কার হার, কার জিত?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৭:৪৭ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

রংপুরে যে দিন সিটি নির্বাচন ছিল, তার আগেরদিন থেকেই ফেসবুকের দেওয়ালে একের পর এক বার্তা ভেসে উঠছিল, টিভি চ্যানেলগুলোও ধারাবাহিকভাবে বলে চলছিল এবার জাতীয় পার্টির জয় হবে। কিন্তু এতবড় জয় হবে তা হয়তো স্বয়ং এরশাদও আঁচ করতে পারেননি। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর এমন চমকপ্রদ ফল অনেক রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে।

কুমিল্লার পর রংপুর দুটিতেই ভাল নির্বাচন করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যাকে নিয়ত আক্রমণ করে চলেছে বিএনপি। কাজেই, রংপুরের নির্বাচনের এমন চমৎকার আয়োজনের পর বিএনপিকে সিইসি ও কমিশন বিরোধী গল্পটিকে ভেঙে দেখতেই হবে। বর্তমান হুদা কমিশন একটা সুন্দর নির্বাচন করে ফেললো একটিমাত্র প্রতিশ্রুতির ওপর ভর করে- আর তাহলো কমিশন করে দেখাতে চায়।

সরকারও প্রতিশ্রুতি রেখেছে, কমিশনকে প্রশাসনিকভাবে সব সহযোগিতা দিয়েছে। আর রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ভূমিকা রেখেছে। তবে সবচয়ে বেশি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য নির্বাচক মন্ডলী, অর্থাৎ রংপুরের মানুষ, যারা একটা ভাল নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন।

নির্বাচনে যে প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ তার অনেকগুলির উত্তর এলো রংপুরে। রাজনৈতিক দল ও সরকার সহযোগিতা করলে যে ভাল নির্বাচন হয়, তার প্রমাণ আবার পাওয়া গেলো। কাজ না করলে, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে যে শাসক দলের প্রতীক নিয়েও জেতা যায় না তার প্রমাণ দিলেন শরফুদ্দিন ঝন্টু। আওয়ামী লীগও শিক্ষা পেলো যে, প্রার্থীতা বাছাইয়ে মনোযোগী না হলে, দলে ভাবমূর্তির সংকট থাকলে শুধু উন্নয়ন দিয়ে জনগণের রায় পাওয়া যায় না। আর বিএনপি’র জন্য বার্তা এই যে, জনগণ সরকারি দলকে পছন্দ করেনি, তবে বিএনপিকেও আলিঙ্গন করেনি। জাতীয় পার্টির ফলাফলের নিচে আর একটি তথ্য লুকিয়ে রয়েছে- এই আসন এখনও এরশাদের ঘাঁটি, রংপুরবাসী তাদের এরশাদকে ভোলেনি।

সিটি কর্পোরেশনগুলোতে আওয়ামী লীগের হার, দু’একটিতে অনুজ্জ্বল জয়- সব মিলিয়ে কি উন্নয়নের রাজনীতি আজ প্রশ্নের মুখে? সুশাসন আর দুর্নীতিহীনতাই মূল প্রশ্ন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আওয়ামী লীগ খুঁজবে? না এটুকুই সান্ত্বনা নেবে যে, তার সরকারের আমলে ভাল নির্বাচন হয় যেগুলোতে সে হেরে যায়?

বস্তুত, আওয়ামী লীগের ভোট দুই সিটি এলাকাতেই কমেছে। প্রার্থীর ভাবমূর্তি বড় বিষয় ছিল, কিন্তু দলের ভাবমূর্তিও বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক কালের ব্যাংক কেলেংকারি, চাল, পেঁয়াজ, সবজিসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গতি, গুম, খুনের সংবাদ যেভাবে এসেছে, যেভাবে ছাত্রলীগের আচরণ প্রায় সব জেলায় শাসক দলের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব জাগ্রত করছে, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। কাজেই, রংপুর নির্বাচনের ফলাফল এসব বিষয়ে দলের অস্বচ্ছ অবস্থানের ভূমিকা কতটা ছিল, সে বিষয়ে জল্পনার অবকাশ অবশ্যই থাকছে।

নিত্যদিন যে সমস্যাগুলোয় ভুগতে হয়, মানুষ তা ভুলে যায় না, নির্বাচনের সময় আরও বেশি করে মনে পড়ে তাদের। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু তা কতটা মানুষের হৃদয় ছুঁতে পারছে সে প্রশ্নও আজ উচ্চারিত। বিএনপি-আওয়ামী লীগের সনাতন রাজনৈতিক ছকে মানুষের আগ্রহ নেই। তারা নিজেদের চাকরির উন্নতি, জীবনযাত্রার মান নিয়ে ভাবিত। এবং, সেই কারণেই তারা অর্থনীতি নিয়ে ভাবে, দেশের প্রবৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয়ের চেয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে দুর্নীতির চাপে বেকায়দায় পড়েছে কি দেশ? তারা সরকারের দুর্নীতিহীন ভাবমূর্তি চায়।

রংপুর নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জয়ধ্বজা ওড়া সেই দলের পক্ষে, দলের নেতা এরশাদের পক্ষে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু জাতীয় রাজনীতি আপাতত একটি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে- ২০১৮ বা ২০১৯-এ যে জাতীয় নির্বাচন হবে তার সাথে এই ফলাফলের তাৎপর্য কী? সরকার উন্নয়নের পথে হাঁটছে, একথা তার শত্রুরাও স্বীকার করবে। কিন্তু এর সাথে সাথে মানুষের কাজের অধিকার থেকে শিক্ষার, খাদ্যের অধিকার, সবই মানুষের আলোচনায় চলে আসে।

প্রবৃদ্ধি আর মাথা পিছু আয়ের এত বড় অর্জনের পরও বণ্টন ব্যবস্থার সমস্যায় এখন বৈষম্য সাংঘাতিকভাবে প্রকাশিত। মানুষ মনেই করে যে, তাদের কিছু হয়নি। উন্নতি হয়েছে সরকারি কমকর্তা, কর্মচারীদের, শাসক দলের লোকজনের আর দুর্নীতিবাজদের। তাই এই ভোট যে আসলে জাতীয় পার্টির পক্ষে নয়, আওয়ামী লীগের বিপক্ষে, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে রংপুর ও কুমিল্লা। একটি গ্রহণযোগ্য তৃতীয় বিকল্প না পেয়ে জাতীয় পার্টিকেই ভোট দিল এই দফায়। মানুষের রায় কী হয়েছে, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশই নেই।

একটা আওয়ামী লীগ-বিরোধী হাওয়া নিঃসন্দেহে বইছে, কিন্তু সেটা কতটা বিএনপি-র পালে লাগবে তা দেখার পালা। বাংলাদেশের সামনে প্রশ্ন সে কোন পথে থাকবে, আনেক দোষ ত্রুটি আর সীমাবদ্ধ স্বত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, নাকি উগ্র সাম্প্রদায়িক জমানায় গিয়ে পড়বে? সময় অল্প, আওয়ামী লীগের জনসংযোগ বাড়ানো ও নিজেকের শোধরানোর সময় এখন। কোন একটি অন্ধকারের গোষ্ঠি যেন হঠাৎ কোন বিকল্প হয়ে উঠতে না পারে সেদিকে সজাগ থাকা।

লেখক : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

‘বাংলাদেশের সামনে প্রশ্ন সে কোন পথে থাকবে, আনেক দোষ ত্রুটি আর সীমাবদ্ধ স্বত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, নাকি উগ্র সাম্প্রদায়িক জমানায় গিয়ে পড়বে? সময় অল্প, আওয়ামী লীগের জনসংযোগ বাড়ানো ও নিজেকের শোধরানোর সময় এখন। কোন একটি অন্ধকারের গোষ্ঠি যেন হঠাৎ কোন বিকল্প হয়ে উঠতে না পারে সেদিকে সজাগ থাকা। ’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।