দিন বদলের হৃদয়ে পরিবর্তন আসুক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৪:০৫ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

নতুন বছরের প্রত্যাশা কী? এমন একটা প্রশ্ন নাগরিক জীবনে প্রায় সবারই শুনতে হয়। আমাকেও শুনতে হচ্ছে। কোন উত্তরই আসলে খুঁজে পাচ্ছিলামনা। তবে আমার কাজটা সহজ করে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ২৫ ডিসেম্বর, বড় দিনের আগে আগে, বছরের শেষ ভাগে এসে রীতিমত বোমা ফাটালেন তিনি।

শিক্ষাভবনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) সম্মেলনকক্ষে অধিদফতরের কর্মচারীদের মধ্যে ল্যাপটপ ও প্রশিক্ষণ সনদ বিতরণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) কর্মকর্তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে ঘুষের বিনিময়ে তারা ওই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ভালো প্রতিবেদন দেন। স্কুল পরিদর্শনে গেলে খাম রেডি করাই থাকে। তবে আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা ঘুষ খান, কিন্তু সহনীয় হয়ে খান। কেননা, আমার এটা বলার সাহসই নেই যে, ঘুষ খাবেন না। তা অর্থহীন হবে।’

অনেক আলোচনা হচ্ছে এ নিয়ে, ট্রল হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একথার মাধ্যমে একজন মন্ত্রীর অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। শিক্ষা বিভাগের সমস্যা অনেক। তবে সবচেয়ে বেশি হলো দুর্নীতি। শিক্ষা বিভাগে যে ঘুষ উৎসব চলে সেই কুকীর্তিটা ঢাক পিটিয়ে এবার সকলকে জানিয়ে দিলেন মন্ত্রী। অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করছে, কিন্তু আমি তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি কোন রাখঢাক না রেখে বলে ফেলার জন্য।

আমাদের আয়বৃদ্ধির হার, সারা বিশ্বে আজ আলোচিত। কিন্তু দুর্নীতি মাপার প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতে দেশটি চরম দুর্নীতিগ্রস্তও। দুর্নীতি হচ্ছে এটা যতটা না আশংকার, বেশি ভাবনার হলো এই দুর্নীতির গ্রহণযোগ্যতা। যে যত বেশি দুর্নীতিবাজ, তার যেন তত কদর। ফলে একটা উৎসব লেগেছে সরকারি দপ্তর, পরিদপ্তরে ঘুষ খাওয়ার। তার ছোঁয়া লাগছে ব্যক্তিখাতেও।

দেশে উন্নয়ন যে হচ্ছে তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু দুর্নীতিকে কি তার হাত ধরে এগোতেই হবে? দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থান যেন হ্যাঁ সূচক উত্তরই দিচ্ছে। সব রকমের দুর্নীতি থেকে মুক্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলা মানুষের আজ আর কোন সম্মান নেই। হয়তোবা বাস্তবতা এই যে, যেনতেন প্রকারে অতিমাত্রায় রোজগার না করতে পারলে নিজের পরিবারের মানুষজনই হয়তো তাকে সন্মান করেনা।

মন্ত্রী যখন সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খেতে বলেন তখন বোঝা যায় দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থান আসলে ভেঙ্গেই গেছে। আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূল্যবোধ তৈরির ব্যাপারে আমাদের সামাজিক অনীহা চোখে পড়ার মতো। প্রতিনিয়ত মাত্রাতিরিক্ত বৈভবের প্রদর্শনীকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন চেষ্টা কোথাও নেই। এবং দুর্নীতির বড় কারণ এই পাওয়ার প্রতিযোগিতা।

যে মানুষটি সচিব ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, যার সন্তানেরা বিদেশে ঝা চকচকে জীবন যাপন করছে, তিনিও ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে দুর্বৃত্তায়নে জড়িয়ে পড়েন। সমাজ যাদের পূজনীয় ভাবে তারা কতটা লোভী, আদর্শহীন এবং নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী হতে পারেন, তার দৃষ্টান্ত যখন এ পর্যায়ের মানুষজন রাখেন, তখন দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়েই আশংকায় থাকতে হয়। আমাদের উন্নয়নের যে স্পৃহা বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে, তা ম্লান হয়ে যায় এমনসব দৃষ্টান্তে।

আর এই সংস্কৃতিই বিস্তার ঘটাচ্ছে বৈষম্যের। নিজেদের আশপাশ থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, অফিসের সহকর্মীর সঙ্গে নিরন্তর প্রতিযোগিতা। কে কত ঝকমকে জীবনে পা দিবে। এ থেকেই উপরি আয়ের উপায় খোঁজা শুরু। পথটা সহজ হয় দুর্নীতির রাস্তায় গেলে। রাতারাতি বাড়ি, গাড়ি, সন্তানের বিদেশে লেখাপড়ার ব্যবস্থা। একটা সময় ছিল ঘুষখোর বা দুর্নীতিবাজরা মুখ লুকিয়ে চলত, এখন তারাই সমাজকে দাবড়ে বেড়ায়। তাদের ভোগ বিলাসের প্রদর্শনীতে প্রতিনিয়ত উত্ত্যক্ত হয়ে সাধারণ একজনও ভাবতে থাকে একটা দুর্নীতির পথ খুঁজে পাওয়ার।

বৈষম্যের সঙ্গে দুর্নীতি আর ভোগবাদিতার এই সম্পর্কটা নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকেই বলে থাকেন উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে। উন্নয়নের জন্য কিছুটা বৈষম্য নাকি মেনে নিতেই হবে। আচ্ছা মেনে নিলাম। কিন্তু উন্নয়ন মানেই কি দুর্নীতি? উত্তর আশা করিনা। তবে উন্নয়ন আর দুর্নীতি হাতে হাত ধরে এগুলে উন্নয়ন হয় না, কেবল দুর্নীতিই চলতে থাকে।

রাস্তা দিচ্ছি, বিদ্যুৎ দিচ্ছি, পানির ব্যবস্থা করছি, চিকিৎসা সেবার প্রসার ঘটাচ্ছি, ইত্যাদি বলে বলে দুর্নীতির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াচ্ছি কিনা সেটা ভাবা দরকার। এটি একটি বড় নৈতিকতার প্রশ্ন। উন্নয়নের পথ ধরে যদি এমন দুর্নীতি চলে তবে তা সরাসরি দরিদ্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে। বিত্তশালীদের একটা বড় গোষ্ঠী এর সুবিধে নিঙড়ে নেয়। আর এতে করেই জনকল্যাণের নামে দুর্নীতি প্রশ্রয় পায় বা পাচ্ছে। তাই শেষ বিচারে এই দুর্নীতি উন্নয়নের পথেও বাধা।

আমরা যখন বলছি রাস্তাঘাট, অবকাঠামোসহ সামগ্রিক উন্নতি চোখে পড়ার মতো, তখন কি একবার চিন্তা করি কিনা যে ব্যাংক কেলেংকারি, প্রশ্নপত্র ফাঁস আর ব্যাপক দুর্নীতিও চোখে পড়ার মতোই। কিছু কিছু দুর্নীতির কথাতো রূপকথাসম। সমাজে দুর্নীতি চিরকাল ছিল। এখনো আছে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী যা বলেছেন সেটাই নতুন মাত্রা। বলেছেন তিনি শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি না করার পরামর্শ দিতে সাহস পাচ্ছেন না। অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের লজ্জাটাই আর নেই। বরং দুর্নীতি দেখে দেখে সমাজই এখন মুখ লুকায়। নতুন বছরের চাওয়া- সমাজ নয়, দুর্নীতিবাজরাই লজ্জিত হোক।

সভ্য সমাজের মূল লক্ষণ দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন প্রশাসন, ন্যায়পরায়ণতা, সমদর্শিতা, জাতিবর্ণবিদ্বেষহীনতা, নারীপুরুষের সাম্য, ধনীদরিদ্রের মধ্যে ভারসাম্য রচনা এবং দুর্নীতি থেকে মুক্তি। এগুলি সমাজের মান নির্ণয় করে। সততার সঙ্গে স্বীকার করা ভাল যে দুর্নীতি বেড়েছে। মানসিকতার সৎ প্রতিফলনই হৃদয় পরিবর্তনের সহায়ক।

লেখক : পরিচালক, বার্তা, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

‘মন্ত্রী যখন সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খেতে বলেন তখন বোঝা যায় দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থান আসলে ভেঙ্গেই গেছে। আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূল্যবোধ তৈরির ব্যাপারে আমাদের সামাজিক অনীহা চোখে পড়ার মতো।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।