এই পরিকল্পিত অপপ্রচারের কারণ কী?

পলাশ আহসান
পলাশ আহসান পলাশ আহসান , লেখক, গণমাধ্যম কর্মী
প্রকাশিত: ০৪:৪০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর এক প্রবাসী সাংবাদিকের ফেসবুক স্ট্যটাস।“...টিভির ব্রেকিং সঠিক ছিল। চলে গেলেন আনিসুল হক (ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না এলাহি রাজিউন)। মঙ্গলবার মারা গেলেও পরিবারের পক্ষ থেকে আজকে স্বীকার। (কেউ পারলে সাংবাদিকতা শিখাতে আসেন: এত দিন ভুয়া আফডেট দিয়েছেন)” স্ট্যাটাসটি যিনি দিয়েছেন তার নাম এবং টেলিভিশনটির নাম বাদ দিয়ে, পুরোটাই তুলে দিলাম পাঠকদের জন্যে।

স্ট্যাটাস দাতা এবং ওই টেলিভিশনের সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাই নাম দু’টো উল্লেখ করলাম না। কিন্তু এই স্ট্যাটাসটির মধ্যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দীর্ঘ দিন ধরে যে অপপ্রচারের সংস্কৃতি চলছে, তার পরিস্কার একটি চিত্র পাওয়া যাচ্ছে । শুধু তাই নায়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, প্রচলিত গণমাধ্যমের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এটা সেই অপপ্রচারেরও একটা পরিষ্কার উদাহরণ। তাই আগামী দিনে আমাদের সতর্ক হওয়ার জন্যে এনিয়ে কথা বলার দরকার। আর সবচেয়ে বড় যে কথা, একটি অপপ্রচার কতটা অমানবিক, কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা অকৃতজ্ঞ হয় তা আলোচনার আলোয় আসা উচিত। এই দুই কারণেই মূলত এই লেখা।

আমি আসলে শুরু করতে চাই আনিসুল হক যখন গত আগস্টে লন্ডনে গেলেন সেই সময় থেকে। তিনি যাওয়ার মাস দেড়েক পর, তিনি যখন অসুস্থ হলেন, গুঞ্জন শুরু তখন থেকেই। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই সন্দেহের বীজ বপন, তারপর মানুষের মুখে মুখে ছড়ালো সেই সন্দেহ। হাটে মাঠে ঘাটে সেই আলোচনা। দু’একজন যে অপপ্রচারের বিপরীতে বলার চেষ্টা করেননি তা নয় । কিন্তু গুজববাজদের নেতিবাচক আলোচনার আগ্রহ, এতটাই প্রবল ছিল যে, সেখানে এসব পাল্টা কথা উড়ে গেছে রীতিমত।

সাংবাদিক হিসেবে আমার নিজেরও আগ্রহ ছিল কী হয়েছে আসলে আনিসুল হকের? আর যেখানে এমন গুজব, সেখানে একটু সতর্ক তো থাকতেই হয়েছে। আমার সঙ্গে আনিসুল হকের পরিবারের যোগাযোগ না থাকলেও, এমন কারো কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়েছে যারা আনিসুল হকের পারিবারিক বন্ধু। যারা নিয়মিত লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন।

শুরু থেকেই আমরা জানতে পারছিলাম তাঁর রোগটা কী? কী এই রোগের গতি প্রকৃতি….কিন্তু যেটা পারছিলাম না, সেটা হচ্ছে গুজববাজদের মুখ বন্ধ করতে।মুখতো বন্ধ হচ্ছিলই না বরং দিন দিন শাখা প্রশাখা বের হচ্ছিল গুজবের । অদ্ভুদ সব গল্প। একটু খেয়াল করে শুনলেই যে কারোরই বুঝতে পারার কথা, এসব গল্প কতটাই অবাস্তব। আমার ধারণা সেসব গল্প কমবেশি অনেকেই শুনেছেন।তাই আর বলছি না। তবে এটুকু বলা যায় সবগুলো গল্পের মূলভাব ছিল একই । আনিসুল হক অসুস্থ হননি। তিনি দ্রুত দেশে না ফেরার বাহানা তৈরি করেছেন।

anisul-haque

এই সচেতন পাঠকের কাছে প্রশ্ন, এখন এই গুজববাজরা কী বলবেন? এই প্রশ্ন হয়তো করতাম না। কিন্তু গুজববাজরা যদি হন, আমাদের চারপাশের কোন রাজনৈতিক দল বা পেশাজীবী প্রতিনিধি তাহলে এই প্রশ্নের জবাব চাইতেই হবে তাদের কাছে। একজন সৎ, সভ্য, যোগ্য মানুষ, জীবনের ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে এমন কেন খারাপ আচরণের শিকার হলেন? আমাদের কাছে সভ্য মানুষের কী কোন মূল্য আছে? এখন যদি এই বাজে আচরণের জন্যে, মুক্তিযুদ্ধ করা গোটা একটি জাতির বোধের স্তুর নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে, তাকে কী দোষ দেয়া যাবে?

কথা কথায় আশপাশ থেকেই বলতে শুনি, বাঙালি গুজবের জাতি। চিলের কান নেয়ার গল্পটি উঠে আসে বার বার। খুব গায়ে লাগে। কিন্তু কিছু করার থাকে না। কারণ আমার দেশেই তো লোকে চাঁদে সাঈদী দেখে, ফেসবুকে ধর্মীয় উস্কানি পেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে আগুন দেয়। যেহেতু এত সব উদাহরণ আছে, গুজববাজিকে জাতির দুর্বলতা হিসেবে মেনে নিতাম। কিন্তু যখনই সাংবাদিক হিসেবে চিন্তা করি, তখনই মনে হয় প্রতিটা গুজববাজিই উদ্দেশ্য মূলক। কারণ কোন জাগতিক লাভ না থাকলে একেবারে শুধু শুধু কষ্ট করে এমন গুজব কেউ কেন ছড়াবে ?

এই গুজব থামাতে আনিসুল হক সাহেবের স্ত্রী, পুত্র এবং কাছের মানুষেরা বার বার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে লিখেছেন। অনুরোধ জানিয়েছেন গুজব না ছড়ানোর। কিন্তু তাতে যে কেউ ন্যূনতম শ্রদ্ধা যে জানাননি, তা বোঝা গোলো তিনি দ্বিতীয় দফা অসুস্থ্য হওয়ার পর। মৃত্যুর অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে আসতে থাকলো মৃত্যুর খবর। অস্থির হয়ে গেলো একদল লোক। তাদেরই কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রভাব ফেলতে শুরু করলো প্রচলিত গণমাধ্যমে। সফলও হলো দু’একটি ক্ষেত্রে।

যদিও দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করেছে বলে আমি মনে করছি। হাওয়া থেকে পাওয়া খবরের সূত্রে কোন খবর দেননি।যারা বলছে, পরিবার মৃত্যুর খবর দেরিতে দিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, প্রতিটি মানুষ একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বজনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে, এতো খুবই পরিচিত দৃশ্য আমাদের কাছে।

ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের লাইভ সাপোর্ট থেকে বেঁচে ওঠার নজির তো আছে। হঠাৎ বেঁচে ওঠার আশা নিয়ে বছরের পর স্বজনকে পরম যত্নে কৃত্তিম শ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার নজির তো আমাদের দেশেই আছে। তাহলে আনিসুল হকের পরিবার কাজটি করতে চাইলে সমস্যা কোথায়? জীবনের চূড়ান্ত সংকটের সময় তাদের প্রতি সহানুভূতি না জানিয়ে,মৃত্যুর খবর দেয়ার জন্যে যারা চাপ দিয়েছেন, তাদের উন্মাদ ছাড়া কিছু বলতে পারছি না।

এই অপপ্রচার শুধু যে আনিসুল হকের ক্ষেত্রে তা নয়, বহু ক্ষেত্রে এই ঘটনার নজির আমরা আগেই পেয়েছি। বগুড়া, রামু, পাবনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সব শেষ রংপুর । প্রতিটি সহিংসতার ঘটনা একই রকম। শুরুতে একটা শান্ত এলাকা অশান্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে একদল উন্মত্ত খুব পরিকল্পিত ভাবে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মিথ্যা উত্তাপ ছড়ায়। তার পর তাণ্ডব করে পুরো এলাকায়। এরই মধ্যে প্রতিটি ঘটনার অপপ্রচারকারীদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কিন্তু আনিসুল হকের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত অপপ্রচারের দেখলাম ঠিকই, কিন্তু উদ্দেশ্য বিধেয় এখনো জানতে পারিনি।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের লাইভ সাপোর্ট থেকে বেঁচে ওঠার নজির তো আছে। হঠাৎ বেঁচে ওঠার আশা নিয়ে বছরের পর স্বজনকে পরম যত্নে কৃত্তিম শ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার নজির তো আমাদের দেশেই আছে। তাহলে আনিসুল হকের পরিবার কাজটি করতে চাইলে সমস্যা কোথায়? জীবনের চূড়ান্ত সংকটের সময় তাদের প্রতি সহানুভূতি না জানিয়ে,মৃত্যুর খবর দেয়ার জন্যে যারা চাপ দিয়েছেন, তাদের উন্মাদ ছাড়া কিছু বলতে পারছি না।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।