পারবে আওয়ামী লীগ?
২০১৮ নির্বাচনের বছর। বেশ কিছু সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর বছরের শেষ দিকে হতে পারে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে বলতেই হচ্ছে এটি নির্বাচনের বছর।
বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগ রংপুরে ভোটে হেরেছে, হেরেছে কুমিল্লায়ও। বহু পরিশ্রম করেও এবং সংগঠনের জোরেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ মোট প্রদত্ত ভোটের প্রায় অর্ধেকই পেয়েছিল। এখন কি দলের সেই পরিস্থিতি আছে? নানা আলোচনায় এই প্রশ্ন উঠছে।
২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শাসক দলের নেতাদের মধ্যে হয়তোবা এক ধরনের ঝিমুনি এসেছে যে আবারও সেরকম কিছু একটাই হবে। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া সেই অর্থে কোন সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। আছে থানা, পুলিশ ও প্রশাসন কেন্দ্রিক প্রভাব বিস্তারকারী কর্মকাণ্ড আর নিজেদের ভেতরকার কলহ ও দ্বন্দ্ব। এই অবস্থায় নেতা-কর্মীদের ঝাঁকুনি দেওয়ার সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে।
প্রথমত, ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন যে, দলের নেতা-কর্মীরা সামাজিক বা বাণিজ্যিক সংগঠন করছেন না। করছেন একটি রাজনৈতিক দল, যার কাজ ভোটে জেতা। অথচ, কেমন করে সেই কাজটা হবে, তা বলতে পারছেনা কোন স্তরের কেউ। সবাই তাকিয়ে আছেন শেখ হাসিনার দিকে যেন তিনিই সব করে দেবেন। পরিশ্রম করে, লড়াই করে জিততে হয় সেকথাই ভুলে গেছেন বেশিরভাগ এমপি ও নেতা।
এটি স্পষ্ট যে টানা ১০ বছরের শাসন দলের অন্দরে বড় আরাম ও আলস্যের জন্ম দিয়েছে। ফলে আসছে জাতীয় নির্বাচনে যে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে দলকে সেকথা তারা ভাবছেন না হয়তো। ২০০৮ কিংবা ২০১৪-এ যে সহজ বিজয় এসেছিল তা বারবার আসবে এমন বিভ্রান্তিতে ভোগলে বিপদ আছে।
একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মৌলবাদের মোকাবেলা। যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে নতুন করে আবার ১৯৭১-এর মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি। জামায়াত একা শুধু নয়, আরও আরও অসংখ্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি এখন মসজিদ, মাদ্রাসা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে খেলছে। এর সাথে দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর অর্ন্তকলহ, সংঘাত আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ায় বড় ভাবমূর্তি সংকটের সামনে তারা। অথচ একথা শত্রুও স্বীকার করবে যে, স্মরণকালে সবচেয়ে বেশি উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে এই সময়টায়। গুটি কয়েক লোকের দুর্বৃত্তায়নে বছরজুড়ে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, দু’একজন মন্ত্রীর ব্যবস্থাপনা দুর্বলতায় চালের দাম সহনীয় হয়নি, পেঁয়াজের দাম আকাশ ছুঁয়েছে এবং শিক্ষাখাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এই অবস্থায় সুর নরম করে আবার জনতার কাছে দলকে যেতে হবে। কিন্তু বেশি যেটি প্রয়োজন তাহলো কেন্দ্রীয় কিংবা প্রান্তিক যে স্তরেই হোকনা কেন, দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে তৃণমূল ও কর্মীদের পক্ষ থেকে বড় বড় অভিযোগ আছে তা শুনতে হবে। যেন তাদের অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা না হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জনসভার দিন যশোরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার সংসদ সদস্য কাজি নাবিলের গ্রুপকে হেনস্তা করেছে। এমন অভিযোগ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা দলের সভাপতির বিরুদ্ধেও। অনৈক্যকে জোরালো করে রাখার এন্তার অভিযোগ আনেক নেতার বিরুদ্ধে।
সস্তা অহঙ্কার এবং অবান্তর জেদ দিয়ে দল চলেনা, জনতার নেতা হওয়া যায় না। এই অনমনীয় অহমিকা আলোচনার সংস্কৃতির মূলে বিষসিঞ্চন করে, গণতন্ত্রের কাঠামোর উপর অহেতুক কুঠারাঘাত করে। নানা জেলায়, জনপদে সেই কুঠার প্রবল হতে প্রবলতর হচ্ছে। জেলায় জেলায়, থানায় থানায় এমন অজস্র নেতা আছে যারা নানা পন্থায় দলের মধ্যে তেতো সম্পর্কে জিইয়ে রাখছে।
দলের ভেতর ভিন্ন মত থাকবে। আবার ভিন্ন দৃষ্টির মধ্যেও যাতে বিবিধ পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সর্বমান্য সিদ্ধান্তে আসতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হয়। সেই পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ ডাহা ফেল। হুংকার ছাড়া সাধারণ সম্পাদেকর কোন উদ্যোগ বা উদ্যোমও চোখে পড়ছেনা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা যেন বলে দেয় এই দলে ‘কলহ স্বর্গ, কলহই ধর্ম’। এমন ভয়ানক ধুন্ধুমার লড়াই কলহপ্রিয় বাংলাদেশেও বিরল। প্রান্তিক পর্যায়ে গৃহবিবাদ প্রায় স্থায়ী রূপ নিয়েছে। ফলে বিরোধী পক্ষকে এসে প্রার্থী হারাতে হবেনা, দলের কলহই বিরোধী শিবিরের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিবে।
দলের চালকরা সুষ্ঠু ভাবে কার্য সম্পাদনের লক্ষ্যটি মাথায় রেখে, নির্বাচনের বাস্তবতা বুঝে দলের ভেতরে আলোচনার পরিধি ও রীতি নির্ধারণ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। যে কোনও ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ আলোচনার একটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত মানসিক সহিষ্ণুতা।
দলের ভেতরে পক্ষ আছে, প্রতিপক্ষ আছে। অপর পক্ষের কথা শুনব না, মানব না, ছাড়ব না- এভাবে আলোচনা হয় না, দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা হয় না। আলোচনার একটি আবশ্যিক পদ্ধতি হলো সামনাসামনি বসে অপর পক্ষকে সম্মান দেখিয়ে তার যথাযোগ্য স্থান দিয়ে সমস্যার সমাধান সন্ধান। সেটা কি পারবে আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগ টানা নয় বছর ক্ষমতায়। এক বছর পর নির্বাচন। কিন্তু দলের নানা পর্যায়ে তীব্র জেদাজেদি ও সংঘর্ষ বলে দেয়, এই দলের নেতাদের অনেকেরই মানসজগত এখনও শাসক দলের রীতিপদ্ধতিগুলোর যোগ্য হয় নি, রাস্তায় সংগ্রামরত বিরোধী দলেই মনোজগতেই আটকে আছে।
লেখক : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস