুত্র তারেক রহমান, সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জিয়াউর রহমানের বোনের ছেলে মমিনুর রহমান।

মামলায় শুরু থেকে পলাতক আছেন তারেক রহমান, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান। গত ২৫ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার বিশেষ জজ-৫ আদালতের বিচারক আকতারুজ্জামান রায়ের জন্য দিন ঠিক করেন।

বিদেশ থেকে পাঠানো এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্য বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক এই মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন দুদকের উপপরিচালক হারুন অর রশীদ।

ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আদালত খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)ধারায় অভিযোগ গঠন করেন।

একটি সাধারণ দুর্নীতি মামলা। দেশে এরকম অসংখ্য মামলার নিষ্পত্তি হয় প্রতিদিন। কিন্তু এই একটি মামলাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে টান টান উত্তেজনার সময় অতিক্রম করছে দেশ। কারণ যার বিরুদ্ধে এই মামলা তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এখন তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন, রায়ের স্থগিতাদেশ চাইবেন। এগুলো সবই স্বাভাবিক আইনী প্রক্রিয়া।

এই রায়ের ফলে তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কিনা তার নিশ্চয়তা পেতে সময় লাগবে আরও কিছুটা। কিন্তু রাজনীতি যে নতুন করে সহিংসতার পথে এগুলো, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ বিএনপি আগে থেকেই বলে আসছে সাজা হলে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। আর তাদের শক্ত আন্দোলন যে রাষ্ট্রের সম্পদ ও এর মানুষের বিরুদ্ধ সহিংসতা, তার প্রমাণ পাওযা গেছে ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকেই।

একটি মামলার রায় হবে, রায়ের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চলবে। কিন্তু আগে থেকেই যখন বলা হয়, সাজা হলে রায় মানা হবেনা তখন সেই রাজনীতির সাংস্কৃতিক মনন নিয়ে আলোচনা করতে হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে কোন কিছুর নিষ্পত্তি বা সমাধান হয় না সহিংসতা ছাড়া। এটাই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিংসাদীর্ণ এক সমাজ তৈরি করেছে রাজনীতি, যে রাজনীতি শক্তি সঞ্চয় করেছে বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫-এ সপরিবারে হত্যার পর থেকে। এই রাজনীতির বড় আদর্শ সমাজের সর্বত্র উদারতার প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে মৌলবাদ কায়েম করা।

বোঝাই যাচ্ছে নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই বাড়বে রাজনৈতিক সহিংসতা। আমাদের সহিংসতা নির্ভর রাজনীতি এমনই বিস্তৃত, এমনই আত্মঘাতী যে, এই রাজনীতির ধারকরা এটি নিয়ে গেছে দেশের বাইরেও। বেগম জিয়ার রায় ঘোষণার দিন, ৮ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে হামলা করেছে বিএনপি, ভাংচুর করছে, দূতাবাস কর্মীদের বেধড়ক পিটিয়েছে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছবি পদদলিত করেছে। সভ্য দুনিয়ার মানুষকে কিছুটা হলেও সহিংসতার রূপ দেখাতে তারা সক্ষম হয়েছে।

কেন আমরা বারবার রাজনৈতিক সহিংসতার প্রশ্নে আমরা সবসময় সামনের কাতারে? কারণ হলো রাজনৈতিক উন্মত্ততা বা ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। হিংসার এই সংস্কৃতি এসেছে পাকিস্তানি মনন থেকে। ১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান দুটি আলাদা ভূখন্ড হয়। আমাদের দুভোর্গ শুরু হয় শুরু থেকেই। কারণ আমরা পড়েছিলাম পাকিস্তান নামের এক বিপজ্জনক ও অসাংস্কৃতিক রাষ্ট্রের অংশ। এরা সহিংস বলেই আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, সাধারণ প্রতিবাদকে সহিংস পথে ঠেকাতে চেয়েছে। তারা নাগরিকের সাধারণ রাজনৈতিক অধিকারকে আমলে নিতে চায়নি কখনো, সবসময় চেষ্টা করেছে সহিংস পথে মানুষকে দমন করতে। উর্দি আর অস্ত্রের সাথে আরেক হাতিয়ার ছিল ধর্মের অপব্যবহার। বাঙালি রক্ত দিয়ে সেই অধিকার আদায় করেছে, দেশ স্বাধীন করেছে আর পিতা হিসেবে সামনের থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কিন্তু পাকিস্তানি সংস্কৃতির এতটাই ব্যাপক প্রভাব আমাদের সমাজ জীবনে যে, আমরা স্বাধীনতার মূল জায়গায় সাড়ে তিন বছরও থাকতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হলো সেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে। সেই থেকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদী শক্তি সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার করে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে এসেছে একুশে আগস্টের মতো ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা, জনগণকে পুড়িয়ে মারার মতো পেট্রল বোমার আন্দোলন।

এই রাজনীতির পরিচালকরা চায় অন্ধকারের শক্তির ক্ষমতা। তাদের এই ক্ষুদ্রায়ণই আমাদের দেশকে বারবার সহিংসতার পথে ঠেলে দিচ্ছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশে আজ সংঘাত ও হিংসা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায় এমনসব হিংসার জন্মদাতা সেই গোষ্ঠী। পাকিস্তানে যেমন শুধু আজ হিংসার বিস্তার, তাদের সমর্থিত গোষ্ঠী সেই হিংসাকেই রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছে।

বাংলাদেশের সামনে কঠিন পরীক্ষা। দলমত নির্বিশেষে সকলে কী পারবে এই সাম্প্রদায়িক সহিংস গোষ্ঠীর দিক থেকে প্রসারিত হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে? আইন তার নিজস্ব পথে চলুক।

লেখক : বার্তা প্রধান, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

‘বোঝাই যাচ্ছে নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই বাড়বে রাজনৈতিক সহিংসতা। আমাদের সহিংসতা নির্ভর রাজনীতি এমনই বিস্তৃত, এমনই আত্মঘাতী যে, এই রাজনীতির ধারকরা এটি নিয়ে গেছে দেশের বাইরেও।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।