অপরাধের জীবন চক্র

তানজীনা ইয়াসমিন
তানজীনা ইয়াসমিন তানজীনা ইয়াসমিন , কলামিস্ট, গবেষক
প্রকাশিত: ০৪:৫০ এএম, ০১ ডিসেম্বর ২০১৭

 

খবর : ভারতের হরিয়ানার বিজেপি নেতা কুম্ভর সুরজপাল সিং ঘোষণা করেছেন, ‘পদ্মাবতী’ ছবির পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালি এবং নায়িকা দীপিকা পাড়ুকোনের মাথা যে কাটতে পারবে, তাকে ১০ কোটি রুপি পুরস্কার দেওয়া হবে।

একটা দেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতা যখন প্রকাশ্যে সেই দেশের শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অভিনেত্রীর মাথার দাম ঘোষণা করে তখন বুঝতে হবে সেই দেশের জনগণের নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। কারণ এই চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরু থেকে সেটে আগুন, নির্মাতাকে শারীরিক আক্রমণসহ উগ্রবাদীত্ব চলছেই। ছবির অন্যতম অভিনেত্রী অদিতি রাও খুব যুক্তিযুক্ত লিখেছেন,‘আমি বুঝতে পারি না যখন বাস্তবে নারীরা ধর্ষিত, অত্যাচারিত, নির্যাতিত হয় আর বিক্রি হয়ে যায় অথবা ভ্রূণ অবস্থায় গর্ভেই তাদের হত্যা করা হয়, তখন কেন এই মানুষগুলোর রাগ হয় না? তখন কেন কেউ এর পরিবর্তন দাবি করেন না।’

আমাদের বাঁশখালীর শীল পরিবারের ১১ জনকে বদ্ধ ঘরে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ১৪ বছরেও বিচার হয়নি, এর জন্যে আমার, আমাদের ভেতরে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়। আমি মনে করি শীল পরিবার মুসলমান হলে এই ক্ষরণ কম হতো কারণ সংখ্যাগুরুদের কাছে লঘুদের দাবি থাকে। সরকারের প্রতি ডা. বিমল শীলের যে সংখ্যালঘু নিরাপত্তা আইনের আবেদন, তাতে সমর্থন করি। রংপুরে সাম্প্রতিক হামলাও একইভাবে আমাদের অপরাধী করে। কিন্তু পাশের বড় দেশ, বিশ্ব অর্থনীতিতে সুপার পাওয়ার ভারতের প্রশাসনকে যখন এহেন আদিম আচরণে নির্বিকার থাকতে দেখি তখন সত্যিই ভাবতে হয় সেই দেশে লঘু, গুরু কেউ কি আমাদের চেয়ে নিরাপদে? ইউএনডিপির হিউম্যান ডেভেলপম্যান্ট ইনডেক্সেও আমরা ভারতের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু মানুষের কিছু মৌলিক আচরণের সাথে অপরাধও আসলে সর্বজনীন। সঠিক আইনের শাসন ছাড়া এর দমন সম্ভব নয়। যুগের পর যুগ কঠিন আইন, নিয়ম কানুন এবং এর সঠিক প্রয়োগই এর হার মানবিক পর্যায়ে নামায়।

সৃষ্টির আদিকাল থেকে যাপিত জীবনের অন্য আর দশটা জিনিসের সাথেই জড়িত অপরাধ। ইসলাম ধর্মে আদম (আঃ) এর পুত্রদ্বয়ের মধ্যে কাবিল বোন আকলিমাকে বিয়ে করতে হাবিলকে খুন করে। অতঃপর শাস্তির ভয়ে পালিয়ে যায়। কাজেই মানুষ যখন বলে অমুক যুগ ছিল স্বর্ণযুগ তখন সে হয় নিজে বোকার স্বর্গে থাকতে, শ্রোতাকেও বানাতে চায়। অথবা অথবা সে অজ্ঞ। সেই অর্থে কোন যুগই স্বর্ণযুগ না। কোন যুগকে আপনি স্বর্ণযুগ বলবেন? খ্রিস্ট শতাব্দীর আইয়ামে জাহেলিয়াত (অজ্ঞানতার যুগ), নাকি ডেড সী`র পাপী সদম জাতির যুগ? নাকি সেই সত্য যুগ যখন হিন্দু নিম্নবর্ণের নারীদের উর্ধাঙ্গ ঢাকার অধিকার ছিল না? রাজার ভোগের স্বীকার না হলে যখন তারা বিয়ের অধিকার লাভ করতো না?

মানুষ বাস করতে চায় অতীতের সুখচিন্তায়, ভবিষ্যতের কল্পনায়। বর্তমানে কেউ বাস করতে চায় না। তাই সব অতীতকালই গল্পে স্বর্ণকাল! মাদ্রাসায় সেদিন খুন হলো এক কিশোর, জ্যেষ্ঠ কিশোরের হাতে। কারণ অনৈতিক সম্পর্কে অস্বীকৃতি। মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসার জীবন যাপন শুনেই আঁতকে উঠি। সপ্তাহে কেবল জুম্মার নামাজ আদায়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী থেকে বের হতে পারতো। আর সেই বেষ্টনী এমনি যে বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এখানে কোন স্কুল আছে। এখন মাদ্রাসার কারাগারের মত বিধিনিষেধের বেড়াজ্বালে চলে আসা ভয়াবহ বিকৃতি নিয়ে আলোচিত হয়, কারণ প্রকাশিত খবরগুলোতে শিক্ষকেরাও প্রায়ই জড়িত থাকেন বলে নয়; কারণ ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলি তুলনামূলক দুস্থ বলে, এর ছাত্র -শিক্ষক কেউই ক্ষমতাবান নয় বলে। এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আমাদের হেয়তর দৃষ্টিভঙ্গি । কিন্ত জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী কর্তৃক কনিষ্ট শিক্ষার্থীকে অনৈতিক সম্পর্কের জবরদস্তি বা বুলিং সব বিধিনিষেধের বেড়াজ্বালের আবাসিক উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রেই কিন্তু প্রচলিত। হয়তো কেঁচো খুড়তে সাপ বের হবে সব আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্রেই এমন কম বেশি প্রচলিত, তা সে যতই উচ্চবিত্ত স্কুলই হোক।

খ্রিস্ট ধর্মের, বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চের ফাদার কর্তৃক সিস্টার/ নান, ব্যাপটাইজ (খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত) হতে আসা ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা কালের পর কাল, যুগ ধরে এই বিকৃতির স্বীকার। এখন এইসব বাচ্চারা, যারা ছোট থেকেই সবচেয়ে পবিত্রতম স্থানে, সবচেয়ে সন্মানিত ব্যক্তির মাঝেই এই বিকৃতি দেখে এসেছে তাদের মনোজাগতিক বৈকল্য হয় ভয়াবহ। তারা আর দশটা দাগী অপরাধীর মত হবেনা। তারা দেখতে ফেরেশতা, মনে পিশাচ। কারণ তাদের মনে আসন গেড়ে যায়- এটাই স্বাভাবিক। তাদের চোখে এটাই ধর্ম, এটাই সম্পর্ক; পাপবোধের কোন বিষয়ই নেই।

এভাবে বেড়ে ওঠা কারো কাছে কতটা স্বাভাবিক আচরণ কাম্য? আরো পেছনে যাই; ক্যাথলিক ফাদারদের বিয়ে করার অনুমতি নেই, নানদেরও নেই। একটা অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে সমাজ তাদের জোর করে বঞ্চিত করেছে। পারিবারিক চাপে হয়তো শিশুকালে ইচ্ছা অনিচ্ছা গড়ে ওঠার আগেই দীক্ষা নেয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক এক চাহিদা তো চাপা দেয়া যায় না। এরই প্রমাণ এই বিকৃতি। এই ফাদারেরা সমাজের চাপিয়ে দেয়া নিয়ম কর্তৃক অত্যাচারিত, শিশুগুলি ফাদার বা শিক্ষকের অবদমিত মনের বিকৃতির স্বীকারে অত্যাচারিত এবং এভাবেই তারাও ফাদার, সিস্টার হয়ে উঠে একই প্রক্রিয়া অব্যহত রেখে চক্র পূর্ণ করে চলে।

আজকের ধর্ষণ খুনের মহামারীর যুগেও আতঁকে উঠেছি ৭ বছরের ফারজানাকে ধর্ষণসহ খুনে; লাশ গুম করে একের একের পর নিখুঁত মিথ্যা আর অভিনয়ের মাধ্যমে ডিবি পুলিশকেও ঘোলা খাইয়ে বেড়ানো ১৪ বছরের কিশোরের মুন্সিয়ানা দেখে! মেধাবী, ভদ্র কিশোরের ঘটনা সিনেমাকে হার মানায়। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধী ধরার যুগে পিতৃহীন কিশোর তার দামী ফোনটিও অবলীলায় বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিল, যে কোন ক্লু মুছে ফেলতে। কারণ সে জানে দেশের ১% ধর্ষণ খুনের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। কিশোর আইনে সে আরো ছাড় পাবে। তার অবচেতন মনের আদিম পাপকে এসব তথ্যই ভয়ানক ভাবে জাগ্রত করেছে; নেটে দেখা নিষিদ্ধ ছবি নয়।

ওসব ম্যাগাজিন জাপানে সেভেন ইলেভেনের মত ২৪ ঘন্টার কনভেনিয়েন্ট স্টোরেও খোলা সাজানো থাকে, ফ্রিতেই দেখে। তাতেও কোন অপরাধ ঘটছেনা, কারণ আইনের শাসন। আর আমাদের সমাজে একটা অবোধ শিশুও জেনে যায় তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করা গৃহকর্মীকে সে যে কোনভাবে নির্যাতন করতেই পারে। এটা ওর অধিকার আর সেই অসহায় গৃহকর্মীর প্রাপ্য। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ, যেখানে পতিতাবৃত্তি বৈধ। ২০০ বছর ধরে চলমান এই পেশার দৌলতদিয়া পতিতাপল্লী বিশ্বেও অন্যতম বৃহৎ। পল্লীগুলিতে ১৩/১৪ বছরের একটা মেয়েকে জোর করে কেউ বিক্রি করে দেবার পরও তার ৪/৫ বছর লেগে যায় সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় যুক্ত পেশায় উপার্জন দিয়ে তার বিক্রির দাম শোধ করতে। তার আগে সে উদয় অস্ত পাশবিক জীবন কাটিয়ে যায়, কোনরকম অর্থনৈতিক মানবিক অধিকারের বাইরে।

আর ৪/৫ বছর পর স্বাধীনতা লাভের পর এই সীল মোহর নিয়ে সে আর কোনদিনই সভ্য (!) সমাজে ফিরতে পারে না। এরপর, একসময় সেও এখানকার “ম্যাডাম”দের মতই মেয়েদের ধরে আনার কাজে যুক্ত হয়। এভাবেই এই অন্ধকার জগতের চক্র পূর্ণ হয়। হিন্দু ধর্মমতে পতিতালয়ের প্রবেশদ্বারের মাটি সবচেয়ে পবিত্র মাটি, যা ছাড়া দেবীর প্রতিমা গড়া যায় না। এর সূত্র শুনেছি, মহারাজা, মনীষী যেই এই ঘরে প্রবেশ করেন, তিনি তার যাবতীয় পূণ্য এর চৌকাঠেই রেখে ভেতরে প্রবেশ করেন। জগতের সকল পেশার সকল পূণ্য জমা আছে এই মাটিতে। আর সবার পাপ পান করে মরার পরেও গণিকারা এমনি পাপী যার লাশ স্বধর্মে সৎকারও হতো না, এই কিছুকাল আগেও!

এই যে এখন তাদের কিছু সন্মান, ভোট দানের অধিকারসহ কিছু প্রাপ্তি হচ্ছে- তার চোখে কি এটাই স্বর্ণযুগ না? সভ্যতা আগাবে, পাপ উন্মোচন হবে, শাস্তি পাবে, শোধন হবে- সেটাই তো সত্যযুগ! পলায়নপর উটপাখি মানুষ, তোমরা পাপীর শ্রেণি, জন্ম নির্বিশেষে প্রাণের প্রতি হুমকির সেই পাপ মোচন করে অপরাধের চক্র ভাঙ্গো, বর্তমানকে বাসযোগ্য করো। কোন এক সুবিধাভোগী সূত্র বানিয়ে কাউকে লঘু , নীচ শ্রেণি, সমাজচ্যুত তকমা দিতে এত উদগ্র যে সমাজ, সেই সমাজ এত পাপ কি করে ধারণ করে?

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।

[email protected]

এইচআর/জেআইএম

‘১৩/১৪ বছরের একটা মেয়েকে জোর করে কেউ বিক্রি করে দেবার পরও তার ৪/৫ বছর লেগে যায় সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় যুক্ত পেশায় উপার্জন দিয়ে তার বিক্রির দাম শোধ করতে। তার আগে সে উদয় অস্ত পাশবিক জীবন কাটিয়ে যায়, কোনরকম অর্থনৈতিক মানবিক অধিকারের বাইরে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।