একটা কিছু ক গোলাপী, একটা কিছু ক

তানজীনা ইয়াসমিন
তানজীনা ইয়াসমিন তানজীনা ইয়াসমিন , কলামিস্ট, গবেষক
প্রকাশিত: ১০:১৫ এএম, ২২ জানুয়ারি ২০১৮

-শুধুমাত্র তুমি যদি আত্মহ্ত্যা করো তাহলেই জীবন বীমা কোম্পানি তোমার বাড়ির লোন শোধ করবে না। এবং তাও যদি আত্মহত্যা করো এক বছরের ভেতর। থ খেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তার দিকে তাকালাম। বুঝতে সময় নিচ্ছিলাম আমার দুর্বল জাপানি ভাষাজ্ঞান কোন গন্ডগোল পাঁকিয়ে দিলো কিনা। আমার ভূতে পাওয়া চেহারা দেখে ব্যাংক কর্মকর্তা আরো ধীর লয়ে, অধিকন্তু বিনয়ে গলে গলে পুনরাবৃত্তি করলেন।

-তোমার বাড়ির লোন কখনোই তোমার মৃত্যুতে বা অবর্তমানে তোমার স্বামী, সন্তান, অভিভাবক বা নিকটাত্মীয়দের ওপর বর্তাবেনা। লোনের ইন্টারেস্টের এক অংশ জীবনবীমা কোম্পানি মাসে মাসে কেটে নেবে। এই লোন শোধের আগে তোমার যেদিনই মৃত্যু হয়, তারপর থেকে বাকিটা তারাই এই শোধ করবে। শুধু, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে, লোন নেবার পর ১ বছর সময় দিতে হবে।

এবারে মুখ খুললাম।

-যদি ১ বছর পর আত্মহত্যা করি? পাশ থেকে রিয়েল এস্টেটের বয়স্ক এজেন্ট পিঠ চাপড়ে বুঝ দিলেন।
-ওটাও জীবনবীমা কোম্পানিই শোধ দেবে! তাই আর যাই করো, ১ বছরের ভেতর আত্মহত্যা করো না প্লিজ, ঠিক আছে? ব্যাংকের কাগজপত্রের পাহাড় ডিঙ্গাচ্ছি, আর মাথার ওপর উড়ছে বিক্ষিপ্ত ভাবনার আকাশ। একটা দেশের মানুষের মনস্তত্ব কতটা বেশি এর আইন কানুন রীতি নীতিকে প্রভাবিত করে ব্যাংকের এই আত্মহত্যা নিয়মনীতি শুনেও আংশিক উত্তর পেলাম। সবার আগে বিবেচ্য “আত্মহত্যা”। এদের কাছে আত্মহত্যা প্রবণতার মত অসুস্থতা কি এতোটা স্বাভাবিক বিষয়! ভাবতে ভাবতে আরো একবার স্তম্ভিত হলাম।

খোঁজ নিয়ে ওয়েবে জানলাম, জাপানি আইনের হিসেবেই যদি মৃত্যু বাড়িতে ঘটে তো সাধারণ জীবনবীমাতেও মৃতের আত্মীয়রা কোন অর্থ পাননা। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাড়িতে প্রাণনাশ হলেই কি তাতে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি থাকে? এর নেপথ্যের কারণ কি? অপরাধ, অপঘাতের হার অতি নগণ্য যেই দেশে সেই দেশে বাড়িতে খুনের রেকর্ড একেবারেই নাই। এর কারণ অন্যখানে। বাড়িতে কেউ অস্বাভাবিকভাবে মারা গেলেও পুলিশ খুব উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে হত্যার রিপোর্ট করে না। ধরেই নেয়া হয় আত্মহত্যা করেছে। নিখুঁত আইন ব্যবস্থার ভেতরেও অতি নিখুঁতভাবে ঢুকে গেছে আত্মহত্যার সর্বোচ্চ ছাড়!

আমার আগের এক লেখাতেও উল্লেখ করেছিলাম, আত্মহত্যায় অন্যতম শীর্ষস্থান জাপানে আত্মহত্যা খুব স্বাভাবিক বিষয়। বিগত তিন বছরের এর হার অনেক কমে এলেও বছরে ৩০,০০০ লোক আত্মহত্যা করে। দিনে গড়ে ৭০ জন। এর মধ্যে সর্বাধিক ২০-৪৪ বছরের পুরুষ। প্রধানতম এক সামাজিক সমস্যা। বিভিন্ন বড় কর্পোরেট হাউজে সাইকোলজিকাল ট্রেনিং দেয়া হয় আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতন করতে। কর্মীদের এতে আগ্রহ নাই। চাকরির নিয়ম রক্ষার্থে করতে হয়। এবং সেই ট্রেনিং শুরু হয় এভাবে, “আত্মহত্যা আপনার ব্যাক্তিগত বিষয় বা অধিকার। কিন্তু আমাদের ট্রেনিং আপনার আত্মহত্যাকে বাধা দেবে না। কোথায় কম খরচে কিভাবে আত্মহত্যা করা যায় তারই কিছু টিপস দেবে।” -এমন ভূমিকা আত্মহত্যাপ্রবণদের কাছে খুব লোভনীয়। গোটা রুম তার দিকে ঘুরে যায়, চোখ বড় বড় করে শুনতে হয়।

ফুজি পাহাড়ের পাদদেশে “আওকিগাহারা” বনে ২০১০সনেই ৫০ জন আত্মহত্যা করেছে, যা বিশ্বের ২য় জনপ্রিয় সুইসাইড স্কোয়ার ( ১ নম্বরে আছে সানফ্রানসিসকোর গোল্ডেন গেইট ব্রিজ)। আগ্নেয়গিরির দেশ জাপান। আগ্নেয়গিরিও ঘিরে রাখা হয় আত্মহ্ত্যাপ্রেমীদের উপদ্রপে। আর এসবের কারণও সেই ইতিহাস আর জিন । যুদ্ধে পরাজয় বা ভুল ত্রুটির জন্য “ হারাকিরি” ( হারা = পেট, কিরি = কাটা ) প্রথা। আর “কামিকাজে” যোদ্ধা ( আত্মঘাতী যুদ্ধবিমান চালক) তো গোটা বিশ্বের কাছেই আলোচিত।

এক ইউনিভার্সিটির ল্যাব থেকে কয়েক গ্রাম আর্সেনিক হারিয়ে গেছে। এতো বিষ যদি কেউ খেয়ে আত্মহত্যা করে? কি করে এমন গাফিলতি হলো ভেবে প্রফেসর আত্মহত্যা করে বসলেন। বাবার সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি, ভাত ঠেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে “সায়োনারা” বলে বিল্ডিং এর নিচে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়ে। মুহূর্তেই ঝাঁপ দেয়া মেয়েটির বাবা ঘর থেকে দৌড়ে বারান্দায় এসে এই দৃশ্য দেখে নিজেও দিলেন ঝাঁপ! আমাদের এক বাঙালি বন্ধু বাস করতেন মুখোমুখি বিল্ডিংএ । বেচারা মাসখানেক আগে টাটকা টাটকা জাপানে এসে রাতের খাবার শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছিলেন। এহেন আয়েশী মুহূর্তে এমন ভয়ানক দৃশ্যর মুখোমুখি।

এই সেদিন নজরে এলো, ঢাকায় তানজীম আফ্রিদা মাহি নামের মাত্র ২০ বছরের এক অসাধারণ শিল্পী, সামনে মাসে স্কলারশীপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে যাবে, কলাভবনে সম্ভবত ৮ থেকে ২৭ শে জানুয়ারি অবধি তার অসাধারণ চিত্রকলার প্রদর্শনী চলছে। একজন উদীয়মান শিল্পীর সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা সুতীব্র অর্জনের এক মুহূর্ত। অথচ, অথচ মেয়েটি কি এক অভিমানে গলায় শাল জড়িয়ে ফাঁস নিয়ে ঝুলে গেল ফ্যানে! ইংরেজি মাধ্যমে এ- লেবেল পরীক্ষায় সারা বিশ্বে “আর্ট” বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া, সদ্য তারুণ্যে পা দিয়েই এককচিত্র প্রদর্শনীর মত এত বড় অর্জন, স্কলারশীপ নিয়ে উন্নত বিশ্বে পড়তে যাওয়ার অপেক্ষা, বন্ধুপ্রতিম মায়ের কবিতা, বাবার মায়া- কোন কিছুই তার চোখে এই পৃথিবীটাকে সুন্দর করে দিতে পারেনি।

কত অপচয়! দেশের শত অনিয়মের অসহ্য যুদ্ধ নিয়েও হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করা হাহাকার নিয়ে ভাবতে বসি। আর সেখানে জাপান উন্নত এক দেশ! ছবির মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুশৃঙ্খলিত এক দেশ, জীবনে কোন অনিশ্চয়তা নাই। তবুও, কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়! জীবনানন্দের কবিতার লাইন মনে পড়ে,
“যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হল তার সাধ।
বধূ শুয়ে ছিল পাশে- শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,
-তবে সে দেখিল কোন ভূত? …”

আর এই ভূতে পাওয়াটাই জাপানিদের কালের পর কাল বংশগতির ধারায় বয়ে বেড়ানো মনস্তত্ব। নাহলে স্বাভাবিক নিয়মে জীবন এখানে শতায়ু হয়েও ফুরাতে চায় না। ইতি টানতে চাচ্ছি আমাদের দেশের কোন আইনটি এমন বিশেষ মনস্তত্ব বা আচারে উদ্ভুত প্রশ্নটি ছুঁড়ে। এলোমেলো মন নিয়েই বিশ্বের আজব যত আইন খুঁজে চোখ বুলাচ্ছিলাম। জানলাম, পরীক্ষা হলে নকল করতে গিয়ে ধরা পড়া আইনত দণ্ডনীয়। ধরা পড়ে গেলে ১৫ বছর বয়সেও জেল খাটার আইন আছে। বিশ্বে শুধুমাত্র আমাদের দেশেই আছে এই আইন। আমরা যে এমন ইউনিক এবং জাত নকলবাজ- এই ধারণাই ছিল না! জানিনা এহেন মনস্তত্বর সরলীকরণেই প্রশ্নফাঁস প্রাথমিক থেকে চাকরির পরীক্ষা, সর্বক্ষেত্রেই প্রচলন কিনা।

কোমল শিশুগুলির জেলে যাওয়া কি বরদাশত করা যায়? তার চেয়ে পড়ালেখাই উঠে যাক, প্রশ্নপত্র -উত্তরপত্র সব হাতে নিয়েই হলে গিয়ে লিখে আসুক। কারণ, “ ফেল করার কোন মানেই হয় না! ” - মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সর্বজনীন বহুকিছুই। কিন্তু অনেক বেশি কিছুই দেশ ভেদে পাল্টে যায়, তার নিজ্স্ব সংস্কৃতি মূল্যবোধ মানসিকতার কাস্টমাইজেশনে। যুগের পর যুগ তবুও জাপান এসব জীবনবীমা আইন, সেল্স ট্রেইনিং ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মহত্যার হার কমানোর চেষ্টা করছে।

আমরা সেখানে নকলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে উৎসাহিত করছি, সর্বপর্যায়ে মাফিয়ার মতন ব্যবসা গড়ে উঠেছে। মাথায় রোগ না সারিয়ে মাথাই কেটে যাই। আজীবন আমরা কে কার চেয়ে খারাপতর হবো সেই প্রতিযোগিতায় আছি। কোন নিয়ম বা পদ্ধতি কেন প্রবর্তিত হচ্ছে আবার কেনই বা তা দুদিন পর ব্যর্থতায় মুখ থুবড়ে পড়ে অন্য আরেক স্বপ্নেপ্রাপ্ত দাওয়াই দেয়া হচ্ছে কোন দায়বদ্ধতা নাই! ''কুন ফায়াকুন'' - ''হও এবং হয়ে যায়''! আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্রে দৃশ্যের মত চিৎকার করতে ইচ্ছা হয়-
“একটা কিছু ক গোলাপী, একটা কিছু ক ! ”

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।

[email protected]

এইচআর/জেআইএম

‘সেই ট্রেনিং শুরু হয় এভাবে, “আত্মহত্যা আপনার ব্যাক্তিগত বিষয় বা অধিকার। কিন্তু আমাদের ট্রেনিং আপনার আত্মহত্যাকে বাধা দেবে না। কোথায় কম খরচে কিভাবে আত্মহত্যা করা যায় তারই কিছু টিপস দেবে।” -এমন ভূমিকা আত্মহত্যাপ্রবণদের কাছে খুব লোভনীয়। গোটা রুম তার দিকে ঘুরে যায়, চোখ বড় বড় করে শুনতে হয়। ’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।