শিক্ষা সমস্যার অশিক্ষিত সমাধান
শিক্ষা সংক্রান্ত খবরে ভরপুর গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম। প্রেসক্লাব এলাকায় একের পর এক শিক্ষক সংগঠন আসছে, জাতীয়করণের দাবিতে অনশন করছে, শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা গ্রেফতার হয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগে, তাদের আকাশছোঁয়া দুর্নীতির খবর এখন রসালো আলোচনা। তবে সবাইকে পেছনে ফেলেছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ‘উচিত শিক্ষা’ কর্মসূচি।
ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বহিষ্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধে প্রায় চার ঘণ্টা আটকে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই তাকে উদ্ধার করেছে ছাত্রীসহ আন্দোলনকারীদের রক্ত ঝরিয়ে। তাদের ভাষায়- যারা অশান্তি করছিল, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগ একটি নতুন ‘আমরা-ওরা’-র দর্শন এনেছে শিক্ষাঙ্গনে। ‘আমরা’ হলো তারা, আর ‘ওরা’ হল বাকি সবাই। একসময় ছাত্রদল বা শিবির ছিল ‘ওরা’। এখন সবাই। তারা সবাইকে মারবে, তারা নিজেরাও মারপিট করবে, শিক্ষকের গায়ে হাত তুলবে, আবার দলীয় শিক্ষককে মারপিট করে উদ্ধারে যা করার দরকার করবে।
উপাচার্য ও প্রক্টরকে অবরুদ্ধ করতে গিয়ে একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, কিছু ছেলেমেয়ে কলাপসিবল গেট ভেঙেছে। উপাচার্য এটিকে একটি আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে পারতেন।
শিক্ষাঙ্গনে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হলে তার মোকাবিলায় পুলিশ আসবে, এটাই সদাসর্বদা আমরা আমাদের ছাত্রজীবনে দেখে এসেছি। কিন্তু বর্তমান ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হয়তো পুলিশে আস্থা রাখতে পারেননি। তাই তাকে উদ্ধারে এলো ছাত্রলীগ। প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট হলে ভাল কথার দাওয়াইও কাজে আসেনা। পেটানোই দর্শন হয়ে উঠে তখন।
কিন্তু গভীর প্রশ্নটা সেখানে নয়। উপাচার্য বা প্রক্টর প্রশাসক হলেও শিক্ষক। তারা ছাত্রলীগ করা একজন ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষক, তেমনি অন্য দলকরা শিক্ষার্থীরও শিক্ষক। কিন্তু রাজনীতির ছোবলে এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে যে, এসব ক্যাম্পাস প্রশাসক কেবলই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন করা শিক্ষার্থীদের শিক্ষক। সেই বিএনপি আমলে তৎকালীন উপাচার্য আনওয়ারুল্লাহ চৌধুরী যে নজির রেখে গেছেন, তা আরও প্রস্ফুটিত হয়েছে। কেন এমন হল, এন রীতিমত তা গবেষণার বিষয়।
অনেকেই বলছেন একতরফাভাবে ছাত্রলীগকে দোষারোপ করা হচ্ছে। অন্য সংগঠনেরও দোষ আছে। আছে বৈ কি। কিন্তু নিক্তি দিয়ে মাপা দরকার কার কতটুকু। আরও বেশি প্রয়োজন কে কোন দাবিতে মাঠে নেমেছে। কোন কোন সমস্যার চটজলদি সমাধান হয় না। যেমন সাতটি কলেজকে ঘিরে এই আন্দোলন। উপাচার্য আক্তারুজ্জামানের জন্য এটি এমন এক সমস্যা। এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঢাকার সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা থেকে। এই সাত কলেজকে কেন অধিভুক্ত করা হলো, হলেও তা কেন ঠিকমতো ব্যবস্থার আওতায় আনা গেলো না, সে এক লম্বা বিতর্ক। আমরা দেখেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের কোন্দলে এই সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীদের জীবন আজ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। পরীক্ষার রুটিন চাইতে গিয়ে পুলিশের টিয়ার শেলে চোখ হারিয়েছে কলেজ ছাত্র সিদ্দিকুর। আর গত ২৩ জানুয়ারি ঘটে গেলো সেই নজিরবিহীন ঘটনা।
ছাত্রলীগ রাজনীতি করে। ক্ষমতার রাজনীতি করে। ফলে ক্ষমতার কণ্ঠ যত থাকে, যুক্তি তত কম থাকে। কিন্তু উপাচার্য, প্রক্টর, ডিন বা বাকি শিক্ষকরা? তাদের কোন দায়িত্ব ছিলনা একটি সুষ্ঠু সমাধানের পথে এগুনো? তারাইতো সমাধানের একটি আলোড়ন তৈরি করতে পারতেন, দ্রুত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে পারতেন। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সেতুবন্ধনের মাধ্যমেই ক্যাম্পাসকে হিংসামুক্ত করা যেত। হিংসাত্মক পরিস্থিতির জন্য রাজনীতিই দায়ী। অথচ, উপাচার্য সেই রাজনৈতিক সাহায্যই চাইলেন।
আমাদের শিক্ষকরা জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। জ্ঞানচর্চা ও স্বার্থবহ সমাজচেতনার কথা তারা বলেন। আমরা সে সব শুনি। অথচ তারা শিক্ষার সমস্যা শিক্ষিত মানসিকতায় করলেন না। শিক্ষকরা এক ভিন্ন বাস্তবতার জন্ম দিতেই পারতেন। আসলে সমস্যা এখানেই যে এরা রাজনৈতিক শিক্ষক। শিক্ষাঙ্গনের স্বার্থ অপেক্ষা বাইরের রাজনৈতিক গোষ্ঠি জীবনের প্রতি আনুগত্যকেই এরা অধিকতর গুরুত্ব দেন। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। সরকার দলীয় শিক্ষক প্যানেলেও অনৈক্য। তারা অহেতুক কোলাহলে মত্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা অন্য জায়গা ছড়াবে। উপাচার্য প্রশাসন চালান। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ আচরণ করতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করে নিয়েই এগিয়ে যেতে পারেন তিনি। এটুকু করতে অর্থ বা সময় কোনওটারই অপচয় হবে না। আর এই কাজের প্রধান অন্তরায় যে রাজনীতি- তাকে সংযত করতে পদক্ষেপ নেওয়া বিশেষ জরুরি। শিক্ষায়তনে সুস্থ পরিবেশ প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বড় নয়। সব কিছুই করে প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকমণ্ডলী। ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা বাদ সব কিছু থেকে। আর এমনভাবে আমাদের ক্যাম্পাসগুলোতে তারা বড় হচ্ছে গণতন্ত্রহীন এক পরিবেশে। শিক্ষকরাও যদি ‘আমরা-ওরা’র রাজনীতি করেন, তবে পরিত্রাণ কোথায়?
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস