আনিসুল হকের মৃত্যু সব গুজবের অবসান ঘটালো

জব্বার হোসেন
জব্বার হোসেন জব্বার হোসেন , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৬:০৪ এএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭

কারো ভালো খবরের কৌতূহলী কখনোই অত ফোন পাইনি, গত কয়েকমাসে যত ফোন পেয়েছি আনিসুল হকের সম্ভাব্য মৃত্যু নিয়ে।
অনেকে বলেন, জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি চলে। আমি বলবো, পাশাপাশি নয়, চলে একই সঙ্গে। মানুষ জন্মেই তার মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে, সঙ্গী করে। এক সময় সঙ্গী চলে যায়, মৃত্যু থাকে। এই আছে, এই নেই- এটাই জীবন। জীবন এমনই।

এমনই যে জীবন সেই জীবনেও কত ঘটনা, কত স্মৃতি, কত স্বজন, কত পরিচিতজন। সবাই চায় তার কাছের মানুষটি, আপন মানুষটি থাকুক। থাকুক পাশে, আরো কিছুক্ষণ। জরা ব্যাধি জানার পরও মানুষ অপেক্ষা করে, প্রিয় মানুষটির ফিরে আসা বা ফিরবার জন্য।
আনিসুল হক ও তার পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা খ্যাতিমান হই, সেলিব্রেটি হই, জনপ্রিয় হই- জীবন তো আমাদের ভেতরে ভেতরে একই। অথচ আমরা সেটি অনেক সময় বুঝতে চাই না। ব্যক্তিকে, মানুষ হিসেবে ভাবতে চাইতে না। অবজেক্ট হিসেবে, বস্তু হিসেবে, সেলেবল, নন সেলেবল হিসেবেই কেবল দেখতে চাই বাণিজ্যিক কারণে।

তাই যদি না হয়, তবে আনিসুল হকের অসুস্থতার খবরে, সম্ভাব্য মৃত্যুর খবরে কেন এত প্রতিযোগিতায় নেমে ছিলাম আমরা? মৃত্যুর আগেই তার মৃত্যুর খরব প্রচার করছিলাম? আমরা কি একবারও তার পরিবারের কথা, রুবানা হকের কথা, নাভিদের কথা, উমায়রার কথা, তানিশার কথা ভেবেছি? ভেবেছি তার পরিবারের মানুষজন কতটা মনোকষ্ট, মনোপীড়নে দিনযাপন করছিলেন?
একটা দিব্যি সুস্থ, স্বাভাবিক, ছুটেচলা, দৌড়ে বেড়ানো মানুষ লন্ডনের ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে নিরব, নিশ্চল। এই না মাত্র দেখলাম সরব, এখনই মানুষটি নিরব ভাবা যায় কতটা কষ্টের, কতটা বেদনার, কতটা হুহু কান্নার আর আর্তনাদের এই পরিস্থিতি?

এ শহরের অনেকেই জানেন আমার বড় ভাই আব্দুন নূর তুষার। চিকিৎসক, বিতার্কিক, মিডিয়াব্যক্তিত্ব। নাগরিক টিভির সিইও। আনিসুল হকের পরম স্নেহধন্য। মনে পড়ে যতদূর, খুব কম বয়স থেকেই আমার ভাই, আনিসুল হককে ভালোবাসেন, শুদ্ধা করেন। আনিসুল হকেরও তার প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস, আস্থা প্রবল। প্রগাঢ় ভালোবাসা, সম্পর্ক তাদের দীর্ঘদিনের। আমার ভাই নিজেকে সবসময় আনিসুল হকের পরিবারেরই একজন মনে করেন। আনিসুল হকও তাই মনে করতেন। নির্বাচনের সময়টা তুষার, আনিসুল হকের সঙ্গেই থেকেছেন। প্রতিদিন যেতেন, মধ্যরাতে বাড়ি ফিরতেন। আনিসুল হক মেয়র হলেন। বড় ভাই মেয়র হলেন। তার যে কী আনন্দ!

লন্ডনে চিকিৎসাধীন থাকাকালে আনিসুল হকের পরিবারের পক্ষ থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সম্মানিত মেয়রের চিকিৎসাকালীন খোঁজ খবর, ডা. আব্দুন নূর তুষারই গণমাধ্যমে দিবেন। মনে আছে, মাস কয়েক আগে হঠাৎ আমার ভাই লন্ডন থেকে টেলিফোনে ভীষণ উত্তেজিত। তাকে জীবনে কখনও অত বাজেভাবে রাগতে দেখিনি আমি। কোনো একটি নিউজ পোর্টাল আনিসুল হকের অসুস্থতা নিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছে। পরিবার সংশ্লিষ্ট, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কারো সঙ্গে কথা না বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিষয়টি অন্যায়। আমি কথাবলি পোর্টালের সম্পাদকের সঙ্গে, তিনি বলেন, কখনও কখনও হিট বাড়ানোর জন্য এমন করতে হয়। আরে ভাই, আমি খারাপ লিখলেই তো আনিসুল হক এ মুহূর্তে মারা যাচ্ছেন না, তাই না? তাহলে সমস্যা কী?

অবাক হই আমি। সংবাদিকতার যে নৈতিকতা আছে, ‘এথিকস অব জার্নালিজম’ বলে একটি টার্ম রয়েছে তার ধারে কাছেও নেই তিনি। এমন অবাক আর বিস্মিত আমাকে কেবল সেবার নয়, আরও অনেকবার হতে হয়েছে। প্রিন্ট ও নিউজ পোর্টালের অনেকেই আনিসুল হকের পরিবার, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কারো সঙ্গে কথা না বলে বারবার ভিত্তিহীন, মনগড়া খবর ছাপতেই থাকেন। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, হিট বাড়ানো। কাটতি। সার্কুলেশন। বাণিজ্য।

যেহেতু আনিসুল হক মানুষের ভালোবাসার মানুষ। মানুষ তার খবর পেলেই, পড়বেন। মানুষের এই ভালোবাসা আর আবেগকে পুঁজি করে এক শ্রেণির গণমাধ্যম যে যার মতো খবর প্রচার করতে থাকে, নেহাত বাণিজ্যিক স্বার্থে। ইউটিউবে ভিডিওক্লিপ দিতে থাকে টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে। আনিসুল হক পরলোকগমন করেন ৩০ নভেম্বর, বাংলাদেশ সময় রাত ১০.২৩ মিনিটে। অনেক নিউজ পোর্টাল আরও আগেই তার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করেছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন তার মৃত্যুও একদিন আগেই স্ক্রল প্রচার করতে থাকে, তার মৃত্যু সংবাদের। ন্যূনতম নৈতিকতা, মানবিকতা বলেও কী আমাদের কিছু আছে? মৃত্যু নিয়ে, মৃত্যু সংবাদ নিয়েও আমাদের অসুস্থ বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা।

anisul

যে সমাজে আমরা বাস করছি তা অসুস্থতা, বিকৃতিতে ঠাসা। পুঁজি আর বাণিজ্য এখানে ইশ্বর। অন্যের চরিত্রহনন, কাল্পনিক গল্প, গুজবে আমরা সিদ্ধহস্ত, ব্যবসায়িক কারণে। মানুষের চেয়ে, জীবনের চেয়ে, বাণিজ্য এখানে বড়। টাকা বড়। আনিসুল হকের অসুস্থতা নিয়ে তাই গুজব ছড়িয়ে দিতেও আমাদের বাধেনি রুচিতে। সরকারবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন আনিসুল হক। তিনি অসুস্থ নন, তিনি লন্ডনে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করছেন, এমন ইতর, অসভ্য গুজবও রটিয়েছে একটি গোষ্ঠী বা পক্ষ। এই গুজবের পেছনেও বাণিজ্যিক স্বার্থই সক্রিয়। কোথায় একজন অসুস্থ, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মানুষকে প্রার্থনায় রাখবো, তার সুস্থতায়, তা নয়; উল্টো অসুস্থ আচরণ করছি নিজেরাই।

আনিসুল হকের লন্ডনে চিকিৎসাকালীন সময়ে ফেসবুকে নিয়মিত স্ট্যাটাস নোট দিয়েছেন আমার ভাই আব্দুন নূর তুষার। সেটি দিতেন তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই। যাতে কোন বিভ্রান্তি না ছড়ায়, কেউ সুযোগ নিতে না পারে অন্যায়ের। অথচ অনেকেই বলেছেন, তুষারের এসব স্ট্যাটাস মিথ্যে। সাজানো, বানানো। কখনও কখনও মৃত্যু অনেক কিছুর উত্তর দিয়ে যায়। প্রমাণ করে যায়। আনিসুল হক প্রমাণ করলেন, বামনদের মধ্যে তিনি ছিলেন অতিকায়। মহৎ, মহান, আলোকিতজন। যার মৃত্যুই বলে দেয়, তিনি কত বড় মানুষ ছিলেন। সবসময় হেসেছেন তিনি। এখন কাঁদছে মানুষ।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/এমএস

‘আমরা কি একবারও তার পরিবারের কথা, রুবানা হকের কথা, নাভিদের কথা, উমায়রার কথা, তানিশার কথা ভেবেছি? ভেবেছি তার পরিবারের মানুষজন কতটা মনোকষ্ট, মনোপীড়নে দিনযাপন করছিলেন?’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।