পুলিশ সমাজের সাধারণ মানুষেরই অংশ
গত সপ্তাহে পুলিশ সপ্তাহের শুরুতেই দুটি খবর গণমাধ্যমে ঝড় তুলেছে। রাজধানীতে এক ডিআইজি’র নারী ক্যালেংকারি এবং খুলনার বটিয়াঘাটায় বোনকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় তারেক মাহমুদ নামে এক যুবককে মারধর করার অভিযোগ এসেছে ১২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। উভয়ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা বলতে প্রত্যাহার করে নেয়ার খবরই জানা গেল।
আইন লঙ্ঘন যে দুষ্কর্ম, তা নতুন কোনও তথ্য নয়। কিন্তু আইনের লোক আইনি পথে না চললে খবরতো বটেই। দুটি ঘটনা দিয়ে সমগ্র বাহিনীকে বিচার করা যাবেনা, দোষ দেওয়াও যাবেনা। কিন্তু দুটি ঘটনারই প্রতীকী তাৎপর্য আছে। পুলিশ সদস্যরা এ সমাজেরই সমাজেরই সন্তান। আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা একটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হলে এই বাহিনীর উপরও তার প্রভাব পড়বে, এতে বিস্ময়ের কারণ নেই। কিন্তু উদ্বেগের কারণ নিশ্চয়ই আছে।
অভিযোগ প্রমাণসাপেক্ষ, কিন্তু যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, এমন কোনও অসদাচরণের কাণ্ড ঘটেনি, তাহলেও কেন অভিযোগ উঠে বা উঠেছে? সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ প্রশাসনকে এ নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে নাগরিক সমাজকেও।
একজন নাগরিকের কাছে বিপদের সময় সবচেয়ে বড় আশ্রয় পুলিশ। কিন্তু সেই পুলিশই যদি এমন আচরণ করে যে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, বিশেষ করে নারী সমাজ, তাহলে বলতেই হবে এই শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কোন সদস্য ঠিক পথে নেই। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পুলিশের সাম্প্রতিক ভূমিকা যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি কিছু কিছু সদস্যের কর্মকাণ্ড এ বাহিনীর ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করছে। নানা ধরনের নজির গড়েই চলেছে আমাদের পুলিশ। সাংবাদিক পেটানো, সাধারণ নাগরিককে হয়রানি করার বহু নজির রচিত হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলবেন, বড় কর্তারা বলবেন এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু কিছু ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবতে পারা যায় না। পুলিশের উপর শাসকের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব কতখানি নিরঙ্কুশ হয়ে উঠেছে সেই আলোচনা নাগরিক সমাজে উঠছে। শৃঙ্খলা বাহিনীর যেকোন নেতিবাচক আচরণ গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। এ দেশে মসনদের হাতবদল হয় ঠিকই, কিন্তু আজও পুলিশ-প্রশাসনের মেরুদণ্ডে সেই শাসক ভজনারই তাড়না।
মানুষ পুলিশের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে, ক্ষমতার প্রদর্শন নয়। পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলো। সে সময় অনেকগুলো সুপারিশও রাখা হয়েছিলো। ইউএনডিপি’র পুলিশ সংস্কার প্রকল্প থেকেও অনেক সুপারিশ এসেছিল। সেগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে জানা নেই। এই সরকারের আমলে পুলিশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাহিনীর প্রধানের মর্যাদা বেড়েছে, সুযোগ সুবিধা, পদোন্নতি সবই হয়েছে। কিন্তু মানুষের কাছে সেই উপনিবেশ আমল থেকে চলে আসা থানা যে এক আতংকের নাম, তা বদলালোনা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
দুর্নীতির পাশাপাশি, এ সব থানা সম্পর্কে ব্যাপক মানুষের ধারণা এমন- এখানে অবৈধভাবে নিরীহ মানুষকে আটকে রাখা হয়, হাজতে মৃত্যু ঘটে, আটক ব্যক্তির কাছ থেকে নির্যাতন করে টাকা আদায় করা হয় ইত্যাদি। সেই ঔপনিবেশ আমলে পুলিশ বাহিনী গঠন হয়েছিলো মানুষকে মোকাবেলা করতে, জনগণের বন্ধু হওয়ার জন্য নয়। স্বাধীনতার পর থেকে কত কত কমিশন হলো, কমিটি হলো। কিন্তু কোনোভাবেই এ ‘থানা সংস্কৃতি’ থেকে আমরা আর বের হতে পারিনি। থানা নিয়ে মানুষের আতংক আছে। এই থানাই আবার মানুষের দোরগোড়ায় সাধারণকে রাষ্ট্রের পক্ষে ন্যায়বিচার দেওয়ার প্রথম প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মানুষ কেন তা মনে করে না? প্রথমত উন্নত বিশ্বে পুলিশ স্টেশন মানে সেবাকেন্দ্র। আমাদের দেশে তা রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রদর্শনের প্রধান কেন্দ্র। আর এভাবেই পুলিশ বাহিনী হয়ে উঠেছে, জনগণ থেকে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক বাহিনী। কিন্তু এভাবে একটি বাহিনী যুগের পর যুগ মানুষ থেকে দূরে থাকতে পারে না। মানুষের হয়ে উঠতে এই বাহিনীর একটি বড় অন্তরায় হলো রাজনৈতিকভাবে তাদের ব্যবহার।
মানুষ পুলিশ থেকে চায় সেবা আর নিরাপত্তা। পুলিশের কাজ মানুষকে সেবা দেওয়া, তাদের সহযোগিতা করা, সাধারণ মানুষের নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। মানবাধিকারের যে সাধারণ ধারণা আছে, পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া তা কখনোই অর্জিত হবে না। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সমাজে পুলিশের ভূমিকা উন্নয়নমূলক, যদিও আমরা তা করতে পারিনি কোনোদিন। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা, আধুনিকায়ন আর ভাবমূর্তির উপর দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে। এ কথা আমাদের রাজনীতিকরাও স্বীকার করেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজে পুলিশ কোনো ব্যক্তি বিশেষের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে পারে না। তার দায়বদ্ধতা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে। কিন্তু বাস্তবতা আমরা জানি। জনবহুল দেশে, মানুষের নিরাপত্তা বিধানের কাজটি খুব সহজ নয়। বিশেষ করে সমাজে যখন অপরাধপ্রবণতা বেশি থাকে। কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা তো আছেই, এ বাহিনীর অনেক সদস্যকেই কাজ করতে হয়, অন্য অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে।
লোকবলের সংকটে তাদের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত খাটতে হয়, সে তুলনায় বেতন-ভাতা কম, নেই প্রয়োজনীয় উপকরণ, আধুনিক সব ব্যবস্থা। কিন্তু এরপরও একটি বড় সংকটের জায়গা সাধারণভাবে মানুষের প্রতি পুলিশের আচরণ। আসলে এ বাহিনীকে দেখতে হবে, একটি বিশেষ পেশাদার বাহিনী হিসেবে, যারা সদা সজাগ মানুষের নিরাপত্তা বিধানে, মানুষের সমস্যায় প্রথম নির্ভরতার জায়গা হিসেবে। কিন্তু সত্য হলো এই যে, থানা আর পুলিশ মানেই সমাজের প্রভাবশালী মহলের আজ্ঞাবহ একটি বাহিনী। এ প্রভাবশালীদের কারণেই যুগের পর যুগ এ থানা সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আর এ প্রভাবশালীরাই (মূলত রাজনৈতিক) চায় না এ পরিবর্তন। কারণ এ অবস্থা বদলে গেলে, স্বজনপ্রীতি করা যাবে না, প্রতিপক্ষকে পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করা যাবে না, এলাকা দখলে রাখা যাবে না।
পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক করতে হবে। কিন্তু একইসাথে মানুষের সাথে তার যোগাযোগ বাড়ানো পদক্ষেপ নিতে হবে। সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া, এমন একটি জনবহুল দেশে পুলিশের পক্ষে আগামী দিনগুলোয় কাজ করা খুব সহজ হবে না। পুলিশবাহিনীর সদস্যদের ভাবতে হবে, তারা সমাজের সাধারণ মানুষেরই অংশ। প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়ে সাধারণকে শক্তি দেখানোতে কোনো বীরত্ব নেই। রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতীক না হয়ে পুলিশ হোক সামাজিক সেবা দিতে সক্ষম সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক বাহিনী।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস